জো বাইডেনের অভিষেক: কোন পথে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর?

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তেমন গুটি নেই — তাই বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন নীতি এবারো মূলত লেনদেনের মধ্যেই অব্যাহত থাকবে।

জো বাইডেনের অভিষেক: কোন পথে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফটো: এবাকা প্রেস/আলামি

বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হলো। এ অবস্থায় দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কী ধরনের পরিবর্তন আমরা আশা করতে পারি — এ বিষয়ে যখন নেত্র নিউজ থেকে আমাকে লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন মনে হলো লেখাটি লিখতে ভালোই লাগবে। মার্কিন ঘরোয়া নীতির ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন বিশেষভাবে প্রগতিশীল হবে বলে আমরা ধারনা করছি। বাইডেন প্রশাসনের উদ্দেশ্য হবে ট্রাম্প প্রশাসনের অকার্যকর, পশ্চাদগামী ও কর্তৃত্ববাদী নীতিকে বাতিল করা। পাশাপাশি, নতুন প্রশাসন এমন এক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করবে যার লক্ষ্য হবে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের হৃত প্রভাব ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার।

অবস্থা যদি এমনই হয়, তাহলে এসব নীতির বদৌলতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কেন আরও আন্তরিক ও ফলপ্রসূ সম্পর্ক দেখা দেবে না? প্রশ্নটি নিয়ে আমি ভাবতে শুরু করলাম। গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ নিয়ে আমার লেখা নিবন্ধগুলো পর্যালোচনা করলাম। সেখান থেকে আমার মনে হলো, বাইডেন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প-পূর্ব উদার গণতান্ত্রিক জামানা পুনরুদ্ধারে কিছু সাহসী পরিবর্তন আনবেন। কিন্তু বাংলাদেশতো গত এক দশকে গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে অর্থাৎ একটি অনুদার ও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র যেখানে অল্পের জন্য কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থা থেকে সরে নিজেদের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মেরামত ও শক্তিশালী করতে মনোযোগী হচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যার নেতারা দৃশ্যত গণতন্ত্র থেকে সরে বেশ টেকসই একটি একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। তাহলে আমরা কীভাবে আশা করি যে এই দুই বিপরীতমুখী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটবে? অন্যভাবে বলতে গেলে, দুটি রাষ্ট্র — যাদের কোনো অভিন্ন শত্রু নেই, যাদের রাজনৈতিক কাঠামো বিপরীতমুখী — তাদের মধ্যকার সম্পর্ক তাহলে কেন হঠাৎ করে আরও আন্তরিক ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে? আমিতো তেমনটা ঘটার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

তবে আমি এটাও মনে করি না, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। কারণ, আমি মনে করি না, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার সক্রিয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে উস্কে দেওয়ার পথ খুঁজছে। আমি এও মনে করি না যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি রাতারাতি আরও গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে; কিংবা দেশটির সরকার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে যেসব নিপীড়নমূলক কার্যকলাপে মুনশিয়ানা অর্জন করেছে, সেসব কার্যকলাপ থেকে তারা সরে আসবে; কিংবা এমন কোনো গণতান্ত্রিক বোধোদয় ঘটবে যে তারা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করবে। তেমনটা অলীক-কল্পনার মতোই অস্বাভাবিক।

সুতরাং, আমার উপসংহার হলো, সম্পর্ক এখন যেমন আছে তেমনই থাকবে। বর্তমানে এই সম্পর্ক আমার কাছে মনে হয় খুবই লেনদেন বা বিনিময়-ভিত্তিক। সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী প্রকল্প, কিছু অর্থনৈতিক সহায়তা প্রকল্পের মতো অভিন্ন কিছু ইস্যু, যেখানে উভয় দেশেরই আগ্রহ আছে, সে সব ইস্যুতে একযোগে কাজ করার ব্যাপারে দুই দেশের এক ধরনের ঐক্যমত আছে। এছাড়া আছে চীন নিয়ে মার্কিন সতর্কতা। এর পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে দুই পক্ষেরই দ্বিমত থাকবে; বিশেষ করে মানবাধিকার ইস্যুতে। যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে আওমী লীগ সরকারের নিপীড়নমূলক কার্যকলাপ বা বাকস্বাধীনতা প্রায় সম্পূর্ণ দমন করে ফেলার মতো ইস্যুগুলোতে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে দ্বিমত থাকবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, বাংলাদেশকে ঘিরে গুরুতর কোনো সংকট দেখা না দিলে, আমি মনে করি না দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আসলে বাইডেন প্রশাসনের রাজনৈতিক রাডারে ট্রাম্প বা ওবামা প্রশাসনের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাবে। এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। কারণ নিজ দেশেই বাইডেনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এজেন্ডা অত্যন্ত বড় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ফলে, বড় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাইডেন বড় বড় সমস্যা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকবেন।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি প্রচুর সময় ব্যয় করছি। প্রায় একই পরিমাণ সময় আমি ব্যয় করেছি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝাতে যে, এই ইস্যুতে আরও কঠোর নীতিমালা প্রয়োজন। তখন ক্ষমতায় ওবামা প্রশাসন। আর আমার আবেদন তখন ভদ্রভাবেই অগ্রাহ্য করা হয়। ওবামা প্রশাসন তখন আরও বড় ইস্যুতে ব্যস্ত ছিল, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করা ছিল যার অংশ। এদিকে ভারত তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমি মূলত যুক্তি দিয়েছিলাম যে, বাংলাদেশ যেভাবে ক্রমেই কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদিকটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করুক যুক্তরাষ্ট্র। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রতিক্রিয়ায় যা জানায় তা এরকম ছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থ বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এ ধরনের পরিবর্তন আনার পথে অন্তরায়।

ওই সময়টাতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ও পরবর্তীতে সেসব গোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশে এক ধরনের সমর্থন প্রকাশের প্রবণতাও ছিল। আমার এখন মনে হয়, আমার সেই যুক্তি সম্ভবত বাস্তবতার চেয়েও বেশি জোরালো ছিল। কিন্তু সেই মার্কিন নীতি, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশ সরকার তাদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ ঢাকতে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।

এদিকে অনেক পশ্চিমা ও মার্কিন নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশকে চেনেন দেশটির মুগ্ধ করার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য থেকে। রক্তাক্ত একটি যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন দেশটিকে স্থায়ী “বাস্কেট কেইস” ভাবা হতো। আমরা ভেবেছিলাম, এই দেশটি আমাদের জীবদ্দশায় বা দীর্ঘ সময় অবদি শুধুমাত্র বিদেশী সহায়তা ও দাতব্য সহায়তার উপরই নির্ভর করে চলবে। কিন্তু মাত্র ৩০ বছরে ভালো নীতিমালা ও মানুষের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশটি নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজে পরিণত করেছে (অন্তত মহামারির আগ পর্যন্ত)। ফলে এই দেশের গ্ল্যামার অনেক নীতি নির্ধারককেই টানে। ঠিক একই সময়ে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তলানির অবস্থান থেকে প্রায় শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। আর, এই রঙিন বয়ানে চাপা পড়ে গেছে কর্তৃত্ববাদের দিকে দেশটির রাজনৈতিক যাত্রার এক নোংরা গল্প। চাপা পড়েছে নোংরা কর্তৃত্ববাদী কৌশল, ধারাবাহিক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। আর এগুলোর মধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপদতার পথে রাজনৈতিক বিরোধীদের স্তব্ধ করার কাজ নিশ্চিত করা হয়েছে।

সাত বছর আগে আরেকটি সমস্যা ছিল, ওবামা প্রশাসনের (আমি আরও যোগ করবো, ডেমোক্রেটিক পার্টির) সঙ্গে ভারতের প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক। আমার মনে হয়, সেই সম্পর্ক এখন বদলেছে। মোদি সরকার ক্ষমতায় থাকায় ভারত নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের ধ্যানধারণা নিশ্চিতভাবেই পাল্টেছে। তবে ভারত ক্রমেই কর্তৃত্বপরায়ণ ও জাতিবাদি হয়ে উঠলেও, এটি এখনও চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র। চীন এখন এই অঞ্চলে নিজেদের পেশিশক্তি আরও বেশি প্রসারিত করছে। আর এই বিষয়টিই বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের বিদ্যমান নীতিকে প্রভাবিত করেছিল।

তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের বিশেষ আগ্রহের জায়গা থেকে একটি বদল আসতে পারে। তা হলো, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বাইডেন শিবিরের প্রকাশ্য মন্তব্য আরও নির্দিষ্ট ও কঠোর হবে। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য সন্তোষজনক হবে না। গত এক দশকে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়লেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তেমন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না থাকায় এসব সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছে সরকার।

তারপরও বাইডেন সরকার শিগগিরই যখন বুঝতে পারবে যে (যদি এখনও না বুঝে থাকে), বাংলাদেশ সরকারের ওপর মার্কিন প্রভাব কমতে কমতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে, তখন বাংলাদেশ নিয়ে সে সতর্ক হবে, পাছে যেটুকু প্রভাব আছে, তাও যেন হারিয়ে না যায়; বাংলাদেশ যেন আরও বেশি চীনের দিকে ঝুঁকে না যায়।

গত ৮-১০ দশকে বাংলাদেশ একটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র থেকে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থার দিকে হেঁটেছে; ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মানুষ একটি নির্লজ্জ্ব ভোট চুরির নির্বাচন দেখেছে যা কর্তৃত্ববাদী কাঠামোকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এগুলো চুপচাপ শুধু দেখেই গেছে।

নিজের বিশাল সব লক্ষ্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এজেন্ডা ইতিমধ্যেই অনেক ভারি। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন নীতিতে আরও সক্রিয় বা কর্তৃত্ববাদ-বিরোধী ছাপ ফেলতে পারে কেবল একটি বিষয়ই; আর তা হলো একটি সক্রিয়, ঐক্যবদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে আকর্ষণীয় বিরোধী শক্তি। ২০১৮ সালে আমরা এই ধরনের একটি শক্তির উত্থানের আভাস হয়ত দেখেছি। কিন্তু তখন বিরোধী পক্ষ অতটা শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে আকর্ষণীয় ছিল না যে আওয়ামী লীগের বিকল্পের প্রতি সমর্থক গোষ্ঠী পথে নেমে সরকারের ভোট-চুরির প্রক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। একটি বিরোধী গোষ্ঠীর তখনই সক্রিয় আন্তর্জাতিক সমর্থন আকৃষ্ট করার সুযোগ থাকবে, যদি সবচেয়ে বড় বিরোধী দলটি ঐকান্তিক সংস্কার আনে, যার শুরুটা হতে পারে সম্পূর্ণ নতুন নেতৃত্বের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।●

উইলিয়াম বি মাইলাম ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে উইড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্স-এ একজন পাবলিক সিনিয়র ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন।