জেনারেল আজিজকে কেন বরখাস্ত করেননি হাসিনা

কীভাবে সবকিছু অপরিবর্তিত রেখেই “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন” থেকে উদ্ভূত সংকট মোকাবেলা করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

জেনারেল আজিজকে কেন বরখাস্ত করেননি হাসিনা

আল জাজিরা ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র প্রচারিত হয় ফেব্রুয়ারির শুরুতে। এতে উঠে আসে বাংলাদেশ সরকারের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে ঘটে চলা অকল্পনীয় দুর্নীতির চিত্র। এই তথ্যচিত্র সম্প্রচারের পর আড়াই মাস পার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে পুরো বিষয়টা সামাল দিলো, তা সম্ভবত প্রকাশিত দুর্নীতির চেয়েও হতবাক করার মতো।

কোটি কোটি মানুষ ফেসবুক এবং ইউটিউবে আল জাজিরার তথ্যচিত্রটি দেখেছেন। কিন্তু এতো বড় কেলেঙ্কারির পরও এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বা দুর্নীতি রুখতে ব্যর্থতার দায় নিয়ে কেউ পদত্যাগ করেনি, কোনো তদন্ত শুরু হয়নি। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই তথ্যচিত্র প্রচারের পর আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতর কিংবা বাইরে আদৌ কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা তা বোঝা মুশকিল।

বাংলাদেশ একটি কর্তৃত্ববাদী, বলা যায় প্রায় সম্পূর্ণ একদলীয়, রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই এবং গণমাধ্যমও কঠোরভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত। এই পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ববাদী একটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে আর কী প্রত্যাশা করা যায়।

উপরন্তু, তথ্যচিত্রে মূল যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, তা দেশের সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধেই। অভিযোগগুলো এসেছে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে, যে প্রতিষ্ঠানকে সব চলতি বিচার কাঠামোর ঊর্ধ্বে ভাবা হয়। প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। মজার বিষয় হচ্ছে, তথ্যচিত্রের নজর মূলত সেনাবাহিনীর উপর থাকায় সরকারের যেন বেশ সুবিধা হয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এমনিতেই ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করতেই ভয়ে থাকে। আর সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে তো তারা একেবারে যেন অসাড়, জড় বস্তুতে পরিণত হয়। অবস্থা এমনই যে সেনাবাহিনীর পছন্দের বাইরে কিছুই উচ্চারণের ক্ষমতা নেই তাদের।

সবকিছুর পরও সরকার বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতি সামাল দিতে ভিন্ন কৌশল নিতে পারতেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন যে, যেহেতু জেনারেল আজিজ আহমেদের দুর্নীতি প্রকাশের ফলে তার সরকারের বদনাম হচ্ছে, তাই সবচেয়ে সহজ সমাধান, জেনারেল আজিজকে পদচ্যুত করা। আজিজকে বাদ দিয়ে দিলেই আল জাজিরার তথ্যচিত্রের আলোড়ন কমে যেত এবং আজিজের বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগ আর হাসিনা সরকারের গায়ে লাগত না। সেই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার কথিত অবস্থানের ওজন কিছুটা বৃদ্ধি পেত। হাসিনা এই তথ্যচিত্রকে ব্যবহার করে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারের কাছে নিজের চেহারা একটু উজ্জ্বল করতে পারতেন।

উপরন্তু, আল জাজিরার তথ্যচিত্রটি সম্প্রচারের আগে থেকেই আজিজের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন শেখ হাসিনা। গত বছর অক্টোবরে জেনারেল আজিজের কিছু ফাঁস হওয়া ফোনালাপ প্রকাশ হয় ইউটিউবে। সেনাবাহিনীতে জেনারেল আজিজের ব্যাচমেট, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সরকারের সমালোচক শহিদ উদ্দিন খানের সঙ্গে ছিল এই কথোপকথন। আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, আজিজ পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ফোনালাপ নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন যে কথাগুলো তার হলেও সেগুলো কারসাজি করে সাজিয়ে কথার অর্থ পরিবর্তন করা হয়েছে। ফাঁস হওয়া ফোনালাপের রেকর্ডিংগুলো আজিজের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর ছিল। সেখানে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত। এই ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর জেনারেল আজিজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে প্রধানমন্ত্রী তা মেনে নেন বলে সেই সিনিয়র নেতা জানান। বিনিময়ে জেনারেল আজিজও সেনাবাহিনীর ভেতরে যেসব বিরোধ জেগে উঠছে, সেগুলো মিটিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রীকে।

এসব ঘটনার পরপরই প্রকাশ হয় আল জাজিরার তথ্যচিত্রটি। এ অবস্থায় এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক হতো না যে শেখ হাসিনা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জেনারেল আজিজকে বিদায় করবেন। তারিক সিদ্দিকও নিঃসন্দেহে আজিজের প্রস্থানের পক্ষে সমর্থন দিতেন। এক সময় ঘনিষ্ট থাকলেও এখন আর এ দুজনের সম্পর্ক সৌহার্দপূর্ণ নেই। এমনকি এক পর্যায়ে আজিজকে যেন সেনাপ্রধান করা না হয়, তার সর্বাত্মক চেষ্টাও চালান তারিক সিদ্দিক।

নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পায় এমন কোনো কাজ করা শেখ হাসিনার স্বভাব-বিরুদ্ধ। সেনাপ্রধান আজিজকে অপসারণ করা হলে হাসিনার দুর্বলতা প্রকাশ পেত। তাছাড়া, সেনাপ্রধান হিসেবে আজিজের মেয়াদ শেষ হতে মাত্র চার মাস বাকি ছিল। এ কারণেও হয়ত হাসিনা অপেক্ষা করতে চেয়েছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এখন আর তারিক সিদ্দিকির উপদেশ আগের মতো আমলে নেন না বলেও শোনা যায়।

হয়ত জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয়ার আরও কারণ ছিল হাসিনার। হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রতি জেনারেল আজিজের বিশ্বস্ততা নিঃসন্দেহে তারমধ্যে অন্যতম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আজিজ। যেমন, আজিজ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) প্রধান হিসেবে হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মোকাবেলা করেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সেনাপ্রধানের অবস্থান থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের তকমা দেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আড়াল করতে আওয়ামী লীগকে সহায়তা করেন।

আজিজকে সরিয়ে দিলে অন্য ঝামেলা সৃষ্টি হতে পারে বলেও হয়ত চিন্তা করেছেন শেখ হাসিনা। প্রথমত, সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে সবসময়ই এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকে। সামরিক বাহিনীর ভেতর স্পষ্টতই একটি আজিজ-বিরোধী জোট রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আজিজের প্রতি বিশ্বস্ত এমন দলও রয়েছে সেনাবাহিনীতে। কাজেই তাকে সরিয়ে দিলে কী ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিল শেখ হাসিনার।

সেই সঙ্গে আজিজকে অপসারণ করা মানে তার ভাইদেরও শাস্তি দেয়া। আজিজের ভাইয়েরা সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন। তারা ছিলেন সন্ত্রাসী চক্রের সদস্য এবং এখনো এসব কাজে যুক্ত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া সরকারের অনেক গোপন বিষয়ও নিশ্চয় তাদের জানা রয়েছে। আজিজকে অপসারণ করলে তার ভাইদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নিয়েও হয়ত উদ্বিগ্ন হয়েছেন হাসিনা।

সব মিলিয়ে, আজিজকে তার পদে বহাল রাখাটা নিশ্চয় সবচেয়ে নিরাপদ সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে শেখ হাসিনার কাছে। আর যেহেতু সরকার গণমাধ্যম ও বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, সেহেতু তিনি এই পথ বেছে নিতে পেরেছেন। পাশাপাশি এও নিশ্চিত করেছেন যে (যদি আদৌ কারও কোনো সন্দেহ থেকে থাকে) দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে বর্তমান সরকারের কোনো সত্যিকার আগ্রহ নেই।●

ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।