বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের মালিক কারা?

বাংলাদেশের মিডিয়া ইকোসিস্টেমে পরস্পরবিরোধী একটি চিত্র দেখা যায়। একদিকে গত দুই দশকে দেশের গণমাধ্যম খাতের উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেছে। অন্যদিকে, ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ২০২০ সালের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। গত এক দশকে বাংলাদেশের এই অবস্থান সর্বনিম্ন। সরকার তার সমালোচকদের কণ্ঠরোধ এবং সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ করছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হয়। দেশে সাংবাদিকদের যখন-তখন হয়রানি, গ্রেফতার ও সরকার সমর্থকদের আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে।

স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপের এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যেই জানা গেল আরেক তথ্য। সম্প্রতি কিছু প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের উপর নজরদারি চালাতে গণ-নজরদারিতে সক্ষম সরঞ্জামাদি কিনেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আর এখন তা ব্যবহারও হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দেশটি ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম খাত দৃশ্যত বিকশিত হচ্ছে। গত এক দশকে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বহু মিডিয়া আউটলেটের উত্থান ঘটেছে। সরকারি হিসাব মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৪৫টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, ২৮টি এফএম, ৩২টি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন, এক হাজার ২৪৮টি দৈনিক পত্রিকা ও শতাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ছিল। মিডিয়া জগৎ কঠিন বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দী থাকার পরও বিপুল সংখ্যক মিডিয়া আউটলেট গড়ে ওঠার এ চিত্রে প্রশ্ন জাগে: বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের মালিক আসলে কারা?

গণমাধ্যমের মালিক কারা?

বাংলাদেশে মিডিয়া আউটলেটগুলোর মালিকানা সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য পাওয়া মুশকিল। গণমাধ্যম সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতার অভাবে খোলামেলাভাবে তাদের মালিকানা বিষয়ক বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই বললেই চলে। ফলস্বরূপ, পরিচালনা পর্ষদে কারা দায়িত্ব পালন করছেন, সংস্থায় তাদের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা কতটুকু তা যেমন জানা যায় না, তেমনি এ বিষয়ে যাচাই বাছাইয়ের সুযোগও কম ।

গণমাধ্যম সংস্থাগুলো তাদের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী প্রকাশ না করে সেই অস্বচ্ছতাকে আরও ঘোলাটে করে ফেলে। দেশে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি গ্রুপ আছে, যারা মিডিয়া সেক্টরের আর্থিক অস্বচ্ছতার এই দিক নিয়ে কথা বলতে সক্ষম। মিডিয়া ওয়াচডগের দায়িত্ব পালনে সক্ষম সংস্থা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। আর সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকার সঙ্গে মিডিয়া মালিকানার বিরাজমান সংযোগ নিয়ে খুবই অল্প কিছু গবেষণামূলক কাজ হয়েছে।

এই ঘাটতি পূরণে সম্প্রতি ঢাকার সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেছি। “বাংলাদেশে গণমাধ্যমের মালিক কারা?” শিরোনামে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। ৪৮টি বড়  মিডিয়ার উপর চালানো এই জরিপে দেখা গেছে, এগুলোর মালিকানা আটকে আছে মূলত ৩২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে। আর এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত।

অনুসন্ধান

মিডিয়া আউটলেটগুলোতে বিনিয়োগকারী শতাধিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক সংস্থা ও ব্যক্তির প্রোফাইল ঘেঁটে এই গবেষণায় বাংলাদেশে গণমাধ্যম মালিকানার তিনটি পরস্পর সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়।
 
১. বহু গণমাধ্যম সংস্থাই তাদের মালিকের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। “নেপোটিজম” বাংলাদেশের মিডিয়া সংস্থাগুলির মালিকানা ও পরিচালনার একটি পরিচিত দিক। প্রায়শই দেখা যায়, গণমাধ্যমের মালিকানার অধিকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমটি পরিচালনার জন্য নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের কথা বলা যায়। এটি এমন একটি শিল্প-গ্রুপ, যারা দেশের কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের মালিক। এই গ্ৰুপের চেয়ারম্যানের ছেলে গ্রুপটির মালিকানাধীন ইষ্ট-ওয়েষ্ট মিডিয়া কোম্পানির  ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

নিউজ আউটলেটগুলোকে নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার আরেকটি বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যায়, মিডিয়া মালিকেরাই তাদের সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬ সালে, বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী জানান, দেশের ১০৭৮ টি সংবাদপত্রের মধ্যে ১০০৫টিই, বা ৯৩% সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকের মালিকানাধীন। অন্যভাবে বললে, মালিকই হচ্ছেন সম্পাদক। ভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায় মাত্র ১০০টিরও কম সংবাদপত্র পরিচালিত হয় পেশাদার সম্পাদক দিয়ে।

তাছাড়া দেখা গেছে, একই পরিবারের সদস্য; যারা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল সমর্থন করেন কিন্ত বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মালিক হিসেবে ওই একই পরিবারের সদস্যেরা একাধিক মিডিয়া আউটলেট নিয়ন্ত্রণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, চৌধুরী পরিবারের দুই ভাই, সাঈদ হোসেন চৌধুরী ও সাবের হোসেন চৌধুরী দুটি পৃথক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিক ও পরিচালক। প্রত্যেকেই আবার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম সংস্থার মালিক। সাঈদ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমালোচক হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে সাবের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সংসদ সদস্য।

২. বেশিরভাগ মিডিয়া আউটলেটের মালিকই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত। এই সংশ্লিষ্টতাগুলো বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পায়। একটি মিডিয়া আউটলেট লাইসেন্স পাবে কিনা তা নির্ভর করে মিডিয়ার মালিকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের ওপর। আবার অনেক রাজনীতিবিদের নিজস্ব গণমাধ্যম রয়েছে। এসব গণমাধ্যম তাদের রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের ক্লায়েন্টেলিজমের অর্থ হল সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের মালিকানারও পরিবর্তন।

এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভবত একুশে টেলিভিশন (ইটিভি)। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই চ্যানেলটির মালিকানা একাধিকবার পরিবর্তন হয়েছে। শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পর চ্যানেলটি যতদিন নতুন সরকারের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে না এসেছে, ততদিন এটি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।

৩. বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম সংস্থাগুলোর মালিক প্রভাবশালী পুঁজিপতিরা। এদের আবার বিভিন্ন ধরনের আর্থিক স্বার্থ থাকে। আজ বাংলাদেশের ব্যবসা, রাজনীতি ও মিডিয়া জগৎ মিলেমিশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা শিল্প, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত এবং রিয়েল এস্টেট জগতে মিডিয়া মালিকদের বিপুল উপস্থিতি বিশেষ উদ্বেগজনক। তারা তাদের ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের পক্ষপাতিত্বের জন্য নিজের মালিকানাধীন গণমাধ্যমগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।

উল্লেখিত চারটি সেক্টরের প্রত্যেকটি বছরের পর বছর ধরে চলা আর্থিক অনিয়ম ও সন্দেহজনক ব্যবসায়িক চুক্তির জন্য খবরের শিরোনাম হয়েছে। এসব খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বেশ কয়েকটি মিডিয়া আউটলেটের মালিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। এসব দ্বন্দ্ব আবার গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

দেখা গেছে, গণমাধ্যম মালিকেরা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে তার প্রচার মাধ্যমে কী প্রচারিত হবে, সেই কন্টেন্টও নির্ধারণ করে দেন। যেমন উল্লেখ করা যায়, কোভিড-১৯ মহামারীতে টিউশন ফি মওকুফের দাবিতে বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশ লিবারেল আর্টস ইউনিভার্সিটির দুই শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হোন। কিন্তু খবরটি একেবারে চেপে যায় জেমকন গ্রুপের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো। জেমকন গ্রুপের চেয়ারম্যান আবার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। জেমকন গ্রুপের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোর এই নীরবতা থেকে বোঝা যায় যে, সংবাদ প্রচারে তাদের সম্পাদনা প্রক্রিয়ায় ইচ্ছাকৃত ও সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের মালিকদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ সংবাদের বিষয়বস্তুকে যেভাবে প্রভাবিত করে, তা গুরুতর তদন্তের দাবি রাখে।

ভবিষ্যৎ গবেষণার পথ ও প্রশ্ন

“বাংলাদেশে মিডিয়ার মালিক কারা?” প্রশ্নটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে ক্রমে সরে আসা একটি দেশের গণমাধ্যম সম্পর্কিত আলোচনায় খুব সামান্যই আঁচড় কাটবে। সরকার যতই ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে, বাংলাদেশ ততই একটি হাইব্রিড বা সংকর শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা বরাবরই  এক ধরণের গণতান্ত্রিক মোড়কে ঢাকা থাকে। গত এক দশকে গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে অযৌক্তিক, অচল নীতিমালার প্রয়োগই যেন দেশ চালানোর নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সম্বলিত গুটিকয় ধনী ব্যবসায়ীর হাতে কুক্ষিগত হওয়া গণমাধ্যমের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতি।

সংবাদ মাধ্যমগুলোর সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার মানের উপর মালিকানার ধরণ কীভাবে প্ৰভাব ফেলে, তা নির্ধারণে আরও গবেষণা প্রয়োজন। এই গবেষণায় পাওয়া তথ্য-প্রমাণ হুমকির মুখে থাকা বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিষয়ে আরও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতে পারে।●

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর; মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক ইউনিভার্সিটির ষ্ট্রসলার সেন্টার ফর হলোকষ্ট এন্ড জেনোসাইড ষ্টাডিজে পিএইচডি গবেষক। এই প্রবন্ধটি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া এসিস্টেন্সের ব্লগে  ১৫ এপ্রিল প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।

Media ownership in Bangladesh: Why more media outlets does note mean more media freedom

গবেষণা প্রতিবেদন: Who owns the media in Bangladesh?