অস্বাভাবিক আচরণের জন্য রাকার নামে খোলা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ

“নুসরাত শাহরিন রাকার বিরুদ্ধে জাল প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে,” বলেছে বৈশ্বিক গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সিপিজে।

অস্বাভাবিক আচরণের জন্য রাকার নামে খোলা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ
নুসরাত শাহরিন রাকার নামে বানানো ফেসবুক প্রোফাইলের একটি স্ক্রিনশট। ফেসবুকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানা গেছে যে এই প্রোফাইল মূলত “ইনঅথেনটিক” বা জাল। গ্রেফতারের আগেই রাকা নিজ উদ্যোগে পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে তার নাম দিয়ে এই জাল প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। রাকা এ বিষয়ে জিডি করার পাঁচদিন পর এই প্রোফাইলে প্রকাশিত পোস্টের জন্য তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

বাংলাদেশ সরকারের কঠোর সমালোচক বলে পরিচিত সাংবাদিক কনক সরওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকার নামে বানানো একটি অ্যাকাউন্ট মুছে দিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। “অস্বাভাবিক আচরণে”র জন্য ওই অ্যাকাউন্ট মুছে দেয়া হয় বলে একজন ফেসবুক মুখপাত্র নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করেছেন। এই অ্যাকাউন্টের বিভিন্ন পোস্টের কারণে সম্প্রতি রাকা বাংলাদেশে আটক হন।

ফেসবুকের মুখপাত্র নেত্র নিউজকে বলেছেন, “আমরা অস্বাভাবিক আচরণ সংক্রান্ত আমাদের নীতিমালা ভঙ্গের কারণে ওই অ্যাকাউন্টকে মুছে দিয়েছি।” নুসরাত শাহরিন রাকার নামে বানানো ওই অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে নেত্র নিউজের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিক্রিয়া দেন ওই মুখপাত্র। তিনি আরও বলেন, “আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমরা অ্যাক্টিভিস্টদের নিজ নিরাপত্তার ঝুঁকি বা অন্য কোনও ধরণের পরিণতির শঙ্কা ছাড়াই নিজের মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করি। আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে ক্ষতিকর বিষয়বস্তু ও খারাপ ব্যক্তিবিশেষকে সরিয়ে দিতেও আমরা কাজ অব্যাহত রেখেছি।”

ফেসবুকের নীতিমালায় ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ বা ‘ইনঅথেনটিক বিহেইভিয়ার’ বলতে ফেসবুকে অন্য কোনো মানুষের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা, ফেক বা ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা, কৃত্তিমভাবে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

ফেসবুকের এই বিবৃতি নুসরাত শাহরিন রাকার দাবিকেই সমর্থন করছে যে তার নামে বানানো ওই অ্যাকাউন্টটি ছিল ভুয়া। গ্রেপ্তারের পূর্বে রাকা পুলিশের কাছে ওই ভুয়া অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে একটি সাধারণ ডায়েরিও দায়ের করেছিলেন। এখন ফেসবুক কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের পর তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর দায়ের করা মামলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর এশিয়া প্রোগ্রামের সমন্বয়ক স্টিভেন বাটলার এ বিষয়ে নেত্র নিউজকে বলেন, “এখন যেহেতু এটি নিশ্চিত যে নুসরাত শাহরিন রাকার বিরুদ্ধে জাল প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেহেতু বাংলাদেশ সরকারের উচিত সঠিক কাজটি করা। অর্থাৎ, অবিলম্বে রাকার বিরুদ্ধে এই মামলার কার্যক্রম বন্ধ করা এবং তাকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেওয়া।”

১ অক্টোবর, অর্থাৎ গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিন আগে নুসরাত শাহরিন রাকা নিজেই পুলিশকে একটি সাধারণ ডায়েরিতে জানিয়েছিলেন যে, ২৯ সেপ্টেম্বর তার নামে একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, যেখানে সরকারবিরোধী বিভিন্ন পোস্ট প্রচার করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, ওই অ্যাকাউন্টের সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অথচ, চার দিন পর ঠিক ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে “রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নামে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও মানহানিকর তথ্য প্রচারে”র অভিযোগে রাকাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

একজন ম্যাজিস্ট্রেট এই অভিযোগে ৫ দিনের জন্য তার রিম্যান্ড মঞ্জুর করেন। রিম্যান্ড শেষেও তাকে জামিন দেয়নি আদালত, বরং জেল হাজতে পাঠিয়েছে।

রাকার ভাই কনক সরওয়ার একজন ভিন্নমতালম্বী সাংবাদিক, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনে আছেন। তিনি একটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করেন, যেখানে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচকদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তিনি বলেছেন, তার বোন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তার অভিযোগ, তার বোনকে আটক করা হয়েছে “আমার সমালোচনা এবং গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য আমার আন্দোলনকে থামাতে। এসব অত্যন্ত নোংরা।”

এর আগে বৈশ্বিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি নেত্র নিউজকে বলেন, “কনক সরওয়ার বারবার বলেছেন যে তার কাজের সাথে তার বোনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি এ-ও বলেছেন যে, তার বোনের নামে খোলা একটি জাল ফেসবুক পাতা সম্পর্কে তিনি নিজে গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে এসেছিলেন। সেই অভিযোগকে তদন্ত না করে এবং ফেক অ্যাকাউন্ট মূলত কে খুলেছে, তা বের না করে, উল্টো রাকাকেই বন্দী করা হয়েছে। এ থেকে অনেকটাই মনে হচ্ছে যে কর্তৃপক্ষ তাকে টার্গেট করেছে কারণ তারা তার ভাইয়ের কাজকে পছন্দ করছে না।”

রাকার নামে ওই ফেক অ্যাকাউন্ট কে খুলেছে, তার বিস্তারিত ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেনি। তবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুক সমন্বিতভাবে ‘অস্বাভাবিক আচরণে’ সম্পৃক্ত রয়েছে এমন একটি নেটওয়ার্ককে বাংলাদেশে শনাক্ত করে ও প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেয়। তারও দুই বছর আগে ফেসবুক বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত একটি নেটওয়ার্ককে মুছে দেয় যারা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের অ্যাকাউন্ট হস্তগত করতে কাজ করছিল।●