নির্বাচনের আম্পায়ারই যখন পাতানো

নতুন নির্বাচন কমিশন — ফের পাতানো নির্বাচনের লক্ষণ।

নির্বাচনের আম্পায়ারই যখন পাতানো
ঢাকার রাস্তায় নির্বাচনী পোস্টার। ফটো: কিরিন সু/চায়না স্প্যান/আলামি 

সম্প্রতি জারি করা একটি আইনের অধীনে একদল নতুন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করা হয়েছে, যার প্রধান সাবেক জেষ্ঠ্য আমলা কাজি হাবিবুল আওয়াল। আইনটি অনুসারে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনার প্রার্থিদের নাম  সুপারিশ করা হবে। সেখান থেকে বাছাই করে একটি সংক্ষেপিত তালিকা গ্রহণ করবেন সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত সার্চ কমিটি। সবশেষে রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা কমিশনার নিযুক্ত করবেন।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হয়েছে এভাবেই। আগের নিয়মের অধীনে দলীয় আনুগতদের কমিশনার বানানো হতো। এবার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন হলেও দলীয় নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি আওয়ামী লীগের কাছের লোক ছিলেন। এদিকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ঘুরে ফিরে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বাছাই হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের হুকুম মেনে চলা একদল ব্যক্তি।

নতুন কমিশনের পাঁচজন সদস্যের চারজন হলেন সরকারি আমলা। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার চর্চা হয় — এমন দাবি কেউ করতে পারবেন না। রাজনৈতিক প্রভুদের আজ্ঞাবহ থাকাই যে আমলা হবার প্রধান শর্ত সেকথাও সুবিদিত। কাজেই সাধারণ নাগরিকদের মধ্য থেকে কমিশনার না হয়ে যেআমলা-প্রধান কমিশন গঠন হয়েছে, সেটি নিজেই একটি বড় সমস্যা। এতে আর যাই হোক, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হবে তা আশা করার কোনো সুযোগ নেই।

উপরন্তু, বাছাইকৃত কমিশনারদের কয়েকজন যে বর্তমান সরকারের অনুগ্রহ পেয়েছেন তা স্পষ্ট। একজন নব নিযুক্ত কমিশনার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান অবসরে যাবার পর সরকার তাকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের প্রধান বানায়, যেখানে তিনি চার বছর কর্মরত ছিলেন। সেনাবাহিনীর খুব কম কর্মকর্তাই এমন বড় নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এছাড়া নতুন নিযুক্ত সাবেক আমলাদ্বয়, মোঃ আলমগির ও আনিসুর রহমান বিশেষ পদোন্নতি পেয়ে “সিনিয়র সচিব” হয়েছিলেন। সরকারের বিশেষ অনুগ্রহভাজন আমলারাই এই পদোন্নতি পেয়ে থাকেন।  

সার্চ কমিটির কার্যপদ্ধতি আলোচনাকালে যে বিষয়টি বার বার উঠে এসেছিল তা হলো সরকারের অনুগ্রহ পেয়েছেন বা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এমন কোন ব্যক্তিকে যেন কমিশনার হিসেবে সুপারিশ করা না হয়। কিন্তু এ বিষয়টি স্পষ্টতই সম্পূর্ণ  অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

মোঃ আলমগিরের নিয়োগের পেছনে কী বিবেচনা ছিল বলা মুশকিল। আলমগির নিজেই আগের একটি নির্বাচন কমিশনে সিনিয়র সচিব ছিলেন যার সদস্যদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আজ্ঞাবহ থাকার অভিযোগ ছিল।

তবে বেশি চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো, প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাজি হাবিবুল আওয়ালের নিয়োগ। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে যে কোন অগ্রগতি ঘটেনি তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন সম্ভবত এটাই।

২০১৪ থেকে ২০১৭ – এই তিন বছর আওয়াল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান আমলা বা সচিব হিসেবে সরাসরি কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও হাসিনা। হাসিনা সরকারের বহু অনুগ্রহ লাভ করেছেন আমলা আওয়াল। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৫ তে অবসর গ্রহণ করলেও প্রধানন্ত্রীর বিশেষ অনুমোদনে তার মেয়াদ দুইবার বাড়ানো হয়। ফলে তিনি দুই বছর অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান আমলা হিসেবে বহাল থাকেন। নিষ্ঠার সাথে নির্বাচনি নিয়ম কানুন প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য এই ব্যক্তি যে উপযুক্ত নন, তা দিবালোকের মত স্পষ্ট।

হাসিনার একনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার আগে আওয়ালকে ঘিরে ছিল বিতর্ক। তার সরকারি চাকুরী জীবন শুরু হয় মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারি বিচারক নাম পদটির) হিসেবে। আদালত ছেড়ে আমলার কাজ গ্রহণ করেন আওয়াল এবং আইন মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে উন্নীত হন। এই পদোন্নতির ফলে তার পুর্বতন সহকর্মীদের সাথে বিরোধ ঘটে। ২০০৭ সালে যখন তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব হন তখন একজন জেলা জজ তার নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট আওয়ালের নিয়োগ অবৈধ রায় দেন। আপিল বিভাগে এই রায় বহাল থাকে

আওয়ালের বিরুদ্ধে দুই জন জেলা জজকে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ ছাড়াই অপসারণের অভিযোগ রয়েছে। যার জন্য পরবর্তিতে তিনি একটি সংসদীয় কমিটির কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসেস এ্যাসোসিয়েশনের একজন প্রাক্তন নেতা নেত্র নিউজকে বলেন কাজি আওয়াল নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিকল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এসব অনিয়ম সত্ত্বেও ২০১০ সালে তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব হন “বিশেষ বিবেচনায়”। এই “বিশেষ বিবেচনার” সুপারিশ করেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং। বাংলাদেশে পদাধিকার বলে রাষ্ট্রপতি দেশের উচ্চ পর্যায়ের সব সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে ১০% পর্যন্ত প্রার্থী মনোনীত করতে পারেন।

এখন জানা গেছে যে, আওয়ালের নাম প্রস্তাব করেছিল আওয়ামী লীগ জোটের অন্তত দুটি রাজনৈতিক দল। এর হলো তরিকত ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নামও তরিকত ফাউন্ডেশনই সুপারিশ করেছিল। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এসেছে যে দুই ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ জোটের ছোট দলকে ব্যবহার করেছে নিজেদের পছন্দের প্রার্থিকে মনোনীত করার জন্য।  

নতুন নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে একমাত্র সদস্য যিনি আমলা ছিলেন না, তিনি হলেন সাবেক জেলা জজ রাশিদা সুলতানা এমিলি। তার বিষয়ে তেমন জানা যায়নি।  তবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যে অংশ থেকে তিনি এসেছেন তা নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য সুপরিচিত নয়। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া যেমন হবার ছিল তেমনই হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগ এবং মিত্ররাই নতুন নির্বাচন কমিশনকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং এর জোটবদ্ধ দলেরা নতুন কমিশনকে স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে মেনে নেয়নি। এর অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচন হতে পারে না বলেই তারা মনে করছে।    

নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না সম্ভবত বিরোধী দলের অবস্থান সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনাও যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করেন তবে তারও ক্ষমতা নেই এই সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা পরিচালনা করার। 

বিএনপি এবং এর জোটের শরিক দলগুলো বাদে আরও কিছু দল নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায়  অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল। এর মধ্যে আছে বামপন্থী দি কমিউনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশ এবং ডানপন্থী ইসলামি আন্দোলন। তাদের যুক্তি ছিল নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন  সরকার বিষয়ে একটি মীমাংসা প্রয়োজন ছিল।

কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া বয়কট করা থেকে মনে হয়, বিরোধী দলগুলো হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক কোনো প্রস্তাবনা নিয়ে আস্তে পারে। সম্প্রতি, ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনিতিবিদ রেজা কিবরিয়া এবং সাবেক ডাকসু ভাইস প্রেসিডেন্ট নুরুল হকের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরবর্তি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছে।

২০১৮ সালে রেজা কিবরিয়া বিএনপি জোটের একজন প্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের প্রস্তাব তুলে তিনি সম্ভবত এর গ্রহণযোগ্যতা কেমন তা যাচাই করতে চাইছেন। হয়তো এই প্রস্তাব ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। তত্বাবধায়ক পদ্ধতি বিলুপ্ত করার ফলে এখন বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে এবং নূন্যতম স্বাধীন ও সুষ্ঠু  নির্বাচন আয়োজনের জন্য হয়তো জাতিসংঘের উপস্থিতি প্রয়োজন হবে।●

ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।

* প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে, ২৮ ফেব্রয়ারি ২০২২