অপতথ্যে অস্থিরতা: শঙ্কার বৃত্তে বাংলাদেশের হিন্দুরা
গৃহিনী ঝর্না রাণী রাজবংশী। ঢাকার মুগদার বাসিন্দা। বাংলাদেশে চলমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে চরম আতঙ্কে আছেন তিনি। তার মধ্যে সারাক্ষণ ভয় কাজ করছে। যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যাওয়ার ভয় নিয়ে বলছিলেন, “বারডেম হাসপাতালে এবার যখন স্বামীকে নিয়ে গেলাম, তখন হাতে জপমালা নিলাম না, ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। তিলকও দিইনি। জপমালা ও তিলক দেখে যদি কেউ হামলা করে বসে।”
বাংলাদেশি একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু নারীর এ উদ্বেগের জন্ম বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক বাস্তবতা থেকে। শুধু ঝর্না রাণী নন, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখানে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এমন এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন, যেখানে ভয় ও শঙ্কা তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এ ভয় ও শঙ্কার পেছনে যেমন রয়েছে কিছু বাস্তব কারণ তেমনি রয়েছে ব্যাপক অপতথ্যের প্রভাবও। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত হওয়ার পর ভারতীয় গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে মাত্রায় অপতথ্য ছড়িয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের হিন্দুরা। এ ছাড়া গত পাঁচ মাসে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উসকানির শিকার হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনাগুলো সরকারের তরফ থেকে তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানা অনিশ্চয়তাও।
কিছুদিন আগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নাকচ হওয়াকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আদালতে দুর্বৃত্তের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম খুন হন। এরপর সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যদিও সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর তৎপরতার কারণে উল্লেখযোগ্য কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেনি বাংলাদেশে। তবে তার কয়েকদিন পর ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশি কনস্যুলেটে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলা, পতাকা পোড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। সেই মনোভাব কিছুটা সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে আঘাত করছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কেও।
ঝর্না রাণী নেত্র নিউজকে বলেছেন, “আমি চাই দ্রুত এই ভয় দূর হোক। এভাবে ভয় নিয়ে তো বেঁচে থাকা যায় না।”
বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী দেবজ্যোতি বণিক এ সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন “ভারত হিন্দুদের মামার বাড়ি — এমন একটা প্রবাদ এ দেশের কিছু মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত আছে। এই স্টিগমার শিকার আমি নিজেও হয়েছি৷ শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হয়েছি তা নয়, তার আগে স্কুল-কলেজে মুসলমান সহপাঠীদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে ‘তোমাদেরতো ইন্ডিয়ায় অবশ্যই জমি-জমা আছে’, ‘তোমাদেরতো আত্মীয়দের বড় একটা অংশ ভারতে থাকে’, ইত্যাদি। আমরা তো এ ধরনের স্টিগমা চাই না।”
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী পার্থ মজুমদার অভিযোগ তোলেন হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে এখনও ট্যাগের রাজনীতি চলছে, “বিভিন্ন রকম ট্যাগ দেওয়া হয়। আমরা ভারতপ্রেমী, আমরা আওয়ামী লীগ, ইত্যাদি। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সময় অস্বস্তিকর টিটকিরির মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে। জগন্নাথ হলে খাওয়া-দাওয়ার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অন্য হলে খেতে গেলে গরুর মাংস না খাওয়া নিয়ে নানা টিটকিরি শুনতে হয়েছে।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে সবসময় ভোট ব্যাংক হিসেবে দেখা হয় মন্তব্য করেন পার্থ, “আমরা সবসময় দেখে আসছি যে, হিন্দুদের আওয়ামী লীগের লোক বলে মনে করা হয়। আওয়ামী লীগও উপরে উপরে হিন্দুদের সহানুভূতি দেখাতো। অথচ গত ১৫ বছরের শাসনকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি জমি দখল করেছে আওয়ামী লীগের লোকজনই। আওয়ামী লীগের কাছে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ, এটা আওয়ামী লীগ নানাভাবে প্রতিষ্ঠা করলেও সত্যিকার অর্থে আমরা কখনও তাদের কাছে নিরাপদ বোধ করিনি। অন্য দলগুলোও আমাদের ভাবাতে পারেনি যে তাদের কাছে আমরা নিরাপদ। ফলে বর্তমান বা পরবর্তী যে সরকারই আসুক, তাদের কাছে আমরা কতটুকু নিরাপদ থাকব, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।”ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলা, জাতীয় পতাকার অবমাননা, পশ্চিমবঙ্গসহ দেশটির মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। স্লোগান তুলছেন, “দিল্লি না ঢাকা”। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক রীতিমতো বরফশীতল অবস্থায় ঠেকেছে। এ নিয়ে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে অজানা শঙ্কা কাজ করছে, যা পরিস্থিতিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। আশঙ্কা বাড়ছে সহিংসতার।
সহিংসতার শঙ্কা প্রভাব ফেলেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। দোহারের ব্যবসায়ী ধরণী দে কর্মকার বলছিলেন, “একটা আতঙ্ক কাজ করছে। আগে রাত ৮-৯ টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতাম, কিন্তু এখন সাড়ে ৬টা বাজলেই দোকান বন্ধ করে দিতে হয় নিরাপত্তার শঙ্কায়। আগে এলাকায় যে কোন অনুষ্ঠান শুরুর আগে কোরান পাঠের পর গীতা পাঠ হতো, কিন্তু কয়েকদিন আগে বাজারের একটা অনুষ্ঠানে কোরান পাঠের পর গীতা পাঠ শুরু হতেই হইচই শুরু হয়। কেউ কেউ বলে উঠেন, গীতা পাঠের দরকার নেই।”
“আমার যে ছেলে স্কুলে পড়ে, সেও তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিলো। আমরা চেয়েছিলাম বৈষম্যটা দূর হোক,” একটা চাপা ক্ষোভ ধরণীর কথায়।
দেড় বছর আগে দোহারের দাশপাড়া দুর্গা মন্দিরে একটা হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারী গ্রেপ্তার হলেও পরে মানসিক ভারসাম্যহীন ও মাদকাসক্ত সাব্যস্ত হওয়ায় কয়েক মাসের মধ্যে জামিনে বের হয়ে যায়। ধরণী দে বলেন, “সরকারের কাছে দাবি থাকবে, আইন-শৃঙ্খলা যেন ঠিক রাখে।”
একই এলাকার প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকা রেখা পাল জানালেন, তার নিজ এলাকায় কোন হামলা না ঘটলেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও অস্থিরতার খবর শুনে তিনি ও তার পরিবার দুশ্চিন্তায় আছেন। তিনি বলেন, “খবরে শুনি দেশের পরিস্থিতি অন্যরকম। অন্তর্বর্তী সরকার থাকুক বা অন্য যে কোন সরকারই আসুক, আমরা যেন না শুনি আর কোনও মন্দির ভাঙা হয়েছে।”
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর দুর্বৃ্ত্ত শ্রেণির আক্রোশ প্রকাশ যেন অলিখিত এক নিয়ম হয়ে গেছে। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পটপরিবর্তনের সম্ভাবনা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো। এবার ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পরও সে চিত্রের ভিন্নতা হয়নি। বেশ কয়েকটি জেলায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা হিন্দুদের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি করেছে। ফলে ৫ আগস্টের পর ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনেও শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। দোহারের তপন সূত্রধর তাদেরই একজন। তিনি বলেন, “সামনে কিছুদিন পরেই আমাদের বার্ষিক অষ্টপ্রহর লীলা কীর্তন। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি, সেখানে অনুষ্ঠান কতটা করতে পারব সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই, বরং আতঙ্ক কাজ করছে।”
তপন বলেন, “আমাদের এলাকায় আমরা কোন হামলার শিকার হইনি। তবে খবরে যখন শুনি অন্য এলাকায় হামলা হয়েছে, তখন খারাপ লাগে, আতঙ্ক হয়। ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই, জীবনভর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়, আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়, আমরা এটা চাই না।”
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনের এই শঙ্কাকে প্রতি মুহূর্তে আরও উসকে দিচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের অপপ্রচার। অপতথ্য ছড়িয়ে, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরি করে চলেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো।
গত জুলাই মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশে পদদলিত হয়ে নিহত তীর্থযাত্রীর মৃতদেহের ভিডিওকে বাংলাদেশে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হিন্দু নারী হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুরানো হামলার ভিডিও যেগুলোর স্থান-কাল-পাত্র ভিন্ন ছিলো, সেগুলো বিকৃত করে কিংবা ভিন্ন শিরোনাম দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম ও দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা- এএফপি ফ্যাক্ট চেক, বুমবিডি, ডিসমিসল্যাব, ফ্যাক্ট ওয়াচ, রিউমর স্ক্যানারসহ বিভিন্ন সংস্থা এসব মিথ্যা ও মোডিফাইড ভিডিও ও চিত্রের সত্যতা যাচাই করতে কাজ করে যাচ্ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি’র ফ্যাক্ট চেকার কদরউদ্দিন শিশির নেত্র নিউজকে বলেন, “গত কয়েক দশকে ভারতীয় মিডিয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে ভূমিকা পালন করেছে এখন তারা একই কাজ করছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। দেশটির মূলধারা গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ ও ইসলামবিরোধী সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ব্যবহার করছে, যাতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশে হিন্দু-বিরোধী মনোভাব উসকানি পায়। তারা বাংলাদেশে যা ঘটছে তা নিয়ে প্রতিনিয়ত অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করে চলেছে। এর ফল হিসেবে আমরা দেখেছি কিভাবে ভারতে উন্মত্ত হয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশ কনস্যুলেটে হামলা করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে ব্যবহার হওয়া বাংলাদেশের বানোয়াট সংবাদ, ছবি, মিথ্যা তথ্য ও নেতিবাচক প্রচারণা মূলত ওই হিন্দুত্ববাদীদের উসকে দিয়েছিল।”
“বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ও অপতথ্যের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে, না হলে এ ধরনের তৎপরতা এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে ভূমিকা রাখবে” — সর্তক করেন এই ফ্যাক্ট চেকার।
এদিকে, ৫ আগস্টপরবর্তী বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সৃষ্ট পরিস্থিতি এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে ভয়ানক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এমএস কবির জুয়েল নেত্র নিউজকে বলেন, “ভারতের অব্যাহত বিকৃত ও অপতথ্য প্রচার স্পষ্টতই প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনোজগতে। প্রাথমিকভাবে তাদের মধ্যে উদ্বেগজনিত ব্যাধি, প্যানিক ডিসঅর্ডার ও পরবর্তীতে তীব্র স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এবং শেষ ধাপে তারা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ও মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হচ্ছেন।”
বর্তমান অস্থির ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির জন্য এই মুহূর্তে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকরা ভারতের দিকে আঙুল তুলছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্তির একটা চেষ্টা যে এই অঞ্চলে হচ্ছে, তা কখনোই সফল হবে না। যারা বাংলাদেশের মানুষকে ধর্মের নামে বিভক্তির চেষ্টা করছেন তারা এই দেশের সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছেন।”
ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “তারা পতিত ও বিতাড়িত শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিতে গিয়ে এখানে ধর্মকে সামনে এনে বিভক্তির চেষ্টা করছে। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগকে পুর্নবাসনের চেষ্টা করেছে, যেটা বাংলাদেশের মানুষ ব্যর্থ করে দিয়েছে।”
বাংলাদেশে হিন্দু বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে দু’চারটি ছোট-খাট হামলার যে ঘটনা ঘটছে সেগুলো ভারতের অপতথ্য ও বাংলাদেশবিরোধী ক্যাম্পেইনের জন্য হচ্ছে বলে মনে করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। একইসঙ্গে তিনি বলেন, “ছোট-খাট হলেও এসব হামলা গ্রহণযোগ্য নয়।”
পশ্চিমবঙ্গসহ আঞ্চলিক নির্বাচনগুলোতে ফায়দা লুটতে এবং পতিত আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুর্নবাসন করতে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি পরিকল্পিতভাবে অপতথ্যের ক্যাম্পেইন ও ধর্মকে পুঁজি করে বাংলাদেশের জনগণকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তিনি নেত্র নিউজকে বলেন, “অপতথ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ভারত। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তারা এটা করছে। এটার বিষয়ে আমরা অন্তবর্তী সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করছি। এখানে যা ঘটে না, সেটা নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে।”
গোলাম পরওয়ার বলেন, “যেহেতু সামনে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন আছে, সেহেতু এই সময় সাম্প্রদায়িকতার একটা কার্ড বানিয়ে, বাংলাদেশ ইস্যু কাজে লাগিয়ে তারা ওখানে জনপ্রিয় হতে চায়। অপরদিকে বাংলাদেশকে অস্থির করতে চায়।”
“বিজেপি চরম উগ্রবাদী একটা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। তারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তারা তাদের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে ফায়দা লুটতে চাইছে,” যোগ করেন গোলাম পরওয়ার।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিবিড় পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খিস্ট্রান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্মল রোজারিও। তিনি বলেন, “উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাজ নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা দরকার, যাতে অঘটন ঘটার আগেই প্রতিরোধ করা যায়। এ বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি লিডারদের সঙ্গে প্রশাসনের মতবিনিময় বাড়াতে হবে। সেখানে ধর্মীয় নেতা ও তরুণ ছাত্রনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী জ্যোর্তিময় বড়ুয়া মনে করেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে যে ট্রমার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, “তাদের (হিন্দু সম্প্রদায়) মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা আগেও ছিলো, বিভিন্ন সময় মৌলবাদী আক্রমণ এর বড় কারণ। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে হিন্দুদের ওপর অনেক হামলা হয়েছে। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। তারা সান্ত্বনা পাচ্ছেন না। তাদের ভয় কাটছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধে পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে না। গতানুগতিক অস্বীকার করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।”
শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে বা হচ্ছে বলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে তার কোন যুক্তি নেই মনে করেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। বলেন, “এগুলো হলো খোঁড়া যুক্তি।”
সংখ্যালঘু সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সমাধানে সরকার পুরানো পথেই হাঁটছে বলে মনে করছেন এই আইনজীবী। “এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্যোগ হতাশাজনক। সারাদেশে এখনও পুরোদমে আইনশৃংখলা প্রতিষ্ঠা হয়নি। একইসঙ্গে অতীতের মত হামলাকারীকে মানসিক রোগী, মাদকাসক্ত অ্যাখ্যা দেওয়া, দ্রুত সময়ে জামিনে বের হয়ে যাওয়া, কিংবা সাম্প্রদায়িক হামলাকে অস্বীকার করার মতো ক্ষতিকর নজির স্থাপন যেন না হয়, সেদিকে অন্তবর্তী সরকারকে সর্তক থাকতে হবে।”
গত ৫ ডিসেম্বর দেশের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসেন বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে কোন ধরনের আক্রমন, সহিংসতা প্রতিরোধে তার অঙ্গীকার পুর্নব্যক্ত করেন।●