ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলবে?
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণ দাগিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এক পোস্টে, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে “বর্বর সহিংসতা” চলার কথা বলেছেন। তিনি আরও দাবি করেছেন, বাংলাদেশে “চরম অরাজক পরিস্থিতি” বিরাজ করছে। তার এই মন্তব্যকে মার্কিন নির্বাচনী রাজনৈতিক পটভূমির আলোকে দেখতে হবে। ট্রাম্প-পন্থী হিন্দু-আমেরিকান গোষ্ঠীগুলো কৃতিত্ব নিয়ে বলেছে, তাদের প্রচার-প্রচারণা থেকে প্রভাবিত হয়েই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র পাঁচ দিন আগে ট্রাম্প ওই মন্তব্য করেন।
তবুও ট্রাম্পের এই মন্তব্যের সম্ভাব্য নীতিগত প্রভাব উপেক্ষা করা উচিত হবে না। তার এই ধরণের মন্তব্য ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার ভালোভাবে যে গ্রহণ করেনি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ট্রাম্প যদি নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক শুরু হবে টালমাটাল অবস্থায়।সম্প্রতি পুনর্জ্জীবিত হওয়া দুই দেশের আংশীদারিত্বের প্রতি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে ট্রাম্পের বিজয় — এমনটা মনে করার অন্যান্য কারণও রয়েছে। যেই কারণগুলো অনলাইনে ট্রাম্পের পোস্ট করা মন্তব্যের চেয়েও বেশি কিছু।
এই বছর যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেকটা নতুন করে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের পরপর এই নতুন করে যাত্রা শুরুর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণতাপূর্ণ একটি চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে নিজের “আন্তরিক ইচ্ছা” থাকার কথা জানান। অথচ, তার এই চিঠি আসার আগের মাসগুলোতে, অর্থাৎ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে তিক্ততা ও উত্তেজনা ছিল প্রবল। ওই নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবাধ ও সুষ্ঠু নয় বলে আখ্যায়িত করে।
কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে নতুন করে যাত্রা শুরু হয় এই গ্রীষ্মে হাসিনার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন যার ফলশ্রুতিতে মোহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এরপর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুতই বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে “কাজ করতে প্রস্তুত” থাকার কথা জানায়। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মতো ইউনূসও হাসিনার অনুদার ও গণতন্ত্র-বিরোধী রাজনীতির সমালোচক ছিলেন। ওয়াশিংটনের ক্ষমতা বলয়ে তার রয়েছে অসংখ্য বন্ধুও।
আজ হয়তো এই ইউনূস ফ্যাক্টর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের জন্য আশীর্বাদের মতো। কিন্তু ট্রাম্প যদি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় ফেরেন, তাহলে এই ইউনূসই হয়ে উঠবেন এই সম্পর্কের বোঝা। ইউনূস ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়ের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি তখন এই জয়কে “সূর্যগ্রহণে”র সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন এটি যেন “আমাদেরকে বিনষ্ট না করে দেয়। আমাদের প্রাণচাঞ্চল্যকে যেন গ্রাস না করে ফেলে।”
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের ওই জয় ছিল “ভুল ঘরানার রাজনীতির ফসল।” ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেছিলেন, “আপনি যেহেতু এখন প্রেসিডেন্ট, আপনাকে এখন দুনিয়ার দিকে আরও উদার হয়ে তাকাতে হবে, যেন আপনি সেতুবন্ধন রচনা করতে পারেন,” দেয়াল নয়।
ইউনূসের এই উদারনৈতিক রাজনীতি, যার কারণে তিনি বিল ও হিলারি ক্লিনটন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষ অনেক নেতার সমর্থন অর্জন করতে পেরেছিলেন, সেটিও তাকে ট্রাম্পের বিপরীত কাতারে ফেলে দেবে। আদর্শগত দিক থেকে ট্রাম্প ও ইউনূস সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর।
এছাড়াও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের যেই মূল ফোকাস, তা সম্ভবত দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে অতটা আকর্ষণীয় মনে হবে না। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাইডেন প্রশাসন হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও দেশ পুনর্গঠনের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জন্য নতুন করে উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। সুদূরপ্রসারী সংস্কার বাস্তবায়নে ঢাকাকে কারিগরি সহায়তা দেয়ারও প্রস্তাব দিয়েছেন।
কিন্তু ট্রাম্পের পররাষ্ট্র রাজনীতি অনেক বেশি লেনদেন-মূলক। তিনি রাষ্ট্র-গঠনের বিরোধী। তিনি কড়াভাবে বলে আসছেন যে, আংশীদার ও মিত্রদেরকে আরও বেশি খরচ বহন করতে হবে। কাজেই আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে — তাও আবার চুক্তির বাইরে থাকা মিত্ররাষ্ট্র — দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাটাতন মার্কিন সহায়তার ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে ট্রাম্প হয়তো অত উৎসাহিত বোধ করবেন না।
বরং, দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আগের মতো দুইটি ইস্যুতে কেন্দ্র করে এগিয়ে নিতে চাইবেন। এগুলো হলো মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্য। এই দুই ইস্যুই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চালিকাশক্তি ছিল।
ট্রাম্পের শাসনামলেই চীনা শক্তির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এশিয়ায় দেশটির প্রধান নীতি হিসেবে আর্বিভূত হয়। ওই সময় ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিমালা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলপত্রে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামুদ্রিক নিরাপত্তা, জলদস্যুতা নিরোধ থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদ নিরোধ, সামরিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো বিষয়ে ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার উপর আলোকপাত করা হয়েছিল।
তবে ইউনূস যেহেতু এখন ক্ষমতায়, ঢাকা হয়তো বেইজিং-এর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে উৎসাহিত হবে। এ নিয়ে দ্বিধা নেই, হাসিনাও তা-ই করেছিলেন। কিন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে হাসিনার চেয়েও ইউনূস আরও বেশি গভীরে যেতে চাইতে পারেন — কেননা ভারতের সঙ্গে হাসিনার যেমন গভীর আংশীদারিত্ব ছিল, সেটা ইউনূসের নেই। অতএব, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ইউনূস কীভাবে এগিয়ে নেবেন, তা প্রভাবিত করতে নয়াদিল্লীর দৃষ্টিভঙ্গি তিনি অত আমলে নেবেন না। ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় ফিরে চীনের বিষয়ে এসপার-অথবা-ওসপার অবস্থান নিয়ে ফেলেন — যেমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি — তাহলে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যকার অধিকতর ঝঞ্ঝাটবিহীন সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য ভালো কিছু হবে না।
ওদিকে ট্রাম্পের শাসনামলে, মার্কিন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তার শাসনামলের প্রথম তিন বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্যের বার্ষিক আকার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান উৎস। বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কাতারে ছিল আমেরিকান বিভিন্ন কোম্পানি।
কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি এই কয়েক বছরে হোঁচট খেয়েছে। এই বিষয়টি ভবিষ্যৎ মার্কিন-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কে সমস্যাজনক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি বিনিয়োগ — উভয়ই কমেছে।
নিশ্চিতভাবেই, এই সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনাবলী সম্ভাব্য কমলা হ্যারিস প্রশাসনেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। হ্যারিস হোয়াইট হাউজও শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেবে। তবে এগুলো বাংলাদেশের জন্য অতটা সমস্যা করবে না যতটা ট্রাম্পের অধীনে করবে।
এর কারণ হলো, হ্যারিস প্রশাসন বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও সহায়তা প্রদানকে অগ্রাধিকার দেবে, যেটা ট্রাম্পের প্রশাসন দেবে না। হ্যারিস ক্ষমতায় এলে দুই দেশের সহযোগিতা ভূরাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ইস্যুর নেতিবাচক প্রভাবকে ঠেকিয়ে দিতে সহায়ক হবে।
এর মানে এই নয় যে, ট্রাম্প এলেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একেবারে বাজে অবস্থায় পতিত হবে। প্রথমত, ইউনূস নিজেই হয়তো দির্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। ফলে তিনি ট্রাম্পের গুণমুগ্ধ না হলেও, যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন তিনি চাইবেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা যেন অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে, দাতা হিসেবে দেশটির গুরুত্ব থাকার কারণে।
এর মানে হতে পারে যে, ওয়াশিংটনকে কিছু ছাড় দিতে হতে পারে বাংলাদেশের। যেমন, বেইজিং-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ঢাকার ভারসাম্য করার দীর্ঘদিনের নীতিতে প্রভাব পড়বে না — ঢাকার এমন নিশ্চয়তাও এই ছাড়ের অন্তর্ভুক্ত। এই ভারসাম্যের নীতি ২০২৩ সালে হাসিনা সরকারের প্রণীত ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকে প্রতিফলিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের সরকারি নেতৃত্ব ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে যুক্তি দিতে পারে যে, বাংলাদেশ অধিকতর কার্যকর কৌশলগত ও বাণিজ্যগত আংশীদার হতে পারবে যদি দেশটির অর্থনীতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থিতিশীল থাকে। আর এই স্থিতিশীলতার স্বার্থে মার্কিন সহায়তা অনেক কাজে আসবে।
এর বাইরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সঙ্গে আংশিদারিত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে (যদি ওই কর্পোরেশন কংগ্রেসে পুনঃঅনুমোদন পায়)। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অন্যতম অনুষঙ্গ এই কর্পোরেশন। এই বিষয়টি কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। তবে এখানে শর্ত আছে: বাংলাদেশকে আগে নিজের শ্রম অধিকার শক্তিশালী করতে হবে। শ্রম অধিকার ইস্যুতে অগ্রগতি না হলে ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন বিনিয়োগ করবে না।
পরিশেষে, এই মার্কিন নির্বাচনে বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি অনেকভাবে জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিমালা নিয়ে ওই দেশের দুই প্রধান দলের মধ্যেই এক ধরণের ঐক্যমত্য রয়েছে। দুই দলই ক্ষমতায় গেলে একই ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা উভয়ই ভারতের সঙ্গে কৌশলগত আংশিদারিত্ব এগিয়ে নিতে, পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ চালানোর মতো সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে এবং তালিবানের নেতৃত্বে থাকা আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত রাখতে চায়। সামগ্রিকভাবে, উভয়ই এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব নিরোধ করতে চায়।
এক হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতি প্রায় অপরিবর্তিতই থাকবে। তবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই অঞ্চলে বাংলাদেশ খুব অল্প কিছু দেশের একটি, যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে — এবং সম্ভবত নেতিবাচকভাবে — প্রভাবিত হতে পারে।●
মাইকেল কুগেলম্যান যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইন্সটিটিউটের পরিচালক।