নয় হিন্দুর হত্যাকাণ্ডে সাম্প্রদায়িক যোগসূত্র থাকার দাবি বিভ্রান্তিকর
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে “সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা”র কবলে নয় জন হিন্দু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মর্মে ১৯ সেপ্টেম্বর বহুল-আলোচিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। কিন্তু নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই মৃত্যুর ঘটনাগুলোর নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় অভিসন্ধি থাকার কোনো স্পষ্ট লক্ষণ নেই। বরং, নয় জনের মধ্যে সাত জনই রাজনৈতিক সহিংসতা, গণ-সহিংসতা ও বৈষয়িক অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ঐক্য পরিষদ যেসব পত্রিকার খবরের বরাতে এমন দাবি করেছে, সেই খবরেই তাদের দাবির বিপরীতধর্মী বক্তব্য পাওয়া যায়। এমনকি সংগঠনটির স্থানীয় ও আঞ্চলিক নেতারাও কিছু দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
ঐক্য পরিষদের দাবিগুলো যাচাইয়ের লক্ষ্যে নেত্র নিউজ প্রায় ৩০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বন্ধু, সহযোগী ও পরিবারের সদস্য, স্থানীয় সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি ঐক্য পরিষদের আঞ্চলিক সদস্যবৃন্দ। এছাড়া বিভিন্ন দাপ্তরিক নথিপত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট, পূর্বে অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের অসংখ্য প্রতিবেদন যাচাই করেছে নেত্র নিউজ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। সরকার পরিবর্তনের সময়ও এই প্রবণতা অতীতে দেখা গেছে। তবে হাসিনার পতনের আগে ও পরের সহিংসতা ১৬ কোটি মানুষের এই দেশটিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের উপরই প্রভাব ফেলেছে। ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে যেই সময়কালকে বিবেচনা করা হয়েছে — অর্থাৎ ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট — সেই সময়কালে দেড় শতাধিক মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে, যাদের বড় অংশই আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশ সদস্য। এছাড়া পতনের আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপের ফলশ্রুতিতে সাত শতাধিক মানুষ নিহত হন।
সরকারি নথিপত্র ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নেত্র নিউজের করা প্রাক্বলন অনুযায়ী, মোট নিহত প্রায় এক হাজার মানুষের তিন শতাংশ বা তিন ডজনেরও কম সংখ্যক ব্যক্তি ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার আট শতাংশের মতো হিন্দু। ফলে হিন্দুদের নিহত হওয়ার ঘটনাকে আনুপাতিক হারে বেশিও বলা যাবে না। কিন্তু তারপরও ঐক্য পরিষদ সুনির্দিষ্টভাবে নয় জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার মর্মে নথিবদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাসাবাড়ি, ব্যবসা ও জীবন-জীবিকার অবলম্বনকে উদ্দেশ্যে করে হামলার খবর বিশদভাবে এসেছে। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে এসব ঘটনা গভীর আতঙ্কও সৃষ্টি করেছে। তবে এই দফায় সংঘবদ্ধ মুসলিম গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক হামলা বা শারীরিক নৃশংসতার আলামত মিলেছে কম।
সাম্প্রতিক সময়ে ঐক্য পরিষদের বিভিন্ন বক্তব্য দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। নেত্র নিউজের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৬ আগস্ট থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) ১.১ কোটিরও বেশি অনুসারীর সঙ্গে সংস্থাটির বরাতে তথ্য সরবরাহ করেছেন বিভিন্ন ব্যবহারকারী। ১ আগস্ট থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত গুগল নিউজে অন্তত ১৩৩টি ইংরেজি প্রতিবেদনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়টার্স, এসোসিয়েট প্রেস ও আল জাজিরার মতো খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যমও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের কার্যালয়ের দুইজন কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেছেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের কার্যালয়ে ঐক্য পরিষদের কর্মীরা ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা অসংখ্য বার্তা পাঠিয়েছেন। এছাড়াও নিউ ইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ অন্তত একটি স্থানে ডিজিটাল বিলবোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর চালানো ‘হত্যাযজ্ঞ’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে ঐক্য পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগও এসেছে। বাংলাদেশ সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এই প্রতিবেদন থেকে বারবার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। ১৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য রাজা কৃষ্ণমূর্তি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে পাঠানো এক চিঠিতে এই প্রতিবেদনটিকে উদ্ধৃত করেছেন।
নেত্র নিউজের অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশদ বিবরণ সহ মন্তব্যের জন্য একাধিক অনুরোধের পরও ঐক্য পরিষদ কোনো সাড়া দেয়নি।
ঐক্য পরিষদের একজন শীর্ষ নেতা মণীন্দ্র কুমার নাথ, যিনি সংস্থাটির অনুসন্ধানী কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনি নেত্র নিউজকে ১৩৬টি পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি সরবরাহ করেন। সেখানে হয়রানি থেকে শুরু করে হত্যা পর্যন্ত হাজার হাজার হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিবরণ রয়েছে। নেত্র নিউজ ওই প্রতিবেদনে উল্লেখিত সবচেয়ে গুরুতর দাবি, অর্থাৎ নয় জন ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিবেদনে বর্ণিত অন্যান্য হাজারো সহিংস ঘটনার পর্যালোচনা করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনে নিহতদের তালিকায় থাকা তিনজন ব্যক্তি ৪ আগস্ট অর্থাৎ হাসিনার পতনেরও একদিন আগে মারা গেছেন। হাসিনার পতনের দিন মারা গেছে তিন জন। তার সরকারের বিদায়ের পর মারা গেছেন অবশিষ্ট তিন জন। কিন্তু প্রতিবেদনটিকে উপস্থাপন করা হয় হাসিনা সরকারের পতনের পরের সহিংসতার বিবরণ হিসেবে। তথ্য সংগ্রহের সময়কাল ৪ আগস্ট থেকে কেন শুরু হলো, তারও কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
এছাড়াও, প্রতিবেদনটিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা এবং কোনগুলো বৈষয়িক অপরাধমূলক হামলা, রাজনৈতিক হামলা বা গণ-সহিংসতা, তা আলাদা করার কোন পদ্ধতির কথাও উল্লেখ নেই।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনাগুলোর বিষয়ে এই ধরণের ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহারের নজির অতীতেও দেখা গেছে।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ার পর ২০০২ সালে হিন্দুদের উপর হামলার এমন অনেক অভিযোগ প্রকাশিত হয়। অনেকক্ষেত্রেই এই অভিযোগগুলোর সত্যতা ছিল; তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে উল্লেখ করা হয়েছিল, সেই সময় স্বাধীন অনেক মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার কিছু অভিযোগ ছিল ‘অতিরঞ্জিত’ এবং কিছু ক্ষেত্রে ‘সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড’কে সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
যেসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতির সংশ্লেষ রয়েছে
সেপ্টেম্বরে প্রতিবেদন প্রকাশের সময় এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য রঞ্জন কর্মকার জোর দিয়ে বলেন, তাদের হিসাব করা তালিকায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা বাদ দেয়া হয়েছে; শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে। তবে ঠিক কীভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আলাদা করা হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা ১৩৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে নেই।
অথচ নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তালিকায় থাকা অন্তত দুই জনের মৃত্যুর ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লেষ অত্যন্ত প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল।
এদের একজন রিপন চন্দ্র শীল, যিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অর্থাৎ বিএনপির ছাত্র সংগঠনের একজন কর্মী ছিলেন। তিনি হবিগঞ্জে হাসিনা-বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন। বিক্ষোভরত অবস্থায় ৪ আগস্ট তিনি আওয়ামী লীগের কর্মীদের গুলিতে নিহত হন বলে অভিযোগ করেন তার পরিবারের সদস্যরা।
ডেইলি স্টার পত্রিকাকে নিহতের ভাই শিপন শীল বলেন, “আমরা একসঙ্গে বিক্ষোভে গিয়েছিলাম। আমার পায়ে গুলি লাগে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ভাই আর নেই। সে আমাদের দেশের জন্য লড়াই করে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে।” একই কথা নেত্র নিউজকে বলেছেন তাদের বোন চম্পা শীল। এক ভিডিও বার্তায় চম্পা বলেন, “আমার ভাই দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদল করতেছে।” তার মৃত্যুর পর হবিগঞ্জের বিএনপি নেতা জি কে গাউছ পরিবারটিকে সমবেদনা জানান।
কিন্তু ঐক্য পরিষদের বিবরণে রিপনের রাজনৈতিক পরিচয় উহ্য রাখা হয়েছে। তিনি যে বিএনপির কর্মী এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের হাতে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে ব্যাখ্যা করা হয়নি কেন রিপনের মৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শুধুমাত্র রিপনের হিন্দু পরিচয়ের বাইরে, তার পরিবার ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেও তার মৃত্যুর পেছনে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি থাকার কোনো প্রমাণ বা ইঙ্গিত মেলেনি।
রাজনৈতিক সংশ্লেষ রয়েছে এমন আরেকটি ঘটনা হলো হারাধন রায়ের মৃত্যু। তিনিও নিহত হন ৪ আগস্ট। হারাধন ছিলেন রংপুর সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের একজন কাউন্সিলর।
হারাধনের নিহত হওয়ার ঘটনায় তার স্ত্রী কণিকা রানী ২ অক্টোবর পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তার দায়ের করা মামলার এজাহারে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, হারাধন রায় ও ফাত্তা উরফে সবুজ নামে একজন ব্যক্তি সহ আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে ওইদিন প্রায় ৪০০-৫০০ জন “বিক্ষুদ্ধ জনতা”র ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া চলছিল। তিনি লিখেছেন, “আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীগণ পিছু হটলে অজ্ঞাতনামা ৪০০/৫০০ বিক্ষুব্ধ জনতা আমার স্বামী - হারাধন রায় হারা ও ফাত্তা সবুজকে বেতপট্টি চারমাথা মোড়ে পেয়ে ... শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এলোপাথাড়ি পিটিয়ে ও কুপিয়ে ... নৃশংসভাবে হত্যা করে।” ওই বিবরণের কোথাও এই হত্যার সঙ্গে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক কোনো সংশ্লেষ থাকার বর্ণনা নেই।
ওই দিন রংপুরে ওই একই ঘটনায় অন্তত চার জন ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। হারাধন বাদে বাকি তিন জন ছিলেন মুসলমান। হারাধন রায়কে হিন্দু হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে হামলার কোনো বর্ণনা বা বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না। ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়নি।
ওই ঘটনার পরপরই ঐক্য পরিষদের স্থানীয় নেতারাসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওই সম্মেলনে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মন্দিরে হামলার খবরকে জোর গলায় গুজব হিসেবে উড়িয়ে দেন। এছাড়া ওই দিন চার জন নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে তারা বলেন, প্রত্যেকের নিহত হওয়ার খবর নিন্দনীয় হলেও ওই ঘটনায় কোনো সাম্প্রদায়িক আলামত ছিল না।
ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন এমন দুই জন হিন্দু নেতার সঙ্গে কথা বলেছে নেত্র নিউজ। তারা জানিয়েছেন, তারা তাদের বক্তব্যে অটল আছেন; তবে সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান তারা।
ওই ঘটনার সূত্র হিসেবে নিজেদের সংগঠনের নাম উল্লেখ করেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। তবে রংপুরে সংগঠনটির একজন শীর্ষ নেতা নেত্র নিউজকে বলেছেন, তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানিয়েছিলেন হারাধণ রায়ের মৃত্যু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড; সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষসূচক নয়।
ঠিক কী কারণে নিজেদের আঞ্চলিক নেতাদের পর্যালোচনা আমলে নেয়নি ঐক্য পরিষদ, তা স্পষ্ট নয়।
অপরাধমূলক খুন
ঐক্য পরিষদের “কিলিং ইন্সিডেন্ট” বা “খুনের ঘটনাসমূহ” শীর্ষক তালিকায় শুরুতেই রয়েছে টিঙ্কু রঞ্জন সাহার নাম। সংগঠনটি এই ঘটনার সূত্র হিসেবে ‘প্রেস নারায়ণগঞ্জ’ নামে একটি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের নাম উল্লেখ করেছে। কিন্তু ‘প্রেস নারায়ণগঞ্জ’-এর খবর অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের এই হোসিয়ারি ব্যবসায়ীর এই মৃত্যু আদৌ খুনই নয়।
সংবাদে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন স্থানীয় দুর্বৃত্ত তার কাছ থেকে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিয়েছেন। ৭ই আগস্ট ওই হুমকি দেয়ার পর তার স্ট্রোক হয়। এরপর চার দিন পর ঢাকার একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
চাঁদা চেয়ে হুমকির কারণেই তার স্ট্রোক হয়েছিল কিনা — এটি নিরূপণ করা রীতিমতো অসম্ভব। এছাড়া শুধু টিঙ্কু রঞ্জন সাহাই নন; নারায়ণগঞ্জের ওই এলাকায় অন্যান্য হোসিয়ারি ব্যবসায়ীর কাছেও চাঁদা চাওয়া হয়েছিল।
বদিউজ্জামান বদু এই ব্যবসায়ীদের একজন নেতা। তিনি নেত্র নিউজকে বলেন, টিঙ্কু রঞ্জন সাহার পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তার যোগাযোগ হয়েছে। তার ভাষ্য, “ঐ সময় সবার কাছেই চাঁদা চাইছে।” এই চাঁদা দাবির হাত থেকে মুসলিম ব্যবসায়ীরাও রেহাই পায়নি। এই কারণে বিষয়টি নিয়ে পুরো ব্যবসায়ী সমাজেই ক্ষোভ নেমে আসে। অনেকেই টিঙ্কু রঞ্জন সাহার মৃত্যুতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নামেন।
স্থানীয় কাউন্সিলর অসিত বরুণ বিশ্বাস নিজেও একজন হিন্দু। তার সভাপতিত্বেও একটি প্রতিবাদ সভা আয়োজন করেন ব্যবসায়ীরা। অসিত বরুণ বিশ্বাস নেত্র নিউজকে বলেন, “কে নাকি তার কাছে থ্রেট করছিল। পরবর্তীতে সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এরপর তারে হাসপাতালে নিছিল।”
টিঙ্কু রঞ্জন সাহার ছোটো ভাই রিঙ্কু নিজেও ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি চাঁদাবাজদের বিচার চান। বক্তব্য রাখেন বহু মুসলিম ব্যবসায়ীও। এছাড়া ‘প্রেস নারায়ণগঞ্জ’-এর খবরেও প্রণব রায় নামে আরেকজন হিন্দু ব্যবসায়ীও এই ঘটনায় চাঁদাবাজদের দায়ী করেন।
নেত্র নিউজ-এর সাক্ষাৎকার ও অনুসন্ধান থেকে এই ঘটনায় কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িক সংশ্লেষ থাকার প্রমাণ বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
১৮ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে মেঘনা নদীতে লাশ পাওয়া যায় সুশান্ত সরকার নামে এক যুবকের। এই হত্যাকাণ্ডের সূত্র হিসেবে ঐক্য পরিষদ কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করেছে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে এই ঘটনার নেপথ্যে কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িক যোগসূত্র থাকার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই রাতে সুশান্ত সরকারকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় আশিক নামে এক ব্যক্তি। পরের দিন মেঘনা নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়। হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে কালের কণ্ঠে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে পাওনা টাকা নিয়ে বিরোধের কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে।
স্থানীয় একটি পত্রিকায় আশিকের পুরো নাম আশিক মিঞা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিষয়ে সরাসরি সুশান্ত সরকারের মা রুপালি সরকারের সঙ্গে কথা হয় নেত্র নিউজের একজন প্রতিবেদকের। রুপালি সরকার এই ঘটনার কোনো ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সংশ্লেষ থাকার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান, সুশান্ত ও আশিক বরং পরস্পরের বন্ধু ছিলেন।
রুপালির বক্তব্য অনুযায়ী, আশিক তার ছেলের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকায় একটি মোটরসাইকেল কিনেছিলেন; কিন্তু পাওনা টাকা ঠিকঠাক পরিশোধ করেননি। যখন সুশান্ত টাকা চেয়ে চাপাচাপি করেন, তখন আশিক একদিন তাকে ফোনে হুমকি দেন। রুপালি বলেন, “আমি বললাম আশিক বাবা, আমার পুতে তোমার কাছে হোন্ডাটা বেঁচছে, তুমি টাকা দাও বা না দাও, যেই সময় পারো সেই সময় দিও। কিন্তু তোমরা দোনো জনে টাকা লইয়া কোন ঝগড়া বিবাদ কইরো না।”
“তোরা তিরিশ হাজার টাকার জন্য আমার পুতেরে মারলি সবাই মিল্যা,” বলেন রুপালি।
তার এই বিবরণ কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদন সহ আরও অন্তত ১০টি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে অন্যান্য স্বাক্ষীর বয়ানে উঠে এসেছে।
রুপালি আরও দাবি করেন, আশিক স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। এই দাবি নেত্র নিউজ স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি। উত্তরাধিকার৭১ নামে একটি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে তাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে। রুপালি সরকার পরবর্তীতে আশিক সহ ছয় জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
পরিবারের সদস্যরা সহ স্থানীয় এলাকার লোকজন সুশান্ত হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা, যা থেকে ইঙ্গিত মিলে যে তারাও আশিককে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে করেন।
ওই সমাবেশে বক্তাদের বক্তব্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায় স্থানীয় অনেককেই আশিককে চাঁদাবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই খুনের ঘটনায় পুলিশ তিন ব্যক্তিকে আটক করেছে।
৮ আগস্ট খুলনার পাইকগাছায় বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে মারা যান স্বপন বিশ্বাস। তিনি স্থানীয় দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক সদস্য। তার শরীরে হাতুড়ির আঘাতের মতো ক্ষতস্থান দেখতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ওই সময়কার উত্তাল পরিস্থিতিতে পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্তও করেনি; লাশের ময়নাতদন্তও হয়নি। পরের দিনই লাশের সৎকার করে ফেলে পরিবার।
দেলুটি একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। ওই এলাকার স্থানীয় একজন হিন্দু জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখন রাতের বেলায় তো, নীরব এলাকা, কে বা করা এগুলা করছে, কেউ তো দেখে নাই।”
তিনি সহ তিন জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিক নেত্র নিউজকে দুইটি সম্ভাব্য কারণের কথা উল্লেখ করেন। একটি হলো স্থানীয় চিংড়ির ঘের নিয়ে দ্বন্দ্ব; আরেকটি হলো স্থানীয় একটি বাজারের দোকানের জমি নিয়ে বিবাদ। কালের কণ্ঠের একটি প্রতিবেদনে স্থানীয়দের বরাতে একই রকম একটি বিবরণ এসেছে।
সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর লাগোয়া দেলুটিতে মাছ ও চিংড়ির ঘের নিয়ে সংঘাতের লম্বা ইতিহাস আছে। নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক খামারিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন করুণাময়ী সর্দার, যিনি পরে খুন হন। তার নিহত হওয়ার দিনটি এখনও স্মারক হিসেবে পালন করেন এমন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন স্বপন নিজেও।
পাইকগাছা উপজেলায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তৃপ্তি রঞ্জন সেনের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হয় নেত্র নিউজের। তিনি বলেন, স্বপন বিশ্বাস আদৌ খুন হয়েছিলেন কিনা, সেটিও স্পষ্ট নয়; তাকে কী কারণে বা কারা খুন করেছিল, তা আরও দূরের বিষয়।
তার ভাষ্য, “কেউ বলছে যে বাজার থেকে বাসার দিকে যেতে ছিল, পিছন থেকে হাতুড়ির ঘা দিয়ে মেরে ফেলছে। কেউ বলছে যে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে, হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে।”
পেশায় একজন সাংবাদিক তৃপ্তি রঞ্জন সেন আরও বলেন স্বপনের মৃত্যু নিয়ে অনিশ্চিয়তা থাকার বিষয়টি তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানিয়েছিলেন। এ-ও বলেছিলেন যে, তার মৃত্যুর কারণ নিয়েই তারা সংশয়ে আছেন। ফলে এই মৃত্যুর পেছনে কোনো সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় সংশ্লেষ থাকার কোনো লক্ষণ তিনি দেখতে পাননি।
গণ-সহিংসতা
সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক রয়েছেন ঐক্য পরিষদের তালিকার পাঁচ নম্বরে। তিনি নিহত হন ৪ আগস্ট। ওই দিন সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে একই ঘটনায় ছয় জন মানুষ নিহত হন। এদের একজন প্রদীপ; বাকি পাঁচ জনই মুসলিম।
যখন একই ঘটনায় আরও পাঁচ জন মুসলমান মারা গেছেন, তখন ঠিক কী কারণে প্রদীপের হত্যাকাণ্ড সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধিমূলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা ঐক্য পরিষদ দেয়নি। এই ঘটনায় ঐক্য পরিষদ নিজস্ব অনুসন্ধানকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছিল।
রায়গঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম এইচ মোনায়েম খানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় নেত্র নিউজের। মোনায়েম খান নিজেই ওইদিন প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে প্রদীপ কুমার ভৌমিকের সঙ্গে ছিলেন এবং গুরুতর আহত হয়ে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি যতক্ষণ ছিলাম প্রদীপ দাও ততক্ষণ ছিলেন প্রেসক্লাবের ভিতরে।”
তিনি বলেন, প্রেস ক্লাবের পাশেই ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়। আর কার্যালয়ের বাইরে অনেকগুলো মোটরসাইকেল রাখা ছিল। কেউ একজন এই মোটরসাইকেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। “যখন আগুন দাউ দাউ করে ভেতরে ঢোকা শুরু করছে, তখন আমি ভাবছি যে পুড়ে মরার চাইতে, যা হয় ভাগ্যে আমি বাইরে যাব।”
তখন মোনায়েম খান কয়েকজন সহকর্মী সহ জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অপেক্ষমান লোকজন তাদেরকে ধরে ফেলেন এবং ব্যপক মারপিট করেন। মারপিটের কবলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান মোনায়েম। তিনি মরে গেছেন ভেবে দুর্বৃত্তরা চলে যায়।
অপরদিকে প্রদীপ কুমার ভৌমিক জানালা দিয়ে লাফ দিতে চাননি। বরং, তিনি সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যান। সেখানেও অপেক্ষায় ছিল একদল “উত্তেজিত জনতা”, যারা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেন।
ঠিক কী কারণে প্রেস ক্লাবে আক্রমণ হয়েছে তার সুস্পষ্ট কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মোনায়েম খান বলেছেন, ওইদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হচ্ছিল। এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগের লোকজন। অনেকেই তখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে প্রেস ক্লাবে প্রবেশ করে; ফলে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় প্রেস ক্লাবও।
“আমাদের প্রেসক্লাবের ভিতরে কিছু আওয়ামী লীগের লোকজন ঢুকে পড়েছিল। এইটা তাদের (আন্দোলনকারীদের) বাড়তি একটা ক্ষোভ ছিল,” বলেন তিনি। ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ওই সময় কে হিন্দু, আর কে মুসলমান, তা যাচাই করে আক্রমণ হয়নি। “যারা বের হইছে [ক্লাব থেকে] তাদেরকেই টার্গট করে [হামলা] করছে,” বলেন তিনি।
শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার আগের কয়েকদিন থেকেই পুলিশের উপর ব্যাপক আক্রমণ বাড়ছিল, কেননা এর আগে শত শত বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে। ১৮ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মোট ৪৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার কথা জানানো হয়। নেত্র নিউজের কাছে থাকা সরকারি তালিকা অনুযায়ী, এদের মধ্যে ছয় জন ছাড়া সবাই মুসলিম।
নিহতদের একজন হলেন উপ-পরিদর্শক সন্তোষ চৌধুরী। হবিগঞ্জের বনিয়াচং পুলিশ স্টেশনে কর্মরত এই হিন্দু কর্মকর্তার মৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার তালিকায় রেখেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার কয়েক ঘটা পরই ওই থানার চারপাশ ঘেরাও করে একদল বিক্ষোভকারী। তাদের দাবি, ওই পুলিশ স্টেশন থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে, যার দরুন বেশ একজন শিশু সহ তিন জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিলেন। হাজার হাজার মানুষের থানা ঘেরাওয়ের ফলে সৃষ্ট এক উত্তেজক পরিস্থিতিয়ে নিহত হন সন্তোষ।
সন্তোষের মৃত্যুর সূত্র হিসেবে দেশ রূপান্তর পত্রিকার প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করেছে ঐক্য পরিষদ। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে কোনো ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সংশ্লেষ থাকার কথা বলা হয়নি।
নেত্র নিউজ ওই ঘটনায় তিন জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এদের মধ্যে দুই জন সাংবাদিক। তাদের প্রত্যেকেই এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িক ইন্ধন বা অভিসন্ধি থাকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন।
ওই দিনের ঘটনায় ২২ আগস্ট একটি মামলা দায়ের করেন সন্তোষের সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তা আবু হানিফ। নেত্র নিউজের হাতে আসা মামলার পাঁচ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এজাহারে ওই দিনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এজাহার অনুযায়ী ওইদিন আট থেকে দশ হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করতে এসেছিলেন। পর্যায়ক্রমে সন্তোষ সহ মোট সাত জন পুলিশ কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী এসে তাদেরকে উদ্ধার করে।
লোকজনের গণপিটুনির কারণে গুরুতর হতাহত হওয়া পুলিশ সদস্যদের নাম ও ঘটনার বিবরণ এজাহারে দেয়া হয়েছে। এদের সাত জনের মধ্যে পাঁচ জনই মুসলিম: উপ-পরিদর্শক রুহুল আমিন, হুমায়ুন কবির, মাহমুদুল হাসান; সহকারী উপ-পরিদর্শক মহসিন মিজি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম।
এজাহারে বলা হয়েছে সেনাবাহিনী এসে জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করে এবং থানায় আটকা পড়া মোট দশ জন পুলিশ সদস্যকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এর মধ্যে একটি পক্ষ সন্তোষ চৌধুরীকে ছিনিয়ে নেয়। সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধারের আগেই তিনি মারা যান।
প্রথম আলো পত্রিকা ওই ঘটনার বিশদ সংবাদ প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর কাছে উত্তেজিত লোকজনের কেউ কেউ আগেই সন্তোষ চৌধুরী ও হায়দারুজ্জামান খান নামে একজন মুসলিম আওয়ামী লীগ নেতাকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। সেনাবাহিনী তখন এই দাবি মানতে রাজি হয়নি। নেত্র নিউজ স্বতন্ত্রভাবে এই তথ্য যাচাই করতে পারেনি। কিন্তু এই দাবি থেকেও ইঙ্গিত মেলে যে, হিন্দু-মুসলিম যাকেই এক শিশু সহ তিন জন নিহত হওয়ার জন্য লোকজন দায়ী ভাবছিল, তাদের উপরই তাদের ক্ষোভ ছিল।
তবে প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনের সাংবাদিক হাফিজুর রহমান নেত্র নিউজকে জানান, স্থানীয় অনেকে সন্তোষের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষ করে ভুয়া মাদক বিষয়ক মামলা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতিরিক্ত সখ্যতা থাকার কারণে তিনি কুখ্যাত ছিলেন। “সন্তোষ এলাকাতে একটা সার্কেল তৈরি করছিল, এলাকার আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ এদেরকে নিয়ে। এলাকায় সে ছাত্রলীগের পোলাপান যারে বলতো তারে ধরে নিয়ে আসতো, তাদের নির্যাতন করতো।” এই কারণে কারো কারো তার প্রতি বিশেষ ক্ষোভ থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
দৈনিক খোয়াই নামে হবিগঞ্জের স্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিক বদরুল আলমও একই অভিমত দেন।
অস্পষ্ট ও মিশ্র প্রেক্ষাপট
৫ আগস্ট ময়মনসিংহের ফুলপুরে স্থানীয় একজন রাজনৈতিক নেতার অনুসারীদের হাতে গুম বা নিহত হন অজিত সরকার। অজিত সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন স্বাক্ষী ছিলেন। যেই রাজনৈতিক নেতার অনুসারীরা আক্রমণ করেছিলেন, তার পিতার বিরুদ্ধে অজিত সরকার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ বা মাননবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে স্বাক্ষ্য দিয়েছিলেন। এই স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বতন্ত্রভাবে নেত্র নিউজ নিশ্চিত করতে পারেনি; তাই তার নাম ও পরিচয় এই প্রতিবেদনে উহ্য রাখা হলো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সবচেয়ে পরিচিত নেতা রানাদাশ গুপ্ত নিজেও এই ট্রাইব্যুনালের একজন কৌঁসুলি ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে যারাই আসামী, অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই বিএনপি ও জামায়াতে-ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এদের কয়েকজন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন এবং ওই দণ্ড বাস্তবায়নও হয়েছিল
নেত্র নিউজের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেন অজিত সরকারের স্ত্রী পূর্ণিমা রানি। তিনি বলেন, হাসিনার পতনের খবর পাওয়ার পরই একদল লোক ওই গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে আক্রমণ শুরু করে। “সাড়ে চারটার দিকের ঘটনা এইটা। বাড়িতে হামলা করছে, ভাঙচুর করছে [...] এক পর্যায়ে আমার স্বামীর মাথা ফাডায়ে দিছে।”
আশেপাশে হামলা শুরু হতে দেখে বাড়ির ভেতরে একটি কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন পূর্ণিমা রানি, তার স্বামী ও সন্তানরা। কিন্তু মানুষজনের সংখ্যা বড় হতে দেখে অজিত পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পাশের একজনের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি ওই লোকজনের হাতে ধরা পড়েন। এরপর ঠিক কারা তাকে নিয়ে যায়, তা বলতে পারেননি পূর্ণিমা।
ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে নিজেদেরকেই সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, অজিতকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিক, নিহতের স্ত্রী পূর্ণিমা ও ঐক্য পরিষদের ছাত্র শাখার স্থানীয় এক কর্মী নেত্র নিউজকে জানিয়েছেন, অজিতের মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি। পূর্ণিমা রানি জানান, “পরে মানুষে বলতেছে শুনলাম তারে মাইরা গাঙে ভাসায়ে দিছে, এইসব শুনলাম আর কি।” প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল, তা জানা যায়নি।
তবে তার জীবিত থাকার সম্ভাবনা কম। স্থানীয় একজন সাংবাদিক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, “অজিতকে ওইদিন যারা মেরেছিল, তারা বলেছে, সে নদী সাতরে উপারে চলে গেছে।” কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব অজিত সাতরে নদী পার হয়ে যাবেন, তা ওই সাংবাদিকের বিশ্বাস হয়নি।
অজিত সরকারের অন্তর্ধান বা নিহতের ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লেষ থাকার ঝুঁকিই বেশি। তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের স্বাক্ষী হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতিও ছিল। এছাড়া ওই সময় অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতেও হামলা হয়েছে, যেমনটা পূর্ণিমা রানি বর্ণনা করছিলেন।
তার অন্তর্ধান বা মৃত্যুর ঘটনায় কোনো সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় অভিসন্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে যেহেতু তাকে উদ্দেশ্য করে জেনেশুনেই হামলা হয়েছে, এটিও সম্ভব যে তার হিন্দু পরিচয়ের কারণে হামলাকারীরা সাহস পেয়েছে।
নেত্র নিউজের সঙ্গে এই ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক নেতৃবৃন্দ ও অজিত সরকারের অন্যান্য স্বজনের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারাও এই ঘটনায় রাজনৈতিক ও ট্রাইব্যুনাল-সংক্রান্ত বিবাদ থেকে প্রতিশোধ-জনিত হামলা হওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছেন।
কিন্তু এদের কেউই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
সর্বোপরি, যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাজনৈতিক আলামত ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট, তবুও এই ঘটনার কারণে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যপক স্পর্শকাতরতা ও ভীতি সৃষ্টি হওয়ায়, এই ঘটনাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে আখ্যা দেয়া থেকে বিরত থাকছে নেত্র নিউজ।
৫ই আগস্ট বাগেরহাটে নিহত হন সত্তরোর্ধ্ব সাবেক স্কুল শিক্ষক মৃণাল কান্তি চ্যাটার্জি। তার বাড়িতে হামলা করে তাকে পেটানো হলে তিনি মারা যান। প্রথম আলো সহ একাধিক পত্রিকার প্রতিবেদনে তার স্ত্রী শেফালি চ্যাটার্জি ও মেয়ে ঝুমা রানি চ্যাটার্জিকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তারা উভয়েই তাদের প্রতিবেশী হুমায়ুন শেখ ও নুরুল ইসলাম নামে দুই ব্যক্তিকে দায়ী করেছেন।
চ্যাটার্জি পরিবারের সঙ্গে তাদের ওই প্রতিবেশীদের দীর্ঘদিনের জমি সংক্রান্ত বিবাদ ছিল। এই সংক্রান্ত একটি মামলা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। নেত্র নিউজ ওই ঘটনার দুইটি ফেসবুক ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা যায়, শেফালি একদল সংখ্যালঘু অধিকার কর্মীর কাছে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে মৃণাল কান্তির হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হওয়ার বিবরণ দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ওইদিন সন্ধ্যায় “লোকজন আসছে, একজন হচ্ছে পাশের বাড়ির নূরুল ইসলাম নাম [...] আমার জমি নিয়ে তাগো সাথে মামলা।” তিনি আরও বলেন, “হুমায়ুনের ছোট ভাই মিরাজ কয়, ঐ ওটারে মার্ডার কর। এই জমি আমাদের মামলা জিতা লাগবে না আর।” তিনি আরও বলেন, ওই সময় অন্যান্য প্রতিবেশীরা এসে তাদেরকে রক্ষা করেন। কিন্তু ওই রাতেই হামলাকারীরা আবার এসে হামলা করেন। ওই হামলায় মৃণাল কান্তি মারা যান; শেফালি ও ঝুমা রানি গুরুতরভাবে আহত হন।
বাংলাদেশে জমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং বিরোধ থেকে সহিংসতা অত্যন্ত নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ২০২০ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৩.৫ কোটি পরিবারের ১৭ শতাংশ বা প্রায় ষাট লাখ পরিবারেই জমি নিয়ে বিরোধ আছে। সাবেক একজন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, বাংলাদেশের ৪০ লাখ দেওয়ানি মামলার ৬০ শতাংশই ভূমি সংক্রান্ত। এই ভূমি বিরোধ প্রায়ই সংঘাত ও হানাহানিতে রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অবজারভেটরি’র হিসাবে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ২০,৪৬৬ টি হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হয়েছিল। এগুলোর প্রতি ১৭টির একটি ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত। অর্থাৎ গড়ে ২০০ জন মানুষ প্রতি বছর ভূমি বিরোধের কারণে নিহত হয়েছেন।
তবে বাংলাদেশে হিন্দুদের জমি দখলের চেষ্টারও বহু নজির রয়েছে। মৃণাল কান্তি চ্যাটার্জির হত্যাকাণ্ডে কোনো রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক কোনো সংশ্লেষ পায়নি নেত্র নিউজ। তবে এমনটাও অসম্ভব নয় যে হাসিনা সরকারের পতনের পর হামলাকারীরা তার উপর হামলা করার সাহস পেয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এই হামলার ঘটনায় জনি শেখ নামে একজন আসামীকে আটক করেছে। অন্য দুইজন অভিযুক্ত হুমায়ুন শেখ ও নুরুল ইসলাম এখনও পলাতক।●
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন সুরাইয়া সুলতানা, সুবিনয় মুস্তফী ইরন এবং পিয়াস সরকার।)
(গণ-সহিংসতা অংশের ১৭ তম অনুচ্ছেদ স্পষ্টতার স্বার্থে ভূতাপেক্ষ যোগ করা হয়েছে।)