সর্বত্র কেবল মৃত্যু

প্রথম মৃত্যুটি যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য।

একদল সশস্ত্র পুলিশের সামনে নির্ভীক, সটান বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছেন একাই। প্রথম গুলিটি হয়তো ভুল ছিল। রিকয়েলের ধাক্কায় শ্যুটারের হেলমেট পড়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় গুলি। মরণগুলি। লক্ষ্যবস্তুতে ছোঁয় ঠিকঠাক। শহীদ আবু সাঈদের নাম জানা হয়ে যায় সবার। কিন্তু কেউ জানে না তার ঘাতকের নাম।

দ্বিতীয় মৃত্যুটি দেখে মনে হবে মোবাইল গেমের কোনো দৃশ্য। ওপর থেকে দেখা যায় একটি পুলিশ ভ্যান দু’ জন রিকশাচালককে চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছে। মৃতের নাম কেউ জানে না। না জানে কেউ হত্যাকারীর নাম।

তৃতীয় যে মৃত্যুটি ভাইরাল হয় সেটির দৃশ্যেও আছে গাড়ি। ছাদের ওপর লাশ রেখে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সাঁজোয়া যান। একই গাড়ির আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়: নিতান্তই বিরক্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা ওই ছাত্রের নিথর দেহটি ছাদ থেকে ফেলে দিচ্ছে।

এই মৃত্যুগুলো আপনি দেখতে পেরেছেন। এই বিপ্লবের প্রতীক এই নাটকীয় মুহূর্তগুলো ঠিক একেবারে ঘটনা ঘটার মুহূর্তেই ধারণ করা হয়েছে — যা করা যায় হয়তো কয়েক লাখে একবার। তবে আরো মৃত্যু আছে, যেগুলোর কথা কেবল শোনা যায়, দেখা যায় না; যেসব মৃত্যুর দৃশ্য হয়তো ধারণ করা হয়নি কিন্তু কোনো অংশেই কম মর্মস্পর্শী নয়। 

শিক্ষার্থীদের সাহসিকতা, ত্যাগ ও বুদ্ধিমত্তার অসাধারণ সব নজির গড়ার দৃশ্য। কিন্তু একই সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় তাদের খুন হওয়ার দৃশ্য। এইসব মৃত্যুর কথা আপনি হয়তো কোথাও পড়েছেন: কীভাবে ছাত্ররা নিখোঁজ হলো, কী কী ছিল তাদের স্বপ্ন, স্বজনদের সঙ্গে বাচ্চা ছেলেদের হাসিখুশির সব ছবি — অর্থাৎ দৈনন্দিন ছাপোষা যাপিত জীবনের মুহূর্তগুলো, যেগুলো উল্কার মতো বয়ে নিয়ে যায় একটি বিপ্লবকে। 

তারপর আছে মৃত্যু যেগুলোর কথা আপনি শুনেছেন কারও কাছ থেকে। এই মৃত্যুগুলো রহস্যময় আবার একান্ত জীবনের অংশ: আপনার বন্ধুর প্রতিবেশী মাথায় গুলি খেয়েছে; আপনার প্রতিবেশীর বন্ধু বাড়ি ফেরেনি। আপনি হয়তো এদের কাউকে কাউকে চিনতেনও। তাদের লাজুক হাসি, বাদামী রঙের টি-শার্ট কিংবা ঝাঁঝালো সুগন্ধির ঘ্রাণ হয়তো আপনার পরিচিত। আপনি তখন ভাবেন, “ওহ আচ্ছা — এই সেই মানুষটা। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আশা করি তাঁর মৃত্যুটা প্রলম্বিত, কষ্টদায়ক হয়নি।”

কিন্তু এই মৃত্যুগুলোর বেশিরভাগই ভাইরাল হয় না। তাই মায়ের বুকফাটা কান্নার দৃশ্য, সম্ভাবনাময় কুঁড়ির অকালে ঝরে পড়া, উজ্জ্বল ভবিষ্যত মুহূর্তেই মাটিতে মিশে যাওয়ার দৃশ্য ওভাবে আপনার মনে গেঁথে যায় না। পাড়াপ্রতিবেশীর দাওয়াতে দেখা হওয়ার মতো একজন মানুষ কমে গেলো মাত্র। 

খবর এবং গুজব পাখির মতো ওড়ে। তবে যেই গুজবটি বারবার ঘুরেফিরে আসছে সেটি হলো, হাসপাতাল ভরে গেছে মৃতদেহে। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কারণ তাদেরকে রাখার মতো জায়গা নেই। যেদিকেই আপনি তাকাবেন, দেখবেন কেবল মৃত্যু। আপনার শোনা প্রতিটি গল্পের সঙ্গে মিশে আছে মৃত্যুর রঙ। একজন মানুষ হিসেবে কিংবা সামগ্রিকভাবে সমাজ হিসেবে আপনি এত মৃত্যু আর সইতে পারছেন না। এত এত নিখোঁজ! মানুষ আগেও নিখোঁজ হয়েছে বৈকি। নব্বইয়ের দশকে কিংবা একাত্তরে। কিন্তু তখন অন্তত তাদের ছবি কিংবা তাদের ম্লান হয়ে যাওয়া জীবন প্রতিদিন এতবার করে আছড়ে এসে পড়তো না আপনার সামনে। 

আপনার চাক্ষুষ করা শেষ মৃত্যুটি ধারণ হয়েছে বারান্দা থেকে শ্যুট করা ফুটেজে। 

বাড়ির নিচের রাস্তায় ইউনিফর্মধারী আধাসামরিক বাহিনীর একদল সদস্য বাড়ির গেট থেকে তরতাজা এক যুবককে টেনেহিঁচড়ে বের করছে। গুলি চালানো হচ্ছে। অবশেষে দেহটি টেনে বের করা হচ্ছে। এই মৃত্যু আকস্মিক তবে অজ্ঞাত — মর্মস্পর্শী তবে অতিসাধারণ। 


আপনি একজন ব্যক্তিকে মারা যেতে দেখছেন। অত্যন্ত ব্যক্তিগত মানবীয় পরিণতির সাক্ষী আপনি। কিন্তু আপনি জানেন তারা রয়ে যাবে নামহীন ঠিক যেভাবে নামহীন রয়ে যাবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা যারা তাদের খুন করেছিল; কোনো পরোয়া-বোধ ছাড়াই। গুলির শব্দ আর তার ঠিক পরপর ধপ করে মাটিতে লাশের পড়ে যাওয়ার শব্দ — মনে হবে কেউ যেন কোনো বোতাম টিপে খেলনা বন্ধ করে ফেলেছে। 

ওদিকে আরেক বোতামে চাপ পড়লো কারো। সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট থেকে আপনি বিচ্ছিন্ন। এক মিনিট আগেও আপনি ছিলেন মানবতার এক বিশাল সমষ্টির অংশ। আপনার আঙ্গুলের ডগায় ছিল জ্ঞান, বিনোদন, সংবাদ ও বন্ধুত্ব। কিন্তু এখন আপনি দূরবর্তী কোনো কক্ষপথের একটি গ্রহের মতো নিঃস্ব। আপনার চিৎকার এখন কারো কাছে পৌঁছায় না। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কুখ্যাত একটি নিদর্শন হলো পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফারমান আলীর একটি ডায়েরি। যেখানে বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করা ছিল — অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা। 

আজ সেই একই ক্যাম্পাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে আরো উন্নততর, আরো বিশদ ও সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরির সরঞ্জাম রয়েছে। সেই সরঞ্জাম যেগুলো কিনা আমেরিকান সরকার বানিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে শহুরে যুদ্ধ চালানোর জন্য, বিদেশী সরকারের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে। একই সরঞ্জাম আজ ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত ছিল এমন মোবাইল ফোন শনাক্ত করতে। এরপর সেসকল ফোনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া পোস্ট, এমনকি ক্ষেত্রেবিশেষে ব্যক্তিপরিচয় ও তাদের ঠিকানার যোগসূত্র খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে। 


আপনি প্রথম মৃত্যু, অর্থাৎ আবু সাঈদের কথা ভাবুন। 

তিনি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। একদল ভীরু কাপুরুষ বন্দুকধারীর সামনে একা নিরস্ত্র হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু আপনি যদি নিজের চোখে গুলির আঘাতে কেঁপে উঠা বুকের দৃশ্য না দেখতেন, তাহলে কি আপনার কাছে তিনি বীর বলে বিবেচিত হতেন? 

যদি না দেখতেন কীভাবে তিনি শার্ট খুলে তাঁর দুই বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন — এই আশায় হয়তো যে লাঠি আর পাথর এসে গায়ে লাগবে, হাড়গোড় ভেঙ্গে যাবে; কিন্তু এসে পড়লো বুলেট যার আঘাতে তাঁর মৃত্যু হলো। এবার আপনি অন্য মৃত্যুগুলোর কথা ভাবুন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা একের পর এক পোস্ট যেখানে ঘোষণা করা হচ্ছে একের পর এক মৃতের নাম; কিংবা ভাবুন সেই মেয়েটির কথা — মার খেয়ে রক্তাক্ত হওয়ার পর যে কেবল কাঁদছিল। সবার সামনে দিবালোকেই ঘটনাগুলো ঘটেছে। 

যখন কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বলে, “আজকে যদি বের হন, ডাইরেক্ট গুলি করবো,” সে জানে যে তার ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু তার কোনো পরোয়া নেই — কারণ সে জানে তার কিছুই হবে না। 

বিক্ষোভকারীদের গা মাড়িয়ে চলে যাওয়া গাড়ি, লুকিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ ফটকের মধ্য দিয়ে চালানো পুলিশ স্নাইপারের গুলি, আবাসিক এলাকায় মানুষের মাথায় লাগা গুলির ক্ষত। দিনের বেলায় এই শহর বাঘের মতো মতো ঘুমায় — নির্দিষ্ট বিরতিতে ছোঁড়া গুলি আর চিৎকারের নীরবতার শিথানে। রাতে হেলিকপ্টার থেকে ছুঁড়ে মারা বিষাক্ত ধোঁয়ায় আর্দ্র হয়ে থাকে এই জঙ্গল। সারা বিশ্ব আর একে-অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। এই শহরের বুকে জ্বলন্ত আগুন: মাটিতে গুলি আর টিয়ারগ্যাস, আর আকাশ থেকে ছোঁড়া বিষ; গুম, অত্যাচার আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন লাশ। প্রথম দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল, কিন্তু এখন ওই নগণ্য সুরক্ষাটুকুও আর নেই — আমাদের পালাতে সাহায্য করো, রক্ত দান করো, কেউ কি আমার বোনকে দেখেছো?


ছায়ার আড়ালে মৃত্যু আরো ঘনিয়ে আসে। গত সপ্তাহেও মৃত্যু ছিল উজ্জ্বল শিখার মতো — প্রতিটি মৃত্যু ছিল হতবাক করার মতো। এখন মৃত্যু সর্বত্র, আপনার চারপাশে, আপনার চেনাজানা সকলকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করে ফেলেছে। ফিসফাস শব্দে সকলকেই ছুঁয়ে গেছে মৃত্যু। আপনি জানেন না আপনার পরিবার কোথায়। আপনি জানেন না আপনার কাছের মানুষজন কেমন আছে। আপনি জানেন না আদৌ তারা বেঁচে আছে কিনা। আপনার পরিবারও তেমনি জানে না, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। বিদেশে আপনার আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব বিরতিহীনভাবে আপনাকে জানাতে থাকে, কোন নতুন নতুন উপায়ে দেশে থাকা কাউকে ফোনে পাওয়া যাবে। সরাসরি কল করো। অমুক অ্যাপ দিয়ে চেষ্টা করো।  +৮৮ এর বদলে ০১১৮৮ ডায়াল করে দেখো। কিন্তু শুনশান নীরবতা কাটে না। 

আপনাকে বলা হয়, বাসার সবাইকে বলতে যে দরজা খোলা যাবে না। কখনই ভালো খবর আসে না। কিন্তু এখন অনেক রাত। আপনার কোনো ছোট চাচাতো ভাই দরজায় হাঁক শুনে অভ্যাসবশত দরজা খুলে দেয়। কোনো কিছু না ভেবেই আপনি হয়তো বাইরে গেলেন দেখতে যে কী হচ্ছে। গলায় মেকি জোর এনে খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘কী চায় ওরা?’ কিন্তু তারা আপনার চোখের ভয় দেখতে পায়। তারা জানে।

কয়েক দশক পর আপনার গল্প হবে এমন অনেক গল্পের একটি। যেই রাতে সরকার বাংলাদেশীদের খুন করেছিল — সেই কালরাত্রিকে স্মরণ করে গানে গানে লেখা হবে আপনার গল্পও। কিন্তু আজ আপনি সাহায্য চাইতে পারবেন না। আপনি আজ বাঘের করাল থাবা। আপনি একটি জ্বরাক্রান্ত ঘুমের ঘোর। আপনি স্রেফ একটি পরিসংখ্যান। আজ আপনি অস্তিত্বহীন।

আরাফাত কাজী বাংলাদেশের একজন সঙ্গীত শিল্পী।