দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে সংস্কার কি আদৌ সম্ভব?
জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শুরুটা হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে। অনেকেই একে কোটা বিরোধী আন্দোলন বলছেন, আসলে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য ছিল সংস্কার করা, কোটা বাতিল করা নয়। আদালতের রায়ে যে সংস্কার হলো, তাতে নারী কোটা তুলে দেয়া হয়েছে, যা আসলে কাম্য ছিল না। যে কোটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল, সেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল তো হয়ইনি, বরং অনুপাতে বেড়ে গেছে। ৫৬% এর মধ্যে ৩০% কোটার তুলনায় ৭% এর মধ্যে ৫% একটু বেশিই। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সকল সম্মান বজায় রেখেও বলা যায়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারীদের জন্য সুবিধা করে দেয়া এই কোটা সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতি কোন গৌরব বয়ে আনে না। আসল মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই কোটা তো নিতে চানই না, এমনকি ভাতা পর্যন্ত নেন না। অন্যদিকে, সার্টিফিকেটধারী নকল মুক্তিযোদ্ধাদের বংশানুক্রমিকভাবে সুবিধা নেওয়ার ঘটনা কম ঘটেনি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেক নারী শিক্ষার্থীর মতে নারী কোটার প্রয়োজন নেই। কিন্তু খতিয়ে দেখলে এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা নেই বললেই চলে। কোটার অর্থ হলো পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য ইতিবাচক বৈষম্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী সুবিধাবঞ্চিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশই। উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে না হলেও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে হামেশাই কন্যাসন্তানদের শিক্ষাখাতে পুত্রসন্তানের তুলনায় কম বরাদ্দ থাকে। এমনকি খাদ্য বণ্টনেও বৈষম্য দেখতে পাওয়া যায়। মাত্র কয়েক দশক আগেও মিনা-রাজু কার্টুনের মাধ্যমে কন্যাশিশুর খাদ্য আর শিক্ষার মতন মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য ক্যাম্পেইন চালানো হতো। দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, সংসদে নারী স্পিকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন বলে সাধারণ নারীদের জীবনযাত্রার মান এমন কিছু উন্নত হয়ে যায়নি। সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি একেবারেই।
আন্দোলন পরবর্তী সময়ে একজন নারী আন্দোলনকারীর কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে একজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে উচ্চস্বরে তর্ক করছেন সেই নারী শিক্ষার্থী। তর্কের বিষয়, একজন চিহ্নিত নারী নির্যাতনকারীর ব্যাপারে প্রশাসন কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটি। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এই মেয়েটির বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাহসী বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু সামরিক ব্যক্তির সঙ্গে উচ্চবাচ্যের পর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আর ট্রোলের বন্যায় ভেসে যেতে থাকলো ফেইসবুক। মেয়েটির চিৎকারের বিপরীতে অফিসারের ধৈর্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন সকলেই। পরবর্তীতে সেনাপ্রধানের কাছ থেকে বিশেষ প্রশংসাও পেলেন সেই অফিসার। মেয়েটি নিজের “অতিপ্রতিক্রিয়া”র জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইলেও তাকে নিয়ে ট্রোলিং থামেনি।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় দুটি।
এক, যে মেয়ের উচ্চকণ্ঠ আন্দোলনের সময় প্রশংসা পাচ্ছে, নারী নির্যাতন ইস্যুতে তার প্রতিবাদ এবং চিৎকার অধিকাংশ মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। তার ব্যবহৃত ভাষার ভুল ধরা হচ্ছে, তার পোশাক কিংবা ব্যক্তিজীবনের অভ্যাস ইত্যাদি নিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি স্লাটশেইমিং, ঠিক সেটিরই শিকার হয়েছেন সেই সাহসী নারী শিক্ষার্থীটি।
দুই, অফিসারের ধৈর্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে গিয়ে মূল ইস্যুটি ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। একজন নারী নির্যাতনকারীকে মব ট্রায়ালে ফেলে পেটানো উচিৎ নয় — এই কথার সঙ্গে একমত হয়েও আমি বলতে চাই যে, আর্মি অফিসারের সঙ্গে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে মেয়েটি চিৎকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেটা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এদেশে সেনাবাহিনীর দ্বারা খুন আর ধর্ষণের ঘটনা কম ঘটেনি। শুধু পাহাড়েই নয়, সমতলেও সাধারণ নারী সেনা সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন। হিজাবে মস্তক আবৃত সেই নারীর নাম ছিল তনু। নারী নির্যাতনের ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে সেনাসদস্যের গাফিলতি কিংবা কালক্ষেপণের ফলে ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করা অনুচিত হতে পারে, অস্বাভাবিক নয়। তবু সেই নারী শিক্ষার্থীকে অহেতুক ট্রোলিংয়ের শিকার হতে হলো। এতে করে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়ই বের হয়ে আসে।
শুধুমাত্র অল্পবয়সী নারীদের ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের সমাজের স্লাটশেইমিং কালচার বয়স্ক নারীকেও ছাড় দেয় না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গৃহবন্দী ছিলেন বহুদিন। অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী সরকারের পতন হলে তিনি মুক্তি পান এবং তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি ভিডিও বার্তা ধারণ করেন। ভিডিওটি প্রকাশিত হবার পরেই সামাজিক মাধ্যমে তার মেকআপ, তার ভ্রু ইত্যাদি নিয়ে হাস্যরসের তুবড়ি ছোটাতে থাকে সকলেই। একজন মৃত্যুপথযাত্রী বয়স্ক নারী, যিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার প্রতি এহেন অসংবেদনশীল আচরণ সমাজের সকল স্তরের নারীবিদ্বেষের প্রকাশ।
খালেদা জিয়াকে স্লাটশেইমিং করেছেন এমনকি সদ্য পতিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা নিজেও। সংসদে দাঁড়িয়ে কিংবা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে আসা খালেদা জিয়াকে ঘরে তুলতে চাননি, তাই খালেদা জিয়া শেখ মুজিবের কাছে ধর্না দিতেন। যে বীরাঙ্গনা খেতাবটি তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানেরই দেওয়া, সেই বীরাঙ্গনা পরিচয় দিয়েই খালেদা জিয়াকে স্লাটশেইমিং করতে চেয়েছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। এমনকি মোসাদ্দেক হোসেন ফালুকে জড়িয়ে জনসমক্ষে তামাশা করতেও বাধেনি তার। পদত্যাগের পর তাকে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জড়িয়ে বিভিন্ন আদিরসাত্মক কার্টুন আর মিম বের হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও তার বয়স এখন ছিয়াত্তর বছর।
নারীবিদ্বেষী জোক, মিম, কার্টুন ইত্যাদির ভোক্তা শুধু পুরুষরা নন, নারীরাও। অনেক অল্পবয়সী মেয়ে খালেদা জিয়ার মতন সাজপোশাক আর উঁচুতে আঁকা ভ্রু নিয়ে রিলস বানিয়ে ফেইসবুক আর টিকটকে শেয়ার করেছেন। এই হাসিতামাশার মধ্যে অসংবেদনশীল অংশটি তাদের চোখে পড়েনি। একইভাবে গণভবন লুটপাটের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বাস নিয়ে উল্লাসের সময় তোলা ছবি শেয়ার করার সময় এতে আপত্তিকর কিছুই দেখতে পাননি অনেকেই।
নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকল স্তরের জনগণ যে নারীর প্রতি অসম্মানজনক এইসকল ফাজলামিতে আমোদ পাচ্ছেন তার কারণ আমরা বাস করি একটি নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতিতে। শেখ হাসিনার মতন ক্ষমতায় আসীন নারীরাও অন্য নারীকে যথেচ্ছা স্লাটশেইমিং করেন। মতের মিল না হলে নারীবাদীরাও একে অপরকে ইচ্ছেমতো বিউটিশেইমিং, ফ্যাটশেইমিং, স্লাটশেইমিং আর ব্যক্তি আক্রমণ করে থাকেন। এতে করে পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজের বড় অংশ কিছুই মনে করে না। দিনের পর দিন চলতে থাকা এই সংস্কৃতি নারীর প্রতি অসম্মানকে এতটাই সহজ আর স্বাভাবিক করে ফেলেছে যে এখন এসব ব্যাপার নিয়ে কোন কথা শুনতেও কেউ রাজি নয়।
আমরা কোটা সংস্কারের পর রাষ্ট্র সংস্কারের আলাপ উঠতে দেখলাম। এই রাষ্ট্রে এখনও পর্যন্ত নারীদের অধিকাংশই পিতামাতার সম্পত্তিতে ভাগ পান না। সন্তানের কাস্টডি থেকে শুরু করে বিবাহবিচ্ছেদ পরবর্তী ভরণপোষণ এমনকি মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি পর্যন্ত অনেক নারীই পান না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত থেকে শুরু করে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের শিকার। তারপরেও যদি ধরে নেওয়া হয় নারীকে আলাদা করে রিজার্ভেশন বা পজিটিভ ডিস্ক্রিমিনেশনের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই তাহলে আমার মনে হয় বৈষম্য ব্যাপারটা আসলে কী তা নিয়ে আরো গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।
একজন নারীকে জন্মের পর থেকে শুরু করে পরিবারে, সমাজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে প্রতি পদে পদে পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ খেটে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। জেন-জি দের মধ্যে যারা নারী তারা হয়তো কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে গেলে গ্লাস সিলিং কীভাবে নারীকে উপরে উঠতে বাধা দেয়, ঘরে বাইরে দ্বিগুণ সাংসারিক দায়িত্ব কীভাবে কেরিয়ারকে পেছনে টেনে ধরে তা বুঝতে পারবেন। কোটা সংস্কারের নামে নারী কোটা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি যে স্বাগত জানাবার মতন নয় সেটি হয়তো তখন তারা অনুধাবন করতে পারবেন। কিছু গুরুত্বপূর্ন পদে নারীর উপস্থিতি যে সার্বিকভাবে নারীসমাজের অগ্রযাত্রার পরিচায়ক নয় সে কথা আমলে আনা খুব জরুরি। একই সঙ্গে দরকার নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
নারীবাদী হিসেবে আমাদের চাওয়া সমাজের পুরুষাধিপত্য ভেঙ্গে, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে নারীর জন্য মানুষের সম্মান প্রতিষ্ঠা করা। পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যাসন্তানের অধিকার নিশ্চিত করাসহ পথেঘাটে নারীর অবাধ যাতায়াত নিরাপদ করতে পারলে হয়তো সামনে কখনো এমন দিন আসবে যখন নারী কোটার প্রয়োজন আসলেই থাকবে না।●
উম্মে ফারহানা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক।