সময় ফুরিয়ে এসেছে শেখ হাসিনার

শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো জনসম্মুখে দেওয়া দু’টি ভাষণ।

প্রথমটি ছিলো একটি সংবাদ সম্মেলনে তিন মিনিটের একটি উত্তর। আর দ্বিতীয়টি ছিলো জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া দেয়া সাত মিনিটের একটি ভাষণ। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি বসে ছিলেন একটি বইয়ের তাকের, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা কিছু বইপত্র ব্যতীত বেশি কিছু ছিল না — তাও আবার তারই প্রতিকৃতির নিচে। 

আওয়ামী লীগের ভাগ্যে এখন যা-ই লেখা থাকুক না কেন, স্বৈরাচার-এ-আযম শেখ হাসিনার ক্ষমতার আয়ু ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে। একে ঔদ্ধত্য বলি কিংবা ভ্রান্তি বলি — টানা পনেরো বছর ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালিয়ে যেই অহং জন্মেছিল তার মধ্যে, সেই অহংবোধ থেকেই শেখ হাসিনা জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে অবমাননা ও অসম্মান করার দিকে পরিচালিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তিনি নিশ্চিত করলেন যে, এই জাতির ভবিষ্যতে তার কোনো ঠাঁই হবে না।

নিজের প্রথম বক্তব্যে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের “রাজাদারের বংশধরের” সঙ্গে তুলনা দিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসভাবে দমন করার সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সশস্ত্র ছাত্রলীগ ক্যাডাররা যেভাবে কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত করেছে, তা তাদের প্রতিবাদকে স্তিমিত তো করতে পারেইনি; উল্টো তাদের আন্দোলনকে বিপ্লবে পরিণত করেছে। 

আর দ্বিতীয় দফায় যখন কালো শাড়ি পরে চেহারায় মেকি ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা ভাষণ দিলেন, তখন তার এতিম হওয়া বা স্বজন হারানোর বেদনা শোনার মতো ধৈর্য্য কিংবা তাকে দেওয়ার মতো সহানুভূতি — কোনোটিই এবার জনগণের ছিল না। আর এটাই সেই মুহূর্ত যেই মুহূর্তে বাংলাদেশের টুঁটিতে আওয়ামী লীগের পরিয়ে রাখা ফাঁস ছুটে গেল।

এত দীর্ঘ সময় ধরে যখন একজন প্রধানমন্ত্রী তার জনগণকে সেবা করার বদলে শাসন করার পথে হাঁটেন, তখন তিনি হয়তো উপলব্ধিও করতে পারেন না যে, অত্যাচার সহ্য করারও একটা সীমা থাকে। 

আর যখন একটি সরকার ও রাজনৈতিক দল রাজদরবারের চাটুকারের ভূমিকা অবলম্বন করে, তখন মানুষকে তারা যেসব মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত, সেই মিথ্যা তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতে শুরু করে। সময়ে-সময়ে সত্য মনে করিয়ে দিতে হয়, সেই সামর্থ্যও তারা হারিয়ে ফেলে। 


স্বৈরাচার হতে চেয়ে হাসিনা সফল হয়েছেন — এই কৃতিত্ব তাকে দেওয়াই যায়। কেননা তার পূর্বে যারা এসেছেন, তারা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই সাফল্য হাসিনা পেয়েছেন সামরিক বাহিনী ও সুশীল সমাজকে ভোঁতা বানিয়ে, টাকাওয়ালা গোষ্ঠীকে নিজের কব্জায় এনে, বিরোধী দলগুলোকে অকার্যকর করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের পরতে পরতে অনুগতদের বসিয়ে আর ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই এবার তার গদি টিকিয়ে রাখতে পারবে না।

যতক্ষণ পর্যন্ত হাসিনা এই আন্দোলন নিয়ে কিছু বলেননি এবং তার অনুচররা সেই অনুযায়ী কাজ করা শুরু করেনি, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি ছিল নিতান্তই একটি সাধারণ শান্তিপূর্ণ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু হাসিনার ফরমান আসা মাত্রই ইতিমধ্যেই দুর্নীতি, ক্ষয়িষ্ণু মানবাধিকার, দুর্বল আইনের শাসন ও ন্যুনতম শিষ্টাচারের অভাবে বিকল হয়ে পড়া আমাদের দেশটি অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে।

এর পর যে এত মৃত্যু ও ধ্বংস বয়ে গেলো বাংলাদেশের উপর, যার কারণে ধুঁকতে থাকা দেশটি একেবারে স্থবির হয়ে গেল — এর দায় কোনোভাবেই হাসিনা এড়াতে পারবেন না। নির্লজ্জ্বের মতো দেশ পরিচালনা ও সম্পূর্ণ নিজ দোষে একটা গভীর সংকটের মুখে দেশকে ঠেলে দেওয়ার জন্য কোনোভাবেই বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে দায়ী না করে থাকতে পারবে না। একটি জঙ্গি-সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরিণাম থেকে ছাত্রলীগ কোনোভাবেই রেহাই পাবে না।

এরা সবাই এতদিন ছিল নিষ্ঠুর, বেপরোয়া ও দুর্নীতিবাজ। এবার তাদের নির্মম নির্বুদ্ধিতা ও অদক্ষতাও দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়েছে। 

অর্থাৎ সহিংসতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই — এই ভেবে সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার সকল পথই হারিয়ে ফেলেছে। 

তাদের নজিরবিহীন মাত্রার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাংলাদেশের জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে পারেনি — মাথা নত করা তো আরও পরের কথা। এটিও একটি লক্ষণ যে দেশ শাসনের ন্যুনতম ম্যান্ডেটও আওয়ামী লীগের আর নেই।

এখন সবাই যা আশা করতে পারে তা হলো, জনগণের ম্যান্ডেট রয়েছে এমন একটি বেসামরিক সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হোক। নতুন করে কোনো রক্তপাতের প্রয়োজন নেই। হাসিনা ও তার সাগরেদরের হাতে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট রক্তের ছাপ লেগে আছে।●