প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: ৫ আগস্টের রক্তস্নাত যাত্রাবাড়ী
২০২৪-এর ৫ আগস্ট, সকাল। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পালানোর গুঞ্জন বাতাসে ভাসছে। তার পদত্যাগের দাবিতে সাধারণ মানুষ গণভবন অভিমুখে মিছিল নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাত্রাবাড়ী মোড়ের চারপাশে জড়ো হচ্ছে ছাত্র-জনতা। তাদেরই একজন করিমুল ইসলাম। যাত্রাবাড়ীর একটি মহল্লায় দোকান কর্মচারি হিসেবে কাজ করেন।
দুপুর ২ টার আগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে করিমুলকে পালাতে দেখা যায়, আর তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে দেখা যায় পুলিশকে। গুলিতে আহত করিমুল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। প্রায় দুই মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি। পুলিশের ছোঁড়া বুলেটের আঘাতেই তিনি মারা যান। স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যাত্রাবাড়ীতে ওই দিন পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ৩০ জনের বেশি প্রাণহানি হয়েছিল, তবে মৃতদেহের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রাণ হারানো সবশেষ ব্যক্তিটি করিমুল।
করিমুল যখন প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিলেন, একই সময়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাখাওয়াত, যাত্রাবাড়ী থানার দোতলার হাজতখানায় বন্দি। হাজতখানাটি ছিল একটি অস্ত্রাগারের সামনে। সাখাওয়াত দেখেছেন, সেদিন কী কী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল পুলিশ।
বলছিলেন, “সবগুলা ছিল চাইনিজ রাইফেল। এছাড়া কতগুলা ছিল রাবার বুলেটের জন্য যে ইউজ করে সেগুলা। আর কিছু কিছু রাইফেল আমি চিনিও না, ঠিক একে ফোর্টি সেভেনের মত লাগতেছিল আর কি।”
৫ আগস্টের ভয়াবহ দিনটিতে যাত্রাবাড়ী থানার হাজতখানায় থাকা ২২ বন্দির মধ্যে সাখাওয়াত একজন। অক্টোবরের শুরুতে তিনি নেত্র নিউজের সাথে কথা বলেন এবং থানার ভেতর যা দেখেছিলেন তা বর্ণনা করেন। তার বক্তব্য নেত্র নিউজ যাচাই করেছে। সাখাওয়াতের বর্ণনায় উঠে আসে যাত্রাবাড়ী মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়ার সময় সেখানকার থানার ভেতরে যা ঘটেছিল।
হাজত দর্শন
১৮ জুলাই, সাখাওয়াত প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। সেদিন হাসিনা প্রশাসন বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালায় এবং তাদের উপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। পুলিশ-র্যাবের গুলির মুখেও সাখাওয়াতসহ বিক্ষোভকারীরা পরবর্তী দুই দিন বাড্ডা এবং প্রগতি সরণি এলাকায় প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। পরে সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে এবং "শুট-অ্যাট-সাইট" আদেশ দিয়ে কারফিউ ঘোষণা করলে সাখাওয়াত তাঁর গ্রামের বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, “আমি তো, মানে তিন তারিখেই আমার খুব আফসোস লাগতেছিল যে আমার সব ফ্রেন্ড আন্দোলনে, কিন্তু আমাকে তো ফ্যামিলি থেকে, মানে, স্ট্রিক্টলি [না করে দিছে]। আঠারো তারিখ তো আমাকে আমার ফ্যামিলি ঘুমের ওষুধ পর্যন্ত খাওয়াইছিল যাতে আমি আন্দোলনে না যাই।”
এরপর ৩ আগস্ট যখন হাসিনার পদত্যাগের এক দফার ঘোষণা আসে তখন তিনি যাত্রীবাহী ফেরিতে চড়েন, পরের দিন ঢাকায় আসেন এবং ডেমরায় তাঁর চাচির বাড়িতে উঠেন।
“সবাই মিলে চিন্তা করলাম যে কাছাকাছি যারা আছে, মানে এই রিজিয়নে যারা আছে, আমরা চিন্তা করতেছিলাম যে সবাই মিলে আমরা গুলিস্তানে একত্রিত হবো এগারোটার আগে। সেইখান থেকে আমরা আর কি গণভবনের দিকে যাবো,” সাখাওয়াত বলেন।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় যখন পুলিশ তাকে ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে আটক করে যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে যায়। “তখন আর কি আমি শনির আখড়ার ভিতর থেকে যাচ্ছিলাম। তখন দুইজন এসে আমাকে শনির আখড়ার ভিতর থেকে ধরে নিয়ে যায়। বলছে আর কি আমার ফোন চেক করবে। বলছে যে আপনাকে থানায় নিয়ে যাব, ফোনটা চেক করে আপনাকে ছেড়ে দিব।”
থানায় পৌঁছানোর পর, সাখাওয়াতকে তল্লাশি করা হয়, তার মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়া হয় এবং গালিগালাজ করে হাজতে আটকে রাখে পুলিশ।
তিনি হাজতের সেলটিকে লোহার গ্রিল এবং নেট দিয়ে ঘেরা একটি ছোট অন্ধকার ঘর হিসাবে বর্ণনা করছিলেন, যার মাঝখানে একটি খোলা টয়লেট রয়েছে।
বলেন, “ছোট একটা রুম, সেইখানে আমরা বাইশজন ছিলাম। একজনের গায়ের উপর আরেকজন ছিলাম। যেইখানে দুই-তিন থাকতেই সাফার করা লাগে।”
তাঁর মতে, লক-আপে থাকা বেশিরভাগ লোক স্থানীয় মাদ্রাসার, সম্ভবত হেফাজতে ইসলামের কর্মী এবং তাদের মধ্যে অন্তত একজনকে আগের রাতে এতটা নির্যাতন করা হয়েছিল যে, তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং শুয়ে ছিলেন মেঝেতে। “বলছিল যে রাত্রে বেলা আবার টর্চার করা হবে আমাদের।”-- যোগ করেন সাখাওয়াত।
রক্তস্নাত যাত্রাবাড়ী
দুপুর নাগাদ যাত্রাবাড়ীতে মোতায়েন করা পুলিশ আশেপাশের লোকজনের ওপর হামলা চালায়। এর আগে তারা নিজেদের মারণাস্ত্রে সজ্জিত করে এবং তাদের সমস্ত অস্ত্র পুনরায় বুলেটভর্তি (লোড) করে নেয়। সাখাওয়াতসহ কারাগারের ভেতরে থাকা অন্য বন্দিরা এ সবকিছুর প্রত্যক্ষদর্শী।
“আমাদের চোখের সামনে আর কি অস্ত্রাগার ছিল। সেইখান থেকে পুলিশ ধাপে ধাপে এসে [অস্ত্র] নিচ্ছিল। সবগুলা ছিল চাইনিজ রাইফেল। এছাড়া কতগুলা ছিল রাবার বুলেটের জন্য যে ইউজ করে সেগুলা। আর কিছু কিছু রাইফেল আমি চিনিও না, ঠিক একে ফোর্টি সেভেনের মত লাগতেছিল আর কি।” সাখাওয়াত বর্ণনা করেন।
চাইনিজ টাইপ ৫৬ রাইফেলগুলো একে-৪৭ রাইফেলের মতো। বাংলাদেশের পুলিশ ব্যাপকভাবে এ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। নেত্র নিউজ সাখাওয়াতকে টাইপ ৫৬ সেমি-অটোমেটিক রাইফেলের কিছু ছবি দেখালে তিনি সেগুলোকে তার দেখা যাত্রাবাড়ী থানার অস্ত্রের মতো বলে নিশ্চিত করেন।
সাখাওয়াতের মতে, সেদিন যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ চীনা রাইফেলে যে গুলি লোড করছিল তা দুই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা ছিল। তার বর্ণনাটি দশমিক ৬২×৩৯ মিলিমিটার বুলেটের বর্ণনার সাথে মিলে যায়। এগুলো সাধারণত প্রায় ২.২০ ইঞ্চি লম্বা। পুলিশ এসব গুলি চীনে তৈরি টাইপ ৫৬ রাইফেলের সাথে ব্যবহার করেছে। নেত্র নিউজ এগুলোর ছবি দেখালে সাখাওয়াত যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের ব্যবহৃত বুলেট হিসেবে এগুলোকে শনাক্ত করেন।
সাখাওয়াত দাবি করেন যে, তিনি বাইরে থেকে অবিরাম গুলির শব্দ শুনেছেন এবং সেইসময় দ্রুততার সঙ্গে পুরো এলাকা বারুদ ও কাঁদানে গ্যাসের গন্ধে ভরে যায়। হত্যাকাণ্ডের সময় থানার পুলিশ সদস্যরা সুসংগঠিতভাবে কাজ করছিল। যখন একটি দল বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালাচ্ছিল, তখন অন্য একটি দল বন্দুক পুনরায় লোড করার জন্য উপরে আসছিল। যারা গুলি চালাচ্ছিল তাদের গুলি ফুরিয়ে গেলে সেখানে বন্দুক লোড করা দলটি প্রতিস্থাপিত হচ্ছিল। এভাবে পালাক্রমে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ।
তবে বিক্ষুব্ধ লোকজন জড়ো হয়ে পাল্টা হামলা চালালে পুলিশ সদস্যরা বন্দিদের গালিগালাজ করতে থাকে। “ওরা গুলি করতেছে বাহিরে, আবার মাঝেমধ্যে ভিতরে এসে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করতেছিল যে আমাদেরকে মেরে ফেলবে। মানে জিদ দেখাচ্ছিল আমাদের উপর”-- সাখাওয়াত বলেছিলেন। এমনকি তারা “ক্রসফায়ারে” মেরে ফেলারও হুমকি দেয়।
হাসিনার বিশ্বাসঘাতকতা
বেলা ৩টার পর যাত্রাবাড়ীর পুলিশ জানতে পারে তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা, যাকে রক্ষা করতে তারা মরিয়া, তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। “তখন পুলিশরা বলতেছিল, ‘শেখ হাসিনা তো পালাইছে। এখন আমাদের তো আর এইখানে থাকার উপায় হবে না।’” সাখাওয়াত তাদের কথা শুনেছেন।
এদিকে, যখন থানার ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রাগার পাহারা দিচ্ছিল, তখন তাদের সহকর্মী এবং রাস্তায় থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের খবর না দিয়ে, তাদের প্রায় নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রেখে পালিয়ে যান।
বিকেল ৪টার দিকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য থানার প্রধান ফটক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে জনতা তাদের ধরে নির্দয়ভাবে মারধর করে।
ততক্ষণে বিক্ষুব্ধ জনতা থানার আশপাশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। থানার ভেতরেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় চারপাশ ঢেকে যায় এবং বিক্ষুব্ধ জনতা আটকে পড়া পুলিশ সদস্যদের পালানোর সব পথ বন্ধ করে দেয়। তখন তারা বন্দিদের সহযোগিতা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। তারা বন্দিদের একটি প্রস্তাব দেন। ‘ “যদি আমরা তোমাদেরকে বাঁচাই, তোমরা আমাদের বাঁচাবা কিনা?” থানার ভেতরে আটকে থাকা এক পুলিশ সদস্য এমন প্রশ্ন করেন এবং হাজতের ফটক খোলার বিনিময়ে বন্দিদের পোশাক পরে পুলিশ সদস্যদের পালাতে সহায়তা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বন্দিরা রাজি হলে ওই পুলিশ সদস্য গুলি করে এবং পরে কাঠের টুকরো দিয়ে আঘাত করে ওই তালা ভেঙে ফেলা হয়। বন্দিরা পুলিশ সদস্যদের সাধারণের মতো সাজতে সাহায্য করেছিল।
মৃত্যুর কাছাকাছি
আগুন যখন যাত্রাবাড়ী থানা ভবনকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে, তখন পুলিশ সদস্যরা তাদের ইউনিফর্ম খুলে ফেলে সাধারণ পোশাক পরে বন্দিদের সঙ্গে থানা থেকে পালানোর চেষ্টা করে। গেটের বাইরে বিক্ষুব্ধ জনতার উপস্থিতি দেখতে পেয়ে তারা মূল গেট থেকে অনেক দূরে থানার পেছনের দিকে একটি ভবনের প্রাচীরে উঠে যায়।
“তখন দেয়াল টপকাই [...] তখন পাশের একটা বিল্ডিং-এর দোতলায় উঠি, এরপর তিনতলায় মানে ছাদে উঠি এরপর সেখানে থেকে লাফ মারি দোতলায়, এরপর আবার সেখান থেকে লাফ মারি নীচে।” -- সাখাওয়াত ব্যাখ্যা করেছিলেন যে তিনি সেদিন থানা কম্পাউন্ড থেকে কীভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন। সাখাওয়াত বলেন, “নীচে যখন লাফ মারি, তখন আবার অনেকে আসছিল আমাকে মেরে ফেলতে ছাত্রলীগ মনে করে, বা পুলিশ মনে করে।”
থানা থেকে পালানোর সময় ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ সদস্য মনে করে বিক্ষুব্ধ জনতা সাখাওয়াতকে যখন আঘাত করতে যাচ্ছিল তখন প্রাণ বাঁচাতে সাখাওয়াত মরিয়া হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন যে, তিনি নিজেও একজন আন্দোলনকারী এবং ১৮ জুলাই থেকেই এই আন্দোলনে তিনি অংশ নিয়ে আসছিলেন। এ সময় অলৌকিকভাবে তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের একজন ছাত্র, যিনি ১৮ জুলাই বাড্ডা এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সাখাওয়াতের বর্ণনা শুনে তার পক্ষে কথা বলেন এবং তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।
তবে অন্যরা, বিশেষ করে বেসামরিক পোশাকে পুলিশ সদস্যরা ততটা ভাগ্যবান ছিলেন না। সেদিন তাদের সবার ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছিল তা সাখাওয়াত নিশ্চিত করতে না পারলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রকাশিত একটি তালিকায় ওই দিন যাত্রাবাড়ী থানার আশেপাশে ছয় পুলিশ সদস্যের নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেছে।
যাত্রাবাড়ী থানায় বিক্ষুব্ধ জনতা অগ্নিসংযোগ করলে তার পাশেই অনেক পুলিশ কর্মকর্তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।●