নেহেরু থেকে হাসিনা: মেগা প্রজেক্ট আর মেগা চিন্তার অসুখ

উপমহাদেশে উন্নয়নের নামে মেগা চিন্তার যে অসুখটির আবির্ভাব ঘটেছিলো ভারতে সেটিই এখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশে।

নেহেরু থেকে হাসিনা: মেগা প্রজেক্ট আর মেগা চিন্তার অসুখ
মেগা চিন্তার অসুখ। ইলাস্ট্রেশন: জাহিদ জামিল।

গান্ধিয়ান অর্থনৈতিক চিন্তার কেন্দ্রে ছিল বাসাবাড়ীভিত্তিক উৎপাদন (হাউসহোল্ড প্রোডাকশন)। গ্রামীণ কারিগর, শ্রমনির্ভর মেশিন আর স্বনির্ভর স্থানীয় অর্থনীতি। কিন্তু নেহেরুর ফ্যাসিনেশন ছিল ভারী শিল্পে, মেগা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রকল্পে। ওইসময় ভারতের উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রেই ছিল হেভি ইন্ডাস্ট্রি বা ভারী শিল্প। চল্লিশের দশকে আম্বেদকার থেকে শুরু করে সুভাষচন্দ্র বোস, বা হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতা ভিডি সাভারকার সকলেই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে দ্রুত শিল্পায়ন এবং ভারী যন্ত্রায়নের পক্ষে ছিলেন। ভারতে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম পাঁচ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় বাঁধ, স্টিল কারখানা, আর হাইড্রো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পরপরই হিরাকুদ বাঁধ, বাখরা বাঁধ, আর নাগার্জুনাসাগর বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিপুল বাজেটে নির্মিত এই বাঁধগুলোতে একাধারে সেচ ক্যানেল পরিচালনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আর হাইড্রো-বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা ছিল।

৫০ এর দশকে বড় বাঁধ, বৃহৎ শিল্প, আর মেগা সেচ প্রকল্পের একনিষ্ঠ প্রবর্তক ছিলেন নেহেরু। নেহেরুর প্রথম দশকে বাঁধকে বলা হতো টেম্পল অফ মডার্ন ইন্ডিয়া বা আধুনিক ভারতের মন্দির। ১৯৫৪ সালে বাখরা নাঙ্গাল বাঁধ খুলে দেয়ার দিন নেহেরু বলেছিলেন: “Which place can be greater than Bakhra Nangal where thousands of men have worked or shed their blood and sweat, and laid down their lives as well? Where can be a holier place than this?” ১৯৫৫ সালে নাগার্জুনাসাগর বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর ফলকে নেহরুকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে: “This is the foundation of the temple of humanity in India”। ১৯৪৮ সালে হিরাকুদ বাঁধের কারণে উচ্ছেদ হওয়া গ্রামবাসীদের নেহেরু বলেছিলেন “ত্যাগ যদি করতেই হয়, সেটা দেশের স্বার্থের জন্যে করাই ভালো” (“If you are to suffer, you should suffer in the interest of the country”)। ভারতীয় ইতিহাসবিদ সুনীল খিলনানি ১৯৫০ সালে নেহেরুর প্রথম দশককে বর্ণনা করতে গিয়ে তার ক্লাসিক প্রবন্ধ Idea of India-তে লিখেছিলেন “India fell in love with the idea of concrete”।

তবে হিরাকুদ বাঁধসহ অন্য সকল বাঁধেরই অর্থনৈতিক আর সামাজিক বিপর্যয় ছিল। ছিল মানুষ উচ্ছেদের হাহাকার। হিরাকুদ বাঁধের কারণে মহানদীর পারের দেড়লাখ মানুষ উচ্ছেদ হয়েছিল। আবার বাঁধগুলোতে একের পর এক সেচ ক্যানেল নির্মিত হলেও চারপাশের গ্রামগুলোতে সেচের পানি চ্যানেল করার ন্যূনতম ব্যবস্থাও রাখা হয় নি। সবমিলিয়ে অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছিল বাঁধগুলো। নেহেরুর প্রথম দশকে বড় বাঁধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা প্রথমবারের মতো কঠিন সমোলোচনার মুখে পড়েন।

১৯৬১-তে কুসুম নাইয়ের তার Blossoms in the Dust: The Human Element of Indian Development বইতে ভারতের মেগা বাঁধ নির্মাণের তুলকালাম উদ্যোগের সমালোচনা করতে গিয়ে নেহেরুরই একটি আক্ষেপমূলক ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দেন: “On one side, we carry out irrigation and put more and more water for fresh areas, while on the other side land goes out of cultivation due to water logging […] it is bad engineering if you cannot hold what you have already got in the process of acquiring more.”

ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ ২০০৩ সালে দ্য হিন্দু পত্রিকায় লিখেছিলেন, বড় বাঁধগুলোর কারণে ভারতের অগণিত মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হওয়ার বিষয়টি পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গুহের ভাষায়, “Too many people had made too large a sacrifice for what was, in the end, not too great a benefit।”

একসময় এই মেগা অবকাঠামোগুলোর কারণে সৃষ্টি হওয়া মানুষের সীমাহীন দুর্দশা নেহেরুর নজরে আসে। মাত্র এক দশকের ব্যবধানেই বড় বাঁধের স্বপ্নদ্রষ্টা নেহেরু বৃহৎ এবং কমপ্লেক্স অবকাঠামোর মোহ থেকে বেরুতে পেরেছিলেন। দ্রুতই এই প্রকল্পগুলোর প্রচারণা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি। এমনকী বাঁধের মতো বড় প্রকল্পগুলোকে “ডিজিজ অফ জাইগান্টিসিজম” (মেগা চিন্তার অসুখ) বলেও তিনি অভিহিত করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে ভারতের সেন্ট্রাল ইরিগেশন বোর্ড অফ ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড পাওয়ারের বার্ষিক সভায় নেহেরুর একটি ভাষণে মেগা উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর বিপক্ষে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান বোঝা যায়: “I have been beginning to think that we are suffering from what we may call the disease of gigantism […] we want to show that we can build big dams and do big things. This is a dangerous outlook developing in India.”

পরবর্তীতে বড় প্রকল্পগুলো একের পর এক সামাজিক এবং পরিবেশগত বিপর্যয় প্রকট হয়ে উঠলে নেহেরুর উন্নয়ন চিন্তায় কিছুটা হলেও গান্ধিয়ান অর্থনীতির মৌলিক চিন্তাগুলোর প্রভাব নজরে আসে। গ্রামের পর গ্রাম কৃষক উচ্ছেদ করে নয়, বরং গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থাকে মূল কেন্দ্রে রেখে স্থানীয় এলাকাভিত্তিক অসংখ্য ছোট-বড় ও মাঝারি প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের মধ্য দিয়ে জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন নেহেরু।

১৯৫৮ সালে ইরিগেশন বোর্ডের প্রকৌশলীদের উদ্দেশে নেহেরু আরো বলেছিলেন, “[We] can meet our problems much more efficiently by taking up a large number of small schemes […] The small irrigation projects, the small industries and the small plants for electric power will change the face of the country, far more than a dozen big projects […] I merely wish […] to replace the balance in our thinking which has shifted too much towards gigantic schemes.”

সত্তর দশকের শুরুতে পশ্চিমা বিশ্বে স্মল ইজ বিউটিফুল এবং লিমিটস টু গ্রোথ নামের যে দু’টি ঐতিহাসিক মৌলিক গবেষণা প্রকাশিত হয়, সেখানেও সেন্ট্রালাইজড এবং মেগা উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর সীমাবদ্ধতা এবং ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শিল্পায়নের বিপর্যয়গুলোকে চিহ্নিত করে, স্থানীয় এবং ডিসেন্ট্রালাইজড অর্থনীতির বিকাশকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, নেহেরু বাঁধকে “ভারতের মন্দির” বলেছিলেন, সেই ইতিহাস বহুল প্রচলিত, কিন্তু নেহেরু যে “ভারতের বাঁধ-ভারতের মন্দির” এই অর্থনৈতিক দর্শন থেকে সরে এসেছিলেন, এবং ক্ষুদ্র ও গ্রামভিত্তিক অর্থনৈতিক চিন্তায় মনোযোগী হয়েছিলেন, উপমহাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু মূলধারার অর্থনীতির পাঠ থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে।

ভারতে বড় বাঁধ বিষয়ক প্রতিটি উদ্বেগই পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। যেমন আশির দশকে নর্মদা বাঁধ নির্মাণের সময় ভারত রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ছিল যে নর্মদা বাঁধ তৈরী হলে ভারতের আড়াইলাখ হেক্টর জমি সেচের পানি পাবে। অথচ বাস্তবে শতকরা ৫ ভাগ জমিতেও পানি আনা যায়নি। বরং সারা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট বড় হাজারখানেক বাঁধের তলায় তলিয়ে গেছে ভারতের প্রায় ৪ কোটি মানুষের বসতভিটা। অরুন্ধতী রায় তার Greater Common Good প্রবন্ধে লিখেছেন, “Over the last fifty years India has spent Rs. 80,000 crores on the irrigation sector alone. Yet there are more drought-prone areas and more flood-prone areas today than there were in 1947”।

ভারতের পরবর্তী সরকারগুলো বড় বাঁধ আর মেগা অবকাঠামোর মোহ থেকে প্রায় কখনোই আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। শুধু বাঁধ নয়, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লা মাইনিং, ইউরেনিয়াম মাইনিং, আর প্রায় ছয়শো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভারে তলিয়ে গেছে ভারতের অগণিত কৃষিজীবী মানুষ।

আমেরিকান সমাজ বিজ্ঞানী মাইকেল লেভিন দীর্ঘদিন গবেষণা করে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কারণে সৃষ্টি হওয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চিত্রটি তুলে ধরেছিলেন। নব্বই দশকের শুরুতে একটি গোটা অঞ্চলের প্রায় সমস্ত কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে বিদেশী বিনিয়োগের সেন্টার বা কেন্দ্র তৈরী হতে পারে, এমন উন্নয়ন ভাবনা থেকেই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর যাত্রা শুরু হয় ভারতে। পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জাতীয় স্বার্থের লিগ্যাল মোড়কে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জমি দিতে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি জোরপূর্বক অধিগ্রহণ করা শুরু হলে ভারতের সিঙ্গুর, নন্দিগ্রাম, উড়িষ্যা, গড়াই ও রাইগড় অঞ্চলে তুমুল সব আন্দোলন শুরু হয়। ওইসময় রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ছিল, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে মোট ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অথচ সরকারি হিসাবেই দীর্ঘ দুই দশকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে মাত্র ২০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে। আর মাঝখান থেকে জমি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে গেছে কত-শত-লক্ষ মানুষ। অন্যদিকে অধিগ্রহণ করা কৃষিজমির প্রায় ৪০ শতাংশই এখন অবধি অলস পড়ে আছে।

গত দুইদশকে মেগাবাঁধ, মেগাবিদ্যুৎ, মেগাহাইওয়ে, আর মেগা অথর্নৈতিক অঞ্চলের অছিলায় ভারতে দারিদ্র্য কমেনি, বেকারত্ব কমেনি, দুর্নীতি কমেনি, মানুষের দূর্ভোগ কমেনি, বরং স্থানীয় কর্মসংস্থানগুলো হারিয়ে গেছে, কৃষক বসতভিটাসহ উচ্ছেদ হয়েছে, তলিয়ে গেছে লাখ লাখ হেক্টর কৃষিজমি। কয়লা খনি, কয়লা বিদ্যুৎ, আর ইউরেনিয়াম খনির কেমিক্যাল দূষণে বিষাক্ত হয়েছে কত-শত অঞ্চলের বাতাস, ক্ষয়ে গেছে কত লাখ মানুষের ফুসফুস, যকৃৎ, কিডনি, তার হিসাব কেউ রাখেনি।

শেখ হাসিনার উন্নয়ন ডিসকোর্স

গত একদশকে ভারতের প্রতিটি ব্যর্থ মডেল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। ভারতের গণমানুষের জীবনজীবিকা ও বসতভিটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া প্রতিটি অন্তঃসারশূন্য উন্নয়ন মডেলকে এই রাষ্ট্র শুধু আমদানীই করেনি, এরসঙ্গে মিলেমিশে সীমাহীন দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য আর লুটপাটতন্ত্রের এক নজিরবিহীন রেকর্ড স্থাপন করেছে।

গত একদশকে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের শাসনামলেই প্রায় ৩০টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সই হয়েছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যে প্রায় এক লাখ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, বাজেটের পাঁচভাগের একভাগ অর্থায়নে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। কয়লা বিদ্যুৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ, গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেইল, বিআরটিসির লাইন ইত্যাদি মেগাপ্রকল্পের নামে বাছবিচার ছাড়াই ক্রমাগত ঢালাওভাবে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। প্রায় ৭০ ভাগ বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরশীল এই মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণ ও সুদের ভার কয়েক প্রজন্ম ধরে বহন করতে হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকেই।

শুধু তাই নয়, প্রত্যেকটি মেগা অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাগামহীন লুটতরাজের এক ভয়াবহ চিত্র। ভারত, চীন, এমনকী ইউরোপের চেয়েও দুই থেকে তিনগুণ বেশী খরচে তৈরী হচ্ছে এদেশের হাইওয়ে এবং ফ্লাইওভারগুলো। সর্বস্তরে চুরির মানসিকতার কারণে এতো অর্থ ব্যয় করার পরেও রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট কোনোকিছুই টিকছেনা, মেরামতব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। একদিকে অবিশ্বাস্য খরচে তৈরী হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র আর টার্মিনাল, অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বছরে প্রায় অর্ধকোটি টন কয়লা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহণ করতে বিপুল রাষ্ট্রীয় খরচে তৈরী হচ্ছে সড়ক ও রেলপথ। বাস্তবতা হচ্ছে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা এই অবকাঠামোগুলো ছাড়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও লাভজনক উপায়ে চালু রাখা সম্ভব নয়।

বাস্তবতা হচ্ছে, উন্নয়নের নামে এই দেশকে নিম্নমানের আমদানীকৃত কয়লার আস্তানা বানাতে, দেশজুড়ে বিষাক্ত কয়লা পরিবহণ করতে, লোড-আনলোড করতে জনগণের করের টাকার অঢেল অপচয় করেই তৈরী হচ্ছে ঋণনির্ভর মেগা অবকাঠামো। প্রশ্ন করুনতো, সারা পৃথিবী যখন অপেক্ষাকৃত কম খরচবহুল এবং পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্মার্ট বিনিয়োগ করছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঠিক তখন একেবারে উল্টোদিকে হাঁটছে কেন? নাহ, এখানে কোনো বৃহৎ পুঁজি বা বৃহৎ উন্নয়নদর্শনের চিন্তাভাবনা নেই। কারণ একটাই, পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতে শতকোটি টাকার কমিশনবাণিজ্যের সুযোগ নেই।

আমরা তাই প্রশ্ন করতেই পারি, বর্তমান আওয়ামী রেজিমের বহুল প্রচারিত উন্নয়ন ডিসকোর্সের আওতায় গৃহীত এইসব মেগাউন্নয়ন প্রকল্পের উসিলায় আসলে ঠিক কত সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে বা হবে? কী ধরনের শিল্পায়ন হয়েছে বা হবে? এতো এতো মেগাপ্রকল্পের ছড়াছড়ি, প্রায় প্রতিসপ্তাহেই মন্ত্রিসভায় হাজারকোটি টাকার একাধিক প্রকল্পের অনূমোদন, অথচ দশবছরে দেশের বেকারত্ব ৪ কোটি ৮০ লাখ ছাড়ালো কেন? মেগাপ্রকল্পগুলোর কারণে যে পরিমাণ কৃষিজমি বিনষ্ট হয়েছে, যত কৃষক উচ্ছেদ হয়েছে, যত পরিবার জীবিকা হারিয়েছে, তার বিপরীতে তৈরী হওয়া বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানগুলোর কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য, ডেটাবেইজ, বা পরিকল্পনা কি আমাদের চোখে পড়ে?

বরং আমরা দেখছি উল্টো চিত্র। দেখছি মেগাপ্রকল্পগুলোর কারণে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের আহাজারি, ক্ষতিপূরণের নামে প্রতারণা, আর জীবিকা হারিয়ে সর্বশান্ত হওয়া জনপদ। দেখছি পায়রা এবং মাতারবাড়ী কয়লাপ্রকল্প দু’টোতে শুরুরদিকে স্থানীয়দের কাজ দেয়া হলেও খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তাদের অনেকেই ঢালাও ছাঁটাইয়ের শিকার হতে হয়েছে। দেখছি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, এলাকার প্রতিটি কৃষিজীবী মানুষের উপার্জনের পথ বন্ধ করে দিয়ে, জেলেদের নৌকা চলার নদীগুলো ব্লক করে দিয়ে, ইলিশের প্রজননক্ষেত্রগুলো নষ্ট করে দিয়ে, পায়রা টার্মিনাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কাজ করানো হচ্ছে চায়নিজ শ্রমিকদের। দেখছি একাধিক মেগাপ্রকল্পের দাপটে কেমন করে একটি উপকূলীয় জনপদের শতবছরের প্রাকৃতিক মানচিত্র বদলে গেল, বহুবছরের পরিচিত কাজগুলো হারিয়ে গেল, মেগা উন্নয়নের ধাক্কায় নিজদেশেই রিফিউজি হতে চলেছে পায়রার মানুষ, মাতারবাড়ীর মানুষ, রামপালের মানুষ, সুন্দরবনের মানুষ, বাঁশখালীর মানুষ।

অথচ শিল্পায়নের নামে অবিশ্বাস্যমাত্রায় কৃষিজমি দখল করে শিল্পায়ন কি আদৌ হয়েছে বাংলাদেশে? শিল্পায়নে রাষ্ট্রের আন্তরিকতা থাকলে সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রীয় মিলগুলোর এই ভগ্নদশা কেন? খুলনার পাটকলগুলোর এই অবস্থা কেন? বিসিকের জন্য অধিগ্রহণকরা বিপুলপরিমাণ জমি খালি পড়ে থাকে কেন? নতুন করে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হয় কেন? বিসিকের প্লট পেতে বিনিয়োগকারীদের মোটা অংকের ঘুষ দিতে হয় কেন?

বাস্তবতা হচ্ছে, এই মুহূর্তে এই রেজিমের কোনো উন্নয়নদর্শন নেই। গত একদশক ধরে মেগাপ্রকল্প আর বড় জিডিপির মিশেলে উন্নয়নের যে ডিসকোর্স হাজির করেছে শেখ হাসিনার রেজিম, তার সঙ্গে না আছে শিল্পায়নের কোনো সম্পর্ক, না আছে গণআকাঙ্খার কোনো প্রতিফলন, না আছে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ন্যূনতম কোনো প্রচেষ্টা, না আছে জবাবদিহিতার কোনো কাঠামো, না আছে আইনের শাসন বা জাস্টিস প্রতিষ্ঠার বিন্দুমাত্র কোনো নিদর্শন। বরং ঠিক এইমুহূর্তে এই ধরনের অন্তঃসারশূন্য উন্নয়ন মডেলের বিপক্ষেই পুরো ইউরোপজুড়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। এটার্নাল গ্রোথ বা জিডিপি-সর্বস্ব উন্নয়নচিন্তার বিরুদ্ধে গ্রেটা থুনবারির “হাও ডেয়ার ইউ” নতুন করে ধাক্কা মেরেছে উন্নয়নের এইসব বাটপাড়ি চিন্তাভাবনাকেই।

পঞ্চাশের দশকে ভারত যখন মেগাপ্রকল্প আর ভারী শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকেছিলো, সেখানে নেহেরুর কয়েকদশকের ধারাবাহিক উন্নয়ন-ভাবনার প্রতিফলন ছিল। দুইশ বছরের ব্রিটিশশাসনে ভারতের নিজস্ব শিল্পগুলো ধ্বংস হয়েছিল, ব্রিটিশ টেক্সটাইলের অবাধ প্রবেশে ভারতের নিজস্ব টেক্সটাইল সংকোচনের মুখে পড়েছিল, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিলো। স্বাধীনতার পরপর একটি স্বনির্ভর এবং বৃহৎ শিল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকাঙ্ক্ষাই তখন স্বাভাবিক ছিল। এছাড়া গোটা ৩০ আর ৪০ এর দশকজুড়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন ব্লকে পেট্রোলিয়াম, স্টিল, টেলিযোগাযোগ, মাইনিং আর মোটর কারখানার মতো ভারী শিল্পগুলোর ব্যাপক বিকাশ হয়েছিল। বলা যায়, পঞ্চাশের দশকে নেহেরুর ভারী শিল্পের ভিশন ওইসময়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অমূলক ছিলোনা।

পরবর্তীতে বৃহৎ প্রকল্পের সামাজিক এবং পরিবেশগত ক্ষতিগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠায় নেহেরু মেগাশিল্পায়নের উন্নয়নদর্শন থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চিন্তা করতেও দ্বিধা করেননি। নেহেরুর ভাষায়, “The idea of big — having big undertakings and doing big things for the sake of showing that we can do big things — is not a good outlook at all!”

বলা যায়, নেহেরুভিয়ান সোস্যালিজমের অনেক মার্ক্সিয় সমালোচনা থাকলেও নেহেরু অন্ততঃপক্ষে তার উন্নয়ন ভাবনায় আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হালের উন্নয়ন চিন্তায় কোনো গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কি দেখা যায়? কোনো আন্তরিক উন্নয়নভাবনার দেখা কি মেলে? কোনোদিন বাংলাদেশের সঠিক উন্নয়ন ইতিহাসটি লেখা হলে, আমরা কি জানতে পারবো, জনগণের করের টাকার কী বিপুল অপচয় করেছিল এই রাষ্ট্র? কী বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছিল শুধুমাত্র উন্নয়নের নামে? আমরা কি জানতে পারবো, মেগাপ্রকল্পগুলোর ধাক্কায় উচ্ছেদ হয়ে একদিন এই দেশেরই কত হাজার লক্ষ কৃষিজীবী মানুষ স্রেফ পোকামাকড়ের মতো ভেসে গিয়েছিলো? সত্য এটাই যে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের যে চিত্রটি আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাই, তা ধ্বংস, লুট ও অব্যবস্থাপনার। গণমানুষের মূলধারার জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক অদ্ভুত লুটপাটযজ্ঞের।●

মাহা মির্জা, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে গবেষক।