এক জেনারেলের প্রতিহিংসা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অনারারি ক্যাপ্টেন জহুরুল হক খন্দকার কারা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এই অক্টোবরে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যকৃৎ (লিভার) ব্যাধি।
পুলিশের দাবি, জহুরুলকে (ক্যাপ্টেন জহুর হিসেবেই যিনি অধিক পরিচিত ছিলেন) তার মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পূর্বে আরও দুইজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য খোরশেদ আলম পাটোয়ারী ও আকিদুল আলীসহ গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা একটি “নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সদস্য” ও “রাষ্ট্রবিরোধী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে” জড়িত। আদালতের নথি মোতাবেক, তাদের বিরুদ্ধে ৮ মাস আগেই একটি মামলা দায়ের হয়। এরপর থেকে এই “তিন অপরাধী” নারায়ণগঞ্জ এলাকায় তাবলীগ জামাতের মাঝে আত্মগোপন করে ছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, এটি কোনো সত্য কাহিনী নয়। গ্রেফতারকৃত তিন ব্যক্তি সন্ত্রাসী নন। তারা আট মাস লুকিয়েও ছিলেন না। শুধু তা-ই নয়, এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, জহুরুলের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। এই তিন ব্যক্তির ভাগ্যে কী ঘটেছে তা বুঝতে হলে যে ব্যাক্তিগত আক্রোশের জের ধরে ঘটনার সূত্রপাত তা জানা আবশ্যক।
এই প্রতিশোধযজ্ঞ শুরু হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) তারিক সিদ্দিক ও তার প্রাক্তন ব্যবসায়িক অংশীদার কর্নেল (অবঃ) শহিদ উদ্দিন খানের মধ্যে বিবাদের সূত্র ধরে। শহিদ খান বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। এক সময় তারা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নয় বছর ধরে তাদের দুই পরিবার যৌথভাবে একটি জমি কেনাবেচার কোম্পানি পরিচালনা করতো। প্রচ্ছায়া লিমিটেড নামে ওই কোম্পানির বদৌলতে দুই পরিবারই ধনী হয়ে ওঠে।
তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল। তার একদিন আগে তারেক সিদ্দিকের অনুরোধে শহিদ ওই যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি বিলুপ্ত করেন। এরপরই ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর সদস্যরা শহিদ খানের ঢাকার অফিসে তল্লাশি চালায় ও কোম্পানির সকল নথিপত্র নিয়ে যায়। ওই সকল নথিপত্র নিয়ে যাওয়া হয় সিদ্দিকের বাসায়।
তারপর থেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কিছু সংস্থার আক্রমণাত্মক হয়রানির টার্গেট শহিদ খান। তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ইন্টারপোল-এর রেড নোটিশ তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করানো হয়। বাংলাদেশে তার সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়, তার সকল অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। এছাড়া তার এক ভাইকে গোপনে আটক করে এখনও গুম করে রাখা হয়েছে।
মূলত শহিদ খানের বিরুদ্ধে সিদ্দিকের প্রতিহিংসারই বলি গ্রেফতারকৃত তিন ব্যাক্তি — জহুরুল, খোরশেদ ও আকিদুল। তাদের অপরাধ ছিল, তারা এমন এক ব্যক্তির কর্মচারী যিনি বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এক নিরাপত্তাকর্তার ক্রোধের শিকার। দৃশ্যত, শহীদ খানকে শিক্ষা দিতেই তাদেরকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কেবল।
এই তিন ব্যাক্তির দুর্ভোগের শুরু হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে। তারা তখন শহিদের অফিসে কাজ করছিলেন। আর সেই কার্যালয়েই তল্লাশি চালিয়েছিল ডিজিএফআই। ডিজিএফআই সদস্যরা তাদের আটক করে প্রথমে সিদ্দিকের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের ডিজিএফআই-এর সদরদপ্তরে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা আটক রাখা হয়। সেখানে তাদের বস শহিদ খানের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
তাদের সেই সময়কার অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে নোটারীকৃত হলফনামার মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়।
শহিদ খান ওই ঘটনা হজম করে যাননি। তিনি পাল্টা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি সিদ্দিক, তার স্ত্রী ও ডিজিএফআই’র বিরুদ্ধে আইনি নোটিস পাঠান। সম্ভবত, শহিদের এই ঔদ্ধত্বে ক্ষিপ্ত হয়েই ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঐ তিনজনকে আবারও তুলে নিয়ে যায়। তার পাঁচ দিন পর শহিদের বাসায় তল্লাশি চালানো হয়। একটি ভুয়া মামলাও দায়ের করা হয় যে এই তিন ব্যক্তি হলেন সন্ত্রাসী, যারা শহিদ খানের নির্দেশে কাজ করছে।
[নেত্র নিউজের পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও বাংলাদেশ সরকারের কাছে মন্তব্য চেয়ে যোগাযোগ করা হয়। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অবদি কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে সিদ্দিক তার বিরুদ্ধে এ সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। তিনি তখন দাবি করেছিলেন, “আমার কাছে প্রমাণ আছে যে, ডিজিএফআই ও আমার ওপর অপহরণের দায় চাপাতে ওই অফিসকর্মীরা নিজেরাই আত্মগোপনে গিয়েছে।” ডিজিএফআইও এর আগে এ ধরণের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ “জোরালোভাবে অস্বীকার” করেছে। সংস্থাটি দাবি করেছে, “কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শহীদ উদ্দিন খান তার কর্মীদের আত্মগোপনে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তদন্ত কর্তৃপক্ষ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারে।” ডিজিএফআই থেকে এর আগে দাবি করা হয় যে, শহীদ উদ্দিন খান “সম্পত্তি আত্মসাৎ সহ বিতর্কিত কিছু কর্মকাণ্ডে জড়িত, যা সামরিক পরিবেশ ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর।” তবে ডিজিএফআই-এর এসব অভিযোগ কর্নেল খান অস্বীকার করেছেন।]
পরবর্তী ৮ মাস এই তিন ব্যক্তিকে অজ্ঞাত স্থানে বন্দী করে রাখা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এসে তাদের “গ্রেফতার” দেখানো হয়। এই গ্রেপ্তারের ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ পুলিশি নাটক, কেননা এতদিন ধরে তারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতেই বন্দী ছিল।
এমনটা সম্ভব যে, ক্যাপ্টেন জহুরুলের মৃত্যুর সঙ্গে তার গোপন কারাগারে বন্দী থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনাই বেশি। জহুরুলের অবশিষ্ট দুই সহকর্মী যখন আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তার ঠিক দুই দিন পরই জহুরুলের মৃত্যু হয়। সুতরাং, এমনটা সন্দেহ করাটা অযৌক্তিক নয় যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় এজেন্টরা যা করেছেন, তারই ফলশ্রুতিতে তার মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশে এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেটি ক্ষমতার এ ধরণের স্বেচ্ছাচারী ও নির্মম চর্চার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম। এই তিন ব্যক্তিকে (সকলেই প্রাক্তন সেনা সদস্য) গোপনে বন্দী রাখা, জহুরুলের মৃত্যু, বা শহিদ উদ্দিন খানকে এভাবে হয়রানি করা নিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়নি।
মিডিয়া আসলে সাহসও করতে পারে না।
আর এখন গুম হওয়া কোনো ব্যাক্তির পরিবারের সদস্যরা ভয়ে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা চিন্তাও করে না। আর শরণাপন্ন হলেও, তারা জানেন যে, আদালত সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিতে কিংবা প্রতিকার দিতে ইচ্ছুক নয়।
এই তিন ব্যাক্তি ও আরও যারা ঘটনাচক্রে এই আক্রোশের শিকার হয়েছেন, তাদের কাহিনী থেকে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমনমূলক ক্ষমতার বাছবিচারহীন প্রয়োগ হলে কী ঘটতে পারে। এ থেকে দেখা যায় যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এহেন বাছবিচারহীন ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ কিংবা এর দরুন সাধারণ মানুষ যে ভুক্তভোগী হচ্ছে তা ঠেকাতে অক্ষম।●
ডেভিড বার্গম্যান নেত্র নিউজের ইংরেজী বিভাগের সম্পাদক।
🔗 Al Jazeera, March 20th 2019 — Bangladesh top security adviser accused of abductions.
🔗 Bangladesh Politico, June 25th 2019 — “Vendetta” by PM’s Security Adviser turns business partner into a “terrorist”.
🔗 Al Jazeera, November 22nd 2019 — Employee of UK-based Bangladeshi businessman dies in custody.