আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতি

মার্কিন আদালতের নথিতে আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতি।

আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতি

কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোর সাথে বাংলাদেশ সরকারের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে আইসিএসআইডির আওতাধীন আন্তর্জাতিক সালিসি ট্রাইব্যুনাল ২০১৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি যে আদেশটি দিয়েছে তাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও আমলাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে নাইকো চুক্তিতে দুর্নীতির যে সকল অভিযোগ আনা হয়েছিল তা ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়নি।

[পড়ুন: নাইকো কাণ্ডে খালেদা ও বিএনপি নেতাদের নির্দোষ সাব্যস্ত করলো আন্তর্জাতিক সালিশি ট্রাইব্যুনাল।]

তবে বিএনপি আমলের দুর্নীতি নিয়ে বিদেশী আদালতে বিপরীতমুখী রায়ের নজিরও আছে, যেখানে সেই আমলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস একটি বিচারিক আবেদনের মাধ্যমে তিনটি বিদেশী ব্যাংক একাউন্টের অর্থ বাজেয়াপ্ত করে। এই তিনটি একাউন্টের একটি নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো।

ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের আবেদনে প্রদত্ত বিবরণে বলা হয়, “[স্বাক্ষীদের] সাক্ষাৎকার ও আর্থিক লেনদেনের হিসাব পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হয় যে কোকো সিমেন্স বাংলাদেশ লিমিটেড ও চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিসহ কয়েকটি কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হিসেবে এসব ক্ষেত্রে কোকোকে ‘প্রটেকশন মানি’ দেওয়া হতো যাতে তিনি প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সরকারি কন্ট্রাক্টে ঝামেলা না করেন।”

মার্কিন তদন্তকারীদের হিসাব অনুযায়ী, এই দুইটি কোম্পানি থেকে কোকো সর্বমোট ১,৯৩৬,৮৩৫ ডলার ঘুষ পান। জেডএএসজেড ট্রেডিং এন্ড কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি একাউন্টে এই অর্থ রাখা হয়। এই একাউন্টটি ছিল আরাফাত রহমান কোকোর। সিঙ্গাপুরের ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকের এই জেডএএসজেড একাউন্টে তদন্তকারীরা প্রায় ২,০০০,০০০ ডলার পান। কোকোর জন্য এই একাউন্টটি যিনি খুলে দিয়েছিলেন তিনি জিজ্ঞাসাবাদে জানান যে একাউন্টটিতে আর কোন লেনদেন হয়নি এবং অতিরিক্ত যে অর্থ সেখানে ছিল তা মূল দুর্নীতিলব্ধ অর্থেরই সুদ হিসেবে জমা হয়েছিল।

সিমেন্স

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, সিমেন্স বাংলাদেশসহ, সিমেন্স ও তার তিনটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ঘুষের মাধ্যমে সরকারি কাজ বাগানোর দায় স্বীকার করে। বাংলাদেশে ডিজিট্যাল মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের যে কন্ট্রাক্টটি পাওয়ার জন্য সিমেন্স দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল তার মূল্য ছিল ৪১ মিলিয়ন ডলার।

সিমেন্স স্বীকার করে নেয় যে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তারা কয়েকজন স্থানীয় “ব্যবসায়িক পরামর্শক”-কে নিয়োগ করে যাদের কাজই ছিল ঘুষের টাকা লেনদেন করা। মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রকল্পে বিভিন্ন সহায়তার বিনিময়ে কোম্পানিটি বাংলাদেশের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ঘুষ দিতো। এমন ঘুষ গ্রহীতাদের একজন ছিলেন কোকো।

ঘুষ লেনদেনের জন্য সিমেন্সের নিয়োগকৃত তথাকথিত ব্যবসায়িক পরামর্শকদের একজন ছিলেন জুলফিকার আলী। তিনি জানান কন্ট্রাক্ট বাগানোর লক্ষ্যেই সিমেন্স তাকে থোক অর্থ দিতো যাতে তিনি সেই অর্থ ঘুষ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। সিমেন্স ও জুলফিকার জানতেন যে আরাফাত রহমান কোকোর মতো বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়দের ঘুষ না দিলে তারা মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রকল্পের কাজই বানচাল করে দিতে পারে। ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের তদন্তে জানা যায় যে ওই প্রকল্পের কাজ পেতে সিমেন্স কমপক্ষে ৫.৩ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছিল।

কোকোর সাথে লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে জুলফিকার আলী তদন্তকারীদের জানান যে কোকো তার সাথে যোগাযোগ করে মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রকল্পের জন্য ঘুষ চান। জুলফিকারের দাবী তিনি কোকোর ব্যাপারে খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের কাছে অভিযোগ করলে মামুন তাকে বলেন যে তিনি কোকোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেননা। জুলফিকার আরও বলেন যে কোকোকে চাঁদা বা ঘুষ না দিলে প্রধানমন্ত্রীর এই পুত্র সিমেন্সের কন্ট্রাক্ট পাওয়াটাই ভেস্তে দিতে পারতেন।

ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের তদন্তকারীদের জুলফিকার আলী জানান যে সিমেন্সের স্থানীয় এক কর্মকর্তা তাকে জেডএএসজেড ট্রেডিং এন্ড কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেডের নামে কোকোর জন্য সিঙ্গাপুরের একটি ডলার একাউন্টে ১৮০,০০০ ডলার ওয়্যার ট্র্যান্সফার করে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তদন্তে আরও জানা যায় যে সিঙ্গাপুরে জেডএএসজেড কোম্পানিটি কোকোরই নির্দেশনা অনুযায়ী দাঁড় করিয়ে ছিলেন হেনরি নুন এন্ড কো. ম্যানেজমেন্ট কন্সাল্টেন্টসের লিম সিউ চেং। লিম নিজেই জিজ্ঞাসাবাদের সময় এই তথ্য মার্কিন তদন্তকারীদের জানান।

চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি

২০০৩ সালে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি বাংলাদেশের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণকাজের টেন্ডারে অংশ নেয়। এই কন্ট্রাক্টটির মূল্য ছিল প্রায় ১৩১,০০০,০০০ ডলার। ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের তদন্তে জানা যায় যে, মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রকল্পের মতোই, “[নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের ক্ষেত্রেও] কোকোকে অর্থ দেওয়া হয় যাতে তিনি তার প্রভাব খাটান এবং চায়না হারবারের টেন্ডার পাওয়াতে কোন ঝামেলা না করেন।”

এই প্রকল্পটির কাজ চায়না হারবারই পায়।

২০০৪ সালের ৫ই ডিসেম্বরের এক সমঝোতাপত্র অনুযায়ী চায়না হারবার বাংলাদেশে তাদের প্রতিনিধিদের সাথেই “অন্য কর্মকর্তাদের প্রদানের নিমিত্তে […] একেএম মুসা কাজল”-এর জন্য কমপক্ষে ১৯ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়। এই একেএম মুসা কাজল ছিলেন গ্যাটকো নামক একটি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কোম্পানির পরিচালক। ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের তদন্ত অনুযায়ী, এই টাকার একটি অংশ ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয় আরাফাত রহমান কোকোকে। প্রাক্তন অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন মন্ত্রীর পুত্রও স্বীকারোক্তি দেন যে তিনি ও কোকো চায়না হারবারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন।

নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণকাজের টেন্ডার পাওয়ার বিনিময়ে চায়না হারবার সিঙ্গাপুরে কোকোর জেডএএসজেড একাউন্টে ২০০৫ সালের মে মাসের দিকে ওয়্যার ট্রান্সফারের মাধ্যমে দুইভাগে ৬২৬,৮২৮ ডলার এবং ৫৬৫,৩৫৯ ডলার পাঠায়। একই বছরের আগস্ট মাসে সিঙ্গাপুরের জেডএএসজেড একাউন্টে চায়না হারবারের পাঠানো আরও ৫৬৪,৬৫৮ ডলার জমা হয়।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে কোকো মালয়েশিয়ায় মারা যান।

এর আগে, ২০১২ সালে, কোকোর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “সরকার বানোয়াট দুর্নীতি মামলায় কোকোকে জড়িয়ে তার নামে কুৎসা রটাচ্ছে। কোন নথিপত্রে কোকোর নাম পাওয়া যায়নি।”

নেত্র নিউজের পক্ষ থেকে বিএনপির একজন মুখপাত্রকে তাদের বক্তব্য দিতে বলা হলে বিএনপি আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। তবে বিএনপির এই মুখপাত্র এই বলে মন্তব্য করেন যে কোকো কখনোই তাদের দলের সদস্য ছিলেন না এবং তিনি যেহেতু এখন মৃত সেহেতু তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও নেই।●


🔗 US DOJ complaint for forfeiture, in the US District Court for DC.