একটি নিষিদ্ধ ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি
২০১৩ সালে রামচন্দ্র গুহের “ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী” বইটি পড়েছিলাম। ততদিনে আমি শিশু-কিশোরদের জন্য বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের উপর “সোনার বাংলার রূপালী কথা” বইটি লিখে ফেলেছি। বাবা-ছেলের সংলাপের মধ্য দিয়ে ইতিহাস বর্ণনার কৌশলটি আমার পাঠকরা খুব ভালোভাবেই গ্রহন করেছিলেন, বিপুল পাঠকপ্রিয় হয়েছিলো বইটি। তখন থেকেই আমি ভাবছিলাম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ইতিহাস বর্ণনার ভঙ্গি কি হতে পারে। রামচন্দ্র গুহের ইতিহাস বলার কৌশলটি আমাকে চমৎকৃত করলো। আমি স্থির করলাম আমিও বাংলাদেশের ইতিহাস লিখবো চার পর্বে, ঠিক এভাবেই। মানুষ গল্পের মতো করে ইতিহাস পড়বে। ইতিহাসের যে বয়ান আমাদের সামনে হাজির আছে আর যা আমাদের কাছে থেকে লুকিয়ে রাখা হয় সবই আমি তুলে আনবো, এমনটিই সংকল্প করলাম।
লেখার আগে শুরু হলো পড়ার কাজ। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের “বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১-২০১১” বইটি থেকে আমার বইটির জন্য একটি ছক তৈরী করলাম। চ্যাপ্টার ভাগ করলাম। প্রতিটি চ্যাপ্টারের জন্য রেফারেন্সগুলো আলাদা, আলাদা করে লিপিবদ্ধ করলাম। এরপর শুরু হলো রেফারেন্স সংগ্রহ করা আর পড়া। এর মধ্যে কিছু বই আমার আগে পড়া থাকলেও নতুন করে সবগুলো বইই পড়তে হলো। একা সামলাতে পারছিনা দেখে একজন সহকারীও নিয়োগ করলাম। রেফারেন্সেই ডুবে রইলাম অনেকদিন।
বইটির প্রথম খন্ড লিখে শেষ করলাম ২০১৮ সালের জুন মাসে। কয়েকজন বন্ধুকে পড়তে দিলাম পাণ্ডুলিপিটি। তাদের সবাই একবাক্যেই রায় দিলেন যে এই বই বাংলাদেশে প্রকাশ করা যাবেনা। কারণ এতে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এমন কিছু ইতিহাস আছে যা বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ লুকিয়ে রাখতে চায়। আমি হতাশ হয়ে পাণ্ডুলিপিটি ফেলে রাখলাম।
এরপরে দুই মাসের মধ্যেই অজানা এক কারণে আমাকে সামরিক গোয়েন্দারা খুঁজতে থাকলো, আমাকে তাদের অফিসে রিপোর্ট করতে বলা হলো। আমি আত্মগোপনে গেলাম। তখন আমার অফিস আর বাসায় রেইড দিলো ডিজিএফআই। পাঁচ মাস আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার পরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম আমি, ব্যাংকক হয়ে পৌঁছালাম প্যারিসে।
এই সময়েই আমি বইটির সম্পাদনার কাজ সারলাম। আর ভাবলাম যে দেশেই যখন আর থাকতে পারলাম না তাই এখন বইটি প্রকাশ করি, আমার আর কোন ক্ষতিতো আওয়ামী সরকার করতে পারবেনা। প্রকাশকও পেয়ে গেলাম, সূচীপত্র। তারা আমার তিনটি বই আগেই প্রকাশ করেছে। তারপরও আমি পাণ্ডুলিপি দেওয়ার সময় প্রকাশককে সতর্ক করে দিয়ে বললাম যে পাণ্ডুলিপিটি আপনি ভালো করে পড়ে দেখে নিন আপনি কোন ঝুঁকিতে পড়বেন কিনা। প্রকাশক পাণ্ডুলিপি পড়ে আমাকে বললেন, আপনি কোন কথাইতো রেফারেন্স ছাড়া লেখেননি, এই বই প্রকাশ করতে আমার কোন আপত্তি নাই। আর প্রকাশ করেই দেখি, বই নিষিদ্ধ করলে তখন দেখা যাবে। ততদিনে অনেক মানুষের হাতে বইটি চলে যাবে। তবুও আমি প্রকাশকের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ৪০০ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি থেকে ৫০ পৃষ্ঠার মতো অতিসংবেদনশীল টেক্সট কেটে বাদ দিলাম।
বই প্রকাশের কাজ চলতে থাকলো। “স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ” (প্রথম খন্ড) বইটি প্রকাশের তারিখ নির্ধারিত হলো ২০১৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। প্রকাশক পুরোদমে প্রচারণা শুরু করলেন। আমার সাম্প্রতিক সব বইই পাঠকপ্রিয় হয়েছে, তবুও আমি এই বইটির কিছু নির্বাচিত অংশ ফেসবুকে প্রকাশ করতে থাকলাম যাতে পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরী হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বইটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরীও হলো বটে। বাংলাদেশের দুইটি প্রথিতযশা অনলাইন বুকশপ বইটির প্রি-অর্ডার নিতে শুরু করলো। প্রতিদিনই কয়েকশো মানুষ বইটি প্রি-অর্ডার করলো।
৩রা ডিসেম্বর, বইটি যেদিন প্রেসে যাওয়ার কথা, সেদিন সকালে আমার প্রকাশকের ফোনে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। ফোন ধরে আমি প্রথমে ভাবলাম তিনি আমাকে কোন সুসংবাদ দিবেন, কারণ তখন প্রতিদিনই তিনি উৎসাহভরে আমাকে বইটির বিপুল সংখ্যায় প্রি-অর্ডারের কথা জানাচ্ছিলেন।
কিন্তু সেই সকালে আমার প্রকাশকের কণ্ঠস্বর ম্লান, বিষন্ন আর ভয়ার্ত। আমতা, আমতা করে তিনি বললেন সরকার সমর্থক কিছু আইনজীবী উনাকে পরামর্শের সূরে বলেছেন যে এই বইটি প্রকাশিত হলে এর লেখকতো দেশে নাই তাই তার কিছু হবেনা, কিন্তু আপনার নামেতো ৬৪ জেলায় ৬৪ মামলা হবে, অন্য হয়রানিও হবে, আপনি সামলাতে পারবেনতো? আর বইটি যদি প্রকাশ করতেই চান তবে এটি প্রকাশের আগেই দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নিন।
প্রকাশকের কথা শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার ঠিক কি বলা উচিত। আমরা ভেবেছিলাম সরকার বইটি নিষিদ্ধ করবে, কিন্তু বইটি প্রকাশের আগেই যে ভয় দেখিয়ে প্রকাশককে নিবৃত্ত করা হবে সেটাতো ভাবিনি। বই নিষিদ্ধ করার দায় সরকারকে নিতে হলোনা, প্রকাশের আগেই আটকে দেওয়া হলো কৌশলে।
আমার প্রকাশক পরদিন ঘোষণা দিলেন যে তিনি অনিবার্য কারণে আমার বইটি প্রকাশ করতে পারছেননা, বইটি যারা প্রি-অর্ডার করেছিলেন তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। হলোও ঠিক তাই, আমার প্রকাশক বিপুল আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে সকল প্রি-অর্ডারের টাকা ফেরত দিলেন।
সাধারণ মানুষের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে বসে আমি এই প্রথম খণ্ডটি লিখেছিলাম শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল নিয়ে — ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত। শেখ মুজিবের শাসনকালকে আওয়ামী লীগ স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করতে চায়, কিন্তু একজন প্রকৃত ইতিহাসবিদ যখন সেই আমলের ইতিহাস লিখবেন তখন ভয়ানক দুঃশাসন, অবর্ণনীয় স্বৈরশাসন, জনগণের অধিকার হরণ, রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতা এবং সেই ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য বাকশালের মতো বিধ্বংসী পদক্ষেপের কথাই লিখবেন।
আমিও ঠিক সেভাবেই লিখেছিলাম কোন রাখঢাক না করে, যাতে পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারেন যে বাংলাদেশের সব দুর্দশার মূলে শেখ মুজিবের সেই শাসনকাল, সব সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। শেখ মুজিব যে কাজটি সম্পন্ন করতে পারেননি সেই কাজটিই যে গত ১১ বছর ধরে তার কন্যা শেখ হাসিনা সফলভাবে করছেন সেটাও পাঠকমানসে স্পষ্ট হবে। শেখ হাসিনার সরকার সাকসেসফুল বাকশাল ইন ডিসগাইজ। আমার বইটি পড়ে পাঠক এই সত্যটি জানুক, বুঝুক তা হাসিনার সরকার চায়নি।
এই আওয়ামী লীগ সরকারই আবার ২০২০ সালকে মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বছর জুড়ে বিপুল ব্যয়ে শেখ মুজিবের বন্দনা করা হবে। এই বছরেই আবার শেখ মুজিবকে এক ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক আর নির্মম স্বৈরাচারী হিসেবে বর্ণনা করে একটি ইতিহাসের বই বাজারে আসবে আওয়ামী লীগ হয়তো সেটা চায়নি।
এই হলো শেখ মুজিবের, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।
এই বাংলাদেশে আমার বই বাংলাদেশের কোন প্রকাশক ছাপতে চায়না, আমার বইয়ের প্রচ্ছদ কোন প্রচ্ছদশিল্পী করতে চায়না। আমার বই দোকান থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য সরকার সমর্থকরা চাপ দেয়। এর আগেও আমার “মার্কিন ডকুমেন্টে মুক্তিযুদ্ধ” বইটি বল প্রয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের বুকস্টোর থেকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করেছিলো তারা।
গায়ককে যে সমাজে গান গাইতে দেওয়া হয়না, শিল্পীকে যে সমাজে ছবি আঁকতে দেওয়া হয়না, চিন্তককে যে সমাজে চিন্তা করতে দেওয়া হয়না, লেখককে যে সমাজে লিখতে দেওয়া হয়না, সেই সমাজ নিষ্প্রাণ। ওরা আমাদের বলতে দেয়না, ওরা আমাদের লিখতেও দেয়না কারণ তারা চায় বাংলাদেশের মানুষ যেন চিন্তা করতে ভুলে যায়।●
পিনাকী ভট্টাচার্য, লেখক ও গবেষক।