একটি জনমত জরিপের কূটাভাস

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণের মানে এই নয় যে আওয়ামী লীগ সরকার অজনপ্রিয়।

একটি জনমত জরিপের কূটাভাস

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে করা একটি জনমত জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই মনে করেন যে দেশে মতপ্রকাশের কোন স্বাধীনতাই নেই। সেক্ষেত্রে ঐ জরিপটি সামগ্রিকভাবে কতটা বিশ্বাসযোগ্য? সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) এই জনমত জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকেই এমন দোটানায় পড়েছেন। এই জরিপটি যদি বিশ্বাসযোগ্যই হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন রয়েছে।

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত এই জরিপের ৪৮% উত্তরদাতা মনে করেন যে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেনা একেবারেই। আবার বিপরীতে ১২% উত্তরদাতা মনে করেন যে দেশের মানুষ সম্পূর্ণ মুক্তভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। এই প্রশ্নে বাকি ৪০% উত্তরদাতার অবস্থান মাঝামাঝি।

একটি দেশে ৪৮% মানুষ মনে করে যে তারা মুক্তভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে অক্ষম, এই উপাত্তটিতো দেশটির জন্য একটি কলঙ্কের তিলক।

আইআরআইয়ের জরিপে ২০১৯ সালের ১লা আগস্ট থেকে ১৬ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৪৯৯৩ জন ব্যক্তিকে বাংলাদেশের ভোটারদের রেন্ডম স্যাম্পল হিসেবে বেছে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। তবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে উত্তরদাতাদের জবাবের কারণ ব্যাখ্যা করতে তাদের বলা হয়নি। কিন্তু কারণগুলোতো খুবই স্পষ্ট। বাংলাদেশে একদিকে বিরোধীদলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার আর নির্যাতন চলছে, আবার অন্যদিকে সরকারের সমালোচক সাংবাদিক, সম্পাদক আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহাকারীদের গ্রেফতারী আর হুমকির শিকার হতে হচ্ছে। এই নিপীড়ণের পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে সেন্সর করার ঘটনাও বেড়েছে। অতি সম্প্রতি যেমন বাংলাদেশে নেত্র নিউজের মূল ওয়েবসাইটটি ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।

আইআরআইয়ের এই জরিপে যেমনটি ফুটে উঠেছে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এই করুণ দশায়, অনেকেই মনে করবেন যে সরকারের পক্ষে যায় জরিপের এমন ফলাফলগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশে সংস্থাটির রেসিডেন্ট ডিরেক্টর জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড অবশ্য এমনটি মনে করেননা। এই ব্যাপারে তিনি এক ইমেইল বার্তায় বলেন, “নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে করা একটি জনমত জরিপের ফলাফল আর প্রকাশ্যে কোন মতামত প্রকাশ এক নয়।”

তিনি ঠিকই বলেছেন। এমনটি হতেই পারে যে জরিপের উত্তরদাতারা একদিকে বিশ্বাস করেন তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার বা সুযোগ নেই, আবার অন্যদিকে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জনমত জরিপকারীদের তারাই বিভিন্ন প্রশ্নের খোলাখুলি উত্তর দিয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন উত্তর দিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে তেমন কোন আশংকা থেকে থাকলে ঐ প্রশ্নটির কোন অসৎ জবাব না দিয়ে উত্তরদানে বিরত থাকার সুযোগও জরিপের উত্তরদাতাদের ছিল, এবং অনেকক্ষেত্রেই তারা এই সুযোগটি ব্যবহারও করেছেন। বিশেষ কিছু প্রশ্নের জবাবদানে উত্তরদাতাদের অনীহার বিষয়টি সবেচেয়ে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিলো ২০১৮ সালের মাঝামাঝি আইআরআইয়ের করা আরেকটি জনমত জরিপে। সেই জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল এমন, “আগামী সপ্তাহে যদি সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে আপনি কোন দলের পক্ষে ভোট দিবেন?” ৬২% উত্তরদাতা ঐ প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি অথবা বলেছিলেন “জানি না”।

জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড আরও বলেছেন যে তারা বুঝতে পারেন কেন মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক উপাত্তটির সাথে জরিপের উত্তরদাতাদের জবাবের সততার প্রশ্নটি জড়িত। তবে তিনি মনে করেন যে তাদের জরিপে অংশগ্রহণকারীরা অনেকগুলো ইস্যুতেই সরকারের সমালোচনা করতে পিছপা হননি, এবং বেশিরভাগ উত্তরদাতা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই সমালোচনার দৃষ্টিতে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করেছেন।

এই জনমত জরিপ থেকে আমরা তাহলে কি জানতে পারছি?

৮৩% উত্তরদাতা মনে করেন সরকার ভালোই কাজ করছে, গতবারের জরিপে এই হারটি ছিল ৬৪%। আবার বিপরীতে মাত্র ৩৬% উত্তরদাতা বিরোধী দলের কর্মকান্ডকে ভালো বলেছেন, গতবারের জরিপে এই হারটি ছিল ৪২%।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭০%-এরও বেশি উত্তরদাতারা সাতটি ক্ষেত্রে সরকারের পারফরম্যান্সে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন: শিক্ষার মানোন্নয়ন (৯০%), বিদ্যুৎ সরবরাহ (৮৬%), পরিবহন অবকাঠামো (৮১%), সুপেয় পানির সরবরাহ (৭৭%), সহিংস উগ্রবাদীতার দমন (৭৬%), মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা (৭৪%), এবং শান্তি বজায় রাখা (৭১%)।

ঠিক একইভাবে ৭৬% উত্তরদাতা মনে করেন বাংলাদেশ “সঠিক দিকেই” যাচ্ছে, গতবারের জরিপে এই হারটি ছিল ৬২%। বিপরীতে মাত্র ১৫% উত্তরদাতা মনে করেন বাংলাদেশ “ভুল দিকে” যাচ্ছে (৮% উত্তর দিতে চাননি অথবা বলেছেন তারা জানেননা)। বাংলাদেশ “সঠিক দিকেই” যাচ্ছে এমনটি যারা মনে করেন তারা বিশেষভাবে চারটি কারণের কথা বলেছেন: “সামগ্রিক উন্নয়ন”, “ভালো অর্থনীতি”, “পরিবহন অবকাঠামো”, এবং “জীবনযাত্রার উচ্চতর মান”।

সরকারের ব্যপারে জনগণ কি ভাবছে তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হলো অর্থনীতি বিষয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা। আইআরআইয়ের জরিপে ৭৬% উত্তরদাতাই মনে করেন যে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো অথবা “খুবই ভালো”। ৫৪% মনে করেন যে আগামীতে এই অবস্থার আরও উন্নতি হবে (২৪% কোন উত্তর দিতে চাননি)। মাত্র ২১% উত্তরদাতা মনে করেন যে আগামীতে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে, যদিও বেশিরভাগই মনে করেন যে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা হয় একই থাকবে অথবা উন্নত হবে (মাত্র ১% এই প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি)।

অনেকের জন্যই এই জনমত জরিপটি মেনে নেওয়াটা কঠিন হবে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের শোচনীয় অবস্থা, দুর্নীতির ব্যাপক প্রাদুর্ভাব আর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনা করলে এমনটিই হওয়ার কথা। কিন্তু এর উত্তরটিও সম্ভবত এই জরিপে আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে এই প্রশ্নগুলো আসলে সাধারণ মানুষের কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেই ১৫% উত্তরদাতা মনে করেন যে দেশ সঠিক পথে যাচ্ছে না, তাদেরকে যখন এই জবাবের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল, তখন মাত্র ৬% বলেছেন গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কথা; ৬% বলেছেন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে জনগণের অক্ষমতার কথা; ৫% বলেছেন একপক্ষীয় সরকারের কথা। বরং, দেশ সঠিক পথে নেই এমনটি মনে করার ক্ষেত্রে যে কারণটিকে সবেচেয়ে বেশি উত্তরদাতা উল্লেখ করেছেন সেটি হচ্ছে “কৃষিপণ্যের স্বল্প বিক্রয়মূল্য”। সর্বোচ্চ ১৩% অসন্তুষ্ট উত্তরদাতা এই কারণটি উল্লেখ করেছেন, বলাই বাহুল্য যে এর সাথে গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের খুব একটা সম্পর্ক নেই।

সংসদ নির্বাচন হলে মানুষ কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দিবে এই প্রশ্নটির উত্তর আইআরআই প্রকাশ করেনি, যদিও ২০১৪ সাল থেকেই তাদের সব জরিপে এই প্রশ্নটি করা হয়। এই কারণেই জরিপে প্রকাশিত জনমত ঠিক কিভাবে দলগত সমর্থনে প্রভাব ফেলবে তা বোঝা মুশকিল। ২০১৮ সালের জরিপে যেমনটি দেখা গিয়েছিল, উত্তরদাতাদের ৬২% দেশ সঠিক দিকেই যাচ্ছে মনে করলেও মাত্র ২৫% বলেছিলেন যে তারা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিবেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক মূল্যায়ন সত্ত্বেও নির্বাচনে জনগণ পরিবর্তনের জন্যই হয়তো ভোট দিতে চাইবেন। ঠিক এই অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছিল।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়াও আর একটি ইস্যুতে আইআরআইয়ের জরিপে অংশগ্রহণকারীরা সরকারের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সেটি হচ্ছে রোহিঙ্গ্যা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, যা ৪৫% উত্তরদাতার পছন্দ হয়নি (৩৩% উত্তরদাতার একেবারেই পছন্দ হয়নি), এবং মাত্র ৩৭% উত্তরদাতার পছন্দ হয়েছে। তবে জরিপের ফলাফল অনুযায়ী রোহিঙ্গ্যা শরণার্থী সংকটের বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ খুবই ভারত-বিরোধী বলে যে একটি চালু ধারণা আছে তার কোন প্রমাণও এই জনমত জরিপে পাওয়া যায়নি। জরিপে দেখা যাচ্ছে ৫১% উত্তরদাতাই মনে করেন যে ভারত বাংলাদেশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে (২৩% মনে করেন যে “খুবই ইতিবাচক” ভূমিকা রাখছে)। বিপরীতে মাত্র ২০% উত্তরদাতা মনে করেন যে ভারত বাংলাদেশে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে (১০% মনে করেন যে “খুবই নেতিবাচক” ভূমিকা রাখছে)। ২৮% উত্তর দিতে চাননি বা বলেছেন জানেননা। দেখা যাচ্ছে যে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও ভারতকে নিয়ে ইতিবাচক জবাব দিয়েছেন অধিক সংখ্যক উত্তরদাতা, যদিও এই তিনটি দেশের প্রতি মানুষের সমর্থনের মাত্রা প্রায় কাছাকাছি।●

ডেভিড বার্গম্যান নেত্র নিউজের ইংরেজী বিভাগের সম্পাদক।


🔗 International Republican Institute, Bangladesh poll: Support for government rebounds, concerns over corruption, economic inequality persist.

🔗 Bangladesh Politico, Exclusive: Results of confidential poll revealed.