অবাঞ্ছিত “কসাই”: নরেন্দ্র মোদি
ভারতের বর্ণবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদাশীল নাগরিকরা স্বাগত জানাবে না।
আমাদের কীর্তিপাশার ছেলে, পরবর্তীতে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক, প্রয়াত তপন রায়চৌধুরী তার আত্মকথামূলক রচনা বাঙালনামায় অপরিসীম ঘৃণা নিয়ে লোকটির নাম দিয়েছিলেন নরাধম মোদি।
২০০২ সালে, ৯/১১-পরবর্তী দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিশ্বায়ন যখন কেবল শুরু হচ্ছে, তখন ভারতের গুজরাট গোরস্তান হয়ে উঠেছিলো। হিন্দুত্ব ভাবাদর্শীরা রাজ্যটির বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুসলমানদের আগুনে পুড়িয়েছে, ধর্ষণ করেছে মুসলিম মেয়েদের। অভিযোগ আছে যে গর্ভবতী মুসলিম নারীদের পেট কেটে ভ্রুণ বের করে ত্রিশূলেও গেঁথেছে তারা। এটি নিছকই কোনো সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ছিলো না, অজস্র জাতিবর্ণে বিভক্ত ভারতীয় সমাজটিকে এক করার উপায় হিসেবে মুসলমানদের সাধারণ শত্রু হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিলো, লেবাসটি হিন্দুধর্মের হলেও এর পেছনে ছিলো কর্পোরেট বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ।
নরেন্দ্র মোদি, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সেই সময় রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাজনৈতিকভাবে এই হত্যাযজ্ঞের জন্য তিনিই দায়ী। এ কারণে তাকে “গুজরাটের কসাই” বলা হয়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হলেও, অনেকেই সেটিকে প্রহসনের বিচার বলেই মনে করেন। বারো বছর পর ২০১৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হোন।
সাংবাদিক রানা আইয়ুব তার “গুজরাট ফাইলস: অ্যানাটমি অব এ কাভারআপ” বইয়ে দেখিয়েছেন, গুজরাট থেকে নয়াদিল্লিতে ক্ষমতার কেন্দ্রে মোদি ও তার ঘনিষ্ঠতম সহযোগী অমিত শাহের আগমন মোটেও কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিলো না। লেখক-অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধতী রায় তার একাধিক রচনায় দেখিয়েছেন, একটি প্রায়-শতবর্ষ পুরোনো রাজনৈতিক-ভাবাদর্শিক সংগঠন আছে মোদির পেছনে। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের নাগপুরে যে সংগঠনটির জন্ম হয়েছিলো ইতালির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির অনুপ্রেরণায়। সেই সংগঠনেরই (আরএসএস — রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) এক সাবেক সদস্য দেশরাজ গয়াল — যিনি পরবর্তীতে প্রগতিশীল রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন — তার “রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ” বইটিতে দেখিয়েছেন, আরএসএসের হিন্দুত্ব ভাবাদর্শ ফ্যাসিস্ট আর নাৎসি ভাবাদর্শের মতোই বর্ণবাদী। জার্মানির নাৎসিরা ইহুদিদের যে চোখে দেখতো, এরা ভারতের মুসলমানদের সেই একই চোখে দেখে। বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভারতকে এরা হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়। এদের চোখে মুসলমানরা ভারতবর্ষে “বহিরাগত” ও “দখলদার”।
দিল্লি সালতানাত আর মুঘল সাম্রাজ্যের ছয় শত বছরকে (১২০৬-১৮৫৭) ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন বলেন পার্সিয়ানাত, যে কালে ভারতবর্ষে মুসলমান শাসকরা দুনিয়ার আর সব শাসকের মতোই কিছু নির্যাতন-নিপীড়ন চালালেও, সামাজিক পরিসরে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিলো জোরদার। রোমিলা থাপার আর সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতও তাই। অথচ আরএসএস আজকে এই ইতিহাসকেও বিকৃত করছে। তাদের চোখে তুর্কি-মুঘলরা ছিলো “বর্বর” ও “নারীলিপ্সু”, যারা মন্দির ভেঙে আর হিন্দু নারীর “সতীত্ব নাশ করে” আনন্দ পেতো। “লাভ জিহাদ” নামক প্রচারণার উৎসও এখানেই নিহিত। এই প্রচারণায় এমনটা দেখানো হয় যে মুসলমান পুরুষরা “সহজ-সরল হিন্দু মেয়েদের ফুসলিয়ে” ধর্মান্তরিত করে চলেছে “হিন্দুধর্ম নাশ করার” এক মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে। উপনিবেশিক ইউরোপের “কৃষ্ণাঙ্গ ধর্ষক” আর নাৎসি জার্মানির “ইহুদি ধর্ষক” প্রচারণার সাথে এই প্রচারণার মিল খুব সহজেই চোখে পড়ে, আর এই সবগুলো প্রচারণাই বর্ণবাদী।
সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, আরএসএসের ভাবাদর্শিক শ্লোগান হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান (এক ভাষা, এক ধর্ম, এক দেশ — বহুত্ববৈচিত্র্যবিরোধী এক ভাবাদর্শ) যে তিনটি শব্দ নিয়ে গঠিত তার সবকটিই ফারসি, আর ফারসি ভাষা ভারতবর্ষে এসেছিলো মুসলমানদের হাত ধরেই।
বর্তমানে যেই ভারতীয় জনতা দল ক্ষমতায় আছে, সেই বিজেপি এই আরএসএসেরই ডার্লিং চাইল্ড।
সম্প্রতি তারা যে এনআরসি-এনআরপি-সিএএ-র উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, তার একেবারে কেন্দ্রে আছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের প্রতি উগ্র জাতিবাদী-সাম্প্রদায়িক ঘৃণা।
কথিত “অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী” ঠেকাতে আসামে আরএসএস-বিজেপি সাতটি ফুটবল মাঠের সমান বড় এক ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করেছে। সীমাহীন আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএএ-বিরোধী অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক শিক্ষার্থীদের ওপর। সম্প্রতি দিল্লিতে এদেরই লেলিয়ে দেওয়া মাস্তানেরা অসংখ্য মুসলমান নাগরিকের রক্ত ঝরিয়েছে, ক্ষতি করেছে সম্পদের। আর পুলিশ পালন করেছে সাক্ষী গোপালের ভূমিকা।
ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে শুধু উত্তর প্রদেশেই ১৮ জন খুন হয়েছে (এদের একজন আট বছর বয়সী শিশু), ১৮,৭০৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, যিনি “শাহরুখ খানের সঙ্গে হাফিজ সাঈদের ভাষার কোনো ফারাক নাই” বা “একজন হিন্দু মেয়েকে ধর্মান্তরিত করলে আমরা ১০০ জন মুসলমান মেয়েকে ধর্মান্তরিত করবো” জাতীয় বক্তব্য দেওয়ার জন্য বিতর্কিত। অদূর ভবিষ্যতে তার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
যোগী আদিত্যনাথ নরেন্দ্র মোদির আরেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
“গুজরাটের কসাই” থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা এই ব্যক্তিকে বাংলাদেশে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে আনা হচ্ছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, সেই উপলক্ষ্যে আয়োজিতব্য অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য রাখবেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার মতে, “ভারত চায় মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরটি উভয় দেশের জন্য পারস্পরিক সুবিধা বয়ে আনুক।”
এই “সুবিধাটি” পরিষ্কারভাবে দেখা যায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিএসএফের হাতে খুন হয়েছেন ৪৩ জন বাংলাদেশি। খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনই বলেছেন, এটি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি বড় দ্বিপক্ষীয় ইস্যু। মানবাধিকারকর্মী সিআর আবরার মনে করেন, “বছরের পর বছর ধরে সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়া বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর।”
অবশ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদৌ আর ভাবমূর্তি বলে কিছু আর অবশিষ্ট আছে কিনা, নরেন্দ্র মোদির মতো একজন ঘৃণ্য বর্ণবাদী, যার বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞে মদত দেওয়ার অভিযোগ আছে, তাকে বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে আনার ঘটনা দেখে, সেই ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হয়।
বাংলাদেশের আত্মমর্যাদাশীল নাগরিকরা মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত নরেন্দ্র মোদিকে পারসোনা নন গ্রাটা (অবাঞ্ছিত ব্যক্তি) ঘোষণা করা এবং তার আসন্ন বাংলাদেশ সফর বাতিল করা। এরকম একজন ব্যক্তিকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে না। ১৯৭১ সালে যেই দেশের মানুষেরা একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে পরাজিত করেছে, সেই দেশের মানুষেরা পাঁচ দশক পর আরেকটি রাষ্ট্রের বর্ণবাদী প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পারে না।●
ইরফানুর রহমান রাফিন, অনুবাদক-গবেষক-লেখক। তিনি রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য এবং মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক।