প্রভাবের কারবার: নগদ দুর্নীতি
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম শীর্ষ স্পিন ডক্টর হিসেবে পরিচিত প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন। নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠতম সহকারীদের একজন এই খোকন কার্যত থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (টিডব্লিউটিএল) নামক একটি কোম্পানির অঘোষিত পরিচালক। এই কোম্পানিটিই বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল আর্থিক সেবার ব্রান্ড “নগদ” পরিচালনা করে থাকে। নেত্র নিউজের হাতে আসা নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে যে ক্ষমতাসীন দলের দুই প্রভাবশালী সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক এমপি ও রাজি মোহাম্মদ ফখরুল এমপিও টিডব্লিউটিএলের বৃহৎ শেয়ারধারী। কোম্পানিটির আরেকজন শেয়ারধারী হলেন খোকনের স্ত্রী রেজওয়ানা নুর।
এই সেক্টরে কর্মরত লোকজনের অভিযোগ যে এই তিন ক্ষমতাধর — খোকন, নাহিম ও রাজি — তাদের নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে নগদ পরিচালনার লোভনীয় চুক্তি পাইয়ে দিয়েছেন টিডব্লিউটিএলকে। এছাড়াও তারা সরকারী-বেসরকারী আংশীদারিত্বে পরিচালিত এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি বিকাশ বা রকেটের তুলনায় ব্যপক সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রভাব খাটিয়েছেন। বিকাশ বা রকেটের মতো কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির কঠোর আর্থিক নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা করতে হয়। বিপরীতে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার তত্বাবধান ছাড়াই ব্যবসা করছে নগদ। এক্ষেত্রে ২০১০ সালের ডাকঘর (সংশোধন) আইনের একটি ফোঁকর ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই পক্ষপাতমূলক সুবিধার কারণে নগদের মোবাইল আর্থিক সেবা অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। নেত্র নিউজের হাতে আসা বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নথিপত্রেই এই আশংকার কথা বলা হয়েছে।
ঢাকায় এই খাতের একজন বিশ্লেষক নেত্র নিউজকে বলেন, “এরা [টিডব্লিউটিএল] হলো ডিসরাপটিভ কাওবয় [বিশৃঙ্খল রাখাল], আর্থিক সেবা খাতে ব্যবসা পরিচালনার অভিজ্ঞতা এদের খুবই কম বা একেবারেই নেই। ডিসরাপশন শব্দটা আমি নেগেটিভ অর্থেই ব্যবহার করছি। এদের একটা অংশ ইপিজেডে পানি সাপ্লাই দেওয়ার ব্যবসা করতো, আবার অন্যদের ভিওআইপি ব্যবসা ছিল। এখন এরাই ডাক বিভাগের সাথে অংশীদারীত্বে নগদ চালু করেছে। অথচ মোবাইল ভিত্তিক আর্থিক সেবার ব্যবসা কিন্তু খুবই সফিস্টিকেটেড।”
তিনি আরও বলেন, “আপনি যদি বিকাশ বা রকেট ব্যবহার করে টাকা পাঠাতে চান তাহলে আপনি এক দিনে সর্বোচ্চ পাঠাতে পারবেন [২৫,০০০ টাকা], সেই লেনদেনও হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়া নজরদারির মধ্যে। অন্যদিকে নগদ ব্যবহার করে আপনি এক দিনে [২৫০,০০০] টাকা পর্যন্ত পাঠাতে পারবেন, সেই লেনদেন দেখার জন্য নেই কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাও। আমরা আসলে ঠিক জানিনা যে তারা কীভাবে এটি করতে পেরেছে। নিশ্চয় খুব ক্ষমতাশালী লোকজন এদের নেপথ্যে আছে। নগদ দৃশ্যপটে আসার আগে এই সেক্টরটি খুবই ভালোভাবে নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলিত সেক্টর ছিল।”
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ (৫১%) ও টিডিব্লিউটিএলের (৪৯%) মধ্যে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারীত্বে নগদ পরিচালিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের পোস্টার, ব্যানার আর ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি ব্যবহার করছে। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ককে বেশ সুনিপুণভাবে ব্যবহার করছে কোম্পানিটি।
অধরা শেয়ারধারীরা
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নেত্র নিউজ এই টিডিব্লিউটিএলের নিবন্ধন সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। এই নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৬ সালের নভেম্বরে গঠিত হয় টিডব্লিউটিএল (নিবন্ধন নম্বর: সি-১৩৪০২৭)। শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার ছিলেন ৫ জন, যাদের মোট শেয়ার ছিল ১০ হাজার। এদের মধ্যে দুই প্রধান শেয়ারহোল্ডার ছিলেন কাজি মনিরুল কবির (৩০০০ শেয়ার) ও তানভির আহমেদ মিশুক (২৩৫০ শেয়ার)।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নেত্র নিউজ আরজেএসসি থেকে যেসমস্ত রেকর্ড পেয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই টিডিব্লিউটিএলের মালিকানায় বড় ধরণের পরিবর্তন আসে। তখন কাজি মনিরুল কবিরের সমস্ত শেয়ার তানভির আহমেদ মিশুক ও নতুন তিন শেয়ারধারী নাহিম রাজ্জাক (১২০০ শেয়ার), রাজি মোহাম্মদ ফখরুল (১২০০ শেয়ার) ও রেজওয়ানা নুরের (৫০০ শেয়ার) মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
রাজি মোহাম্মদ ফখরুল এমপিকে যখন টিডিব্লিউটিএলের সাথে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে নেত্র নিউজের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি বলেন, “এটি আমার ফ্রেন্ডের [তানভির আহমেদ মিশুক] কোম্পানি।” যখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, তিনিও এই কোম্পানিটির অন্যতম মালিক এবং প্রতিষ্ঠানটির ১২০০ শেয়ারের মালিকানা তারই, তখন তিনি সাথে সাথে ফোন কেটে দেন। এরপর তিনি নেত্র নিউজকে তানভির আহমেদ মিশুকের মোবাইল ফোন নম্বর এসএমএস করে পাঠান, সাথে লিখে দেন, “নো কমেন্টস। দয়া করে কোম্পানি থেকে সরাসরি বিস্তারিত জেনে নিন।”
তানভির আহমেদ মিশুকের সঙ্গে যোগাযোগ করে যখন তাকে বলা হলো যে, নগদ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছে নেত্র নিউজ, তখন তিনি জবাবে বলেন, “শিওর, শিওর। তবে [এ ব্যাপারে] আপনাকে পরে ফোন করছি এই নাম্বারে। এক ঘণ্টা পরে।” কিন্তু এরপর বারবার যোগাযোগ করা হলেও মিশুক কোনো জবাব দেননি। সাড়া দেননি রাজি মোহাম্মদ ফখরুল এমপিও।
টিডব্লিউটিএলে শেয়ার থাকার তথ্য রাজি মোহাম্মদ ফখরুল এমপি ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ করেননি। তবে হলফনামায় অন্য কোম্পানিতে থাকা শেয়ারের বিবরণ তিনি দিয়েছেন।
নাহিম রাজ্জাক এমপি নেত্র নিউজকে ইঙ্গিতে বলেছেন যে তিনি একসময় টিডব্লিউটিএলের শেয়ারধারী ছিলেন। তিনি বলেন, “টিডব্লিউটিএলের কোনো শেয়ার আমার এখন আর নেই। ধন্যবাদ।” তবে ঠিক কবে তিনি টিডব্লিউটিএলের শেয়ারগুলো ছেড়ে ছেড়ে দিয়েছেন সেই ব্যাপারে তথ্য দিতে তিনি রাজি হননি। নেত্র নিউজ ওই ব্যবসা নিবন্ধন নথি সংগ্রহ করে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। সুতরাং, এমনটিও হওয়া সম্ভব যে নাহিম রাজ্জাক খুব সম্প্রতিই টিডব্লিউটিএলের শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন।
অযাচিত প্রভাব
এই খাতের লোকজন নেত্র নিউজকে বলেছেন যে, এই দুই এমপি প্রাথমিক পর্যায় থেকেই টিডব্লিউটিএলের সাথে জড়িত ছিলেন। তারা কোম্পানিটিকে লোভনীয় সরকারী চুক্তি পাইয়ে দিতে অযাচিত প্রভাব খাটিয়েছেন।
এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত একজন বলেন, “এই দুই এমপি কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডার হওয়ার আগেই তাদের [টিডব্লিউটিএল ও এমপিদ্বয়] মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই কোম্পানি গঠন করা হয় ২০১৬ সালের শেষের দিকে। ২০১৭ সালের এপ্রিলেই ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে লোভনীয় এক চুক্তিতে যায় কোম্পানিটি। [এই সেক্টরে] কোনো ট্র্যাক রেকর্ড ছাড়াই টিডব্লিউটিএল সরকারী প্রকল্প করতে শুরু করে।”
নেত্র নিউজের হাতে আসা বিভিন্ন ছবি থেকে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং টিডব্লিউটিএলের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নাহিম রাজ্জাক এমপি ও রাজি মোহাম্মদ ফখরুল এমপি ছিলেন “বিশেষ অতিথি”। ওইদিনই ডাক বিভাগের পক্ষে পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের বাজারজাতকরণের চুক্তি পায় কোম্পানিটি।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এমপি ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। ওই সময় নাহিম রাজ্জাক এমপি বা রাজি মোহাম্মদ ফখরুল এমপি টিডব্লিউটিএলের শেয়ারধারী ছিলেন না। কিন্তু ৩ মাসের মাথায়, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে, তারা কোম্পানিটির বৃহৎ শেয়ারধারী হয়ে যান। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসেই টিডব্লিউটিএলকে নগদ পরিচালনার লোভনীয় চুক্তিটি দেওয়া হয়।
২০১৭ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে, নাহিম রাজ্জাক এমপি নেত্র নিউজকে বলেন, “টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাথে আমার সম্পৃক্ততা হলো ই-ক্যাবের (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) উপদেষ্টা হিসেবে। যেই সভা ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ পোস্ট অফিসের সেবা ডিজিটাইজ করা ও ই-কমার্স উন্নয়নের অংশ হিসেবে ই-ক্যাবের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন। অংশীজন হিসেবে ই-ক্যাব প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম।’
ই-ক্যাবের একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে নাহিম রাজ্জাক এমপি ও তানভির আহমেদ মিশুক ই-ক্যাবের সাথে যুক্ত আছেন। কিন্তু টিডব্লিউটিএল ও মন্ত্রণালয়ের ওই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সাথে ই-ক্যাবের কোনোই সম্পৃক্ততা ছিল না। তিনি বলেন, “ওই অনুষ্ঠানে ই-ক্যাবের কোনো প্রতিনিধিত্বই ছিল না।” ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, রাজি মোহাম্মদ ফখরুল এমপি সংগঠনটির সাথে যুক্ত নন। ওই ই-ক্যাব কর্মকর্তাকে অনুষ্ঠানের কয়েকটি ছবি দেখালে, তিনি বলেন অনুষ্ঠানে মাত্র দুই জন ই-ক্যাব এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে তিনি চিনতে পেরেছেন। একজন হলেন দর্শকসারিতে বসা মিশুক, অপরজন মঞ্চে বসা নাহিম রাজ্জাক এমপি।
যদিও নাহিম রাজ্জাক দাবি করেছেন যে ই-ক্যাবের উপদেষ্টা হিসেবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাথে তার কিছুটা সম্পৃক্ততা ছিল, পরক্ষণেই তিনি এসএমএসে লিখেন যে, “আমার প্রভাব খাটানোর অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন, কেননা আমি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, তথ্যপ্রযুক্তি বা টেলিযোগাযোগ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাথে সম্পৃক্ত নই। আপনারা কি আমার অযাচিত প্রভাব খাটানোর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবেন? আপনারা যদি টিডব্লিউটিএলের বিষয়ে ডাক বিভাগের কোনো অনিয়ম খুঁজে পান, দয়া করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন। এছাড়া আমি টিডব্লিউটিএলের সাথে আর জড়িত নই, ফলে আর কোনো আলোচনা এখানে অপ্রয়োজনীয়।”
তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে আইনপ্রণেতা হিসেবে তার দায়িত্ব ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স ছাড়া পরিচালিত হওয়া একটি কোম্পানির অংশীদার হিসেবে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ, এই দুইয়ের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাতের বিষয়টি তিনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন। তখন তিনি জবাবে বলেন, “একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও একটি সরকারী উদ্যোগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব দেখা দিলে, আইনপ্রণেতা হিসেবে আমার মতামতে এটি যাচাই করা হবে যে, আমরা কি একটি একচেটিয়া পরিবেশ বিবেচনা করছি, নাকি সাধারণ জনগণের মঙ্গলের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনা করছি। এটি একটি গভীর ও লম্বা আলোচনা, যা ব্যাখ্যা করতে আলাদা প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন।”
প্রক্সির মাধ্যমে পরিচালক
এই খাতের লোকজন আরেকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধেও ব্যক্তিগত লাভের জন্য নিজের পদ ও প্রভাব ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন, তিনি হলেন আশরাফুল আলম খোকন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই উপ-প্রেস সচিব নিয়মিতই টিডব্লিউটিএলের বোর্ড সভায় অংশ নেন, দৃশ্যত তার স্ত্রী রেজওয়ানা নুরের প্রক্সি হিসেবে, যিনি কোম্পানির সাত শেয়ারধারীর একজন। রেজওয়ানা নুর পূর্বে কোনো ব্যবসায়িক কাজে জড়িত ছিলেন, এমন দৃশ্যমান কোনো রেকর্ড নেই। এই কোম্পানির সাথে খোকনের সম্পৃক্ততা সরকারী চাকরি বিধির সম্ভাব্য লঙ্ঘণ।
ঢাকার বনানিতে নগদের প্রধান কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদককে বলেন যে, রেজওয়ানা নুরকে তারা কখনই তাদের কার্যালয়ে দেখেননি, যদিও তিনি টিডব্লিউটিএলের একজন শেয়ারহোল্ডার। তিনি বলেন, “তিনি একজন হাউজ ওয়াইফ। আমি তার ছবি ফেসবুকে দেখেছি, যখন খোকন সেগুলো শেয়ার করেছেন।”
কিন্তু রেজওয়ানার স্বামী ওই কার্যালয়ে নিয়মিতই যান। নগদ অফিসে প্রবেশাধিকার আছে এমন একাধিক ব্যক্তি নেত্র নিউজকে পৃথকভাবে নিশ্চিত করেছেন যে খোকন নগদ/টিডব্লিউটিএলের সকল বোর্ড সভায় অংশ নেন। এমনকি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকেন।
এই খাতে কর্মরত একজন ব্যক্তি বলেন, “খোকন, মিশুক ও [মারুফুল ইসলাম] ঝলক [নগদের আরেকজন পরিচালক] খুবই ঘনিষ্ঠ। তারা সবসময়ই একসাথে থাকেন। কোম্পানির দৈনন্দিন ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তও নেন তারা।” আমাদের হাতে আসা বিভিন্ন ছবিতে তেমন ইঙ্গিতই মিলে।
আমরা এমন প্রমাণও সংগ্রহ করেছি যে খোকন লন্ডনে তানভির আহমেদ মিশুক ও মারুফুল ইসলাম ঝলকের সাথে প্রযুক্তি ও আর্থিক সেবা সংক্রান্ত একটি সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। লন্ডনে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ওই সেমিনারটির আয়োজন করে বাংলাদেশ হাই কমিশন। সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে খোকনের নাম ছিল না। খোকনের বিদেশ সফর সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুমোদনের কোনো আদেশও আমরা খুঁজে পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হিসেবে, আর্থিক সেবা নিয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণ করা খোকনের গড়পড়তা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
এই প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য চেয়ে খোকনের সাথে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি উত্তর দেননি।
মোস্তফা জব্বারের জবাব
এই প্রতিবেদনের জন্য মন্তব্য চেয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সাথে যোগাযোগ করে নেত্র নিউজ। তিনি আমাদের জানান যে তিনি টিডব্লিউটিএল ও বাংলাদেশ ডাক বিভাগের এই অংশীদারীত্বে কোনো দুর্নীতি, প্রভাব খাটানো বা অন্য অনিয়মের ব্যাপারে অবগত নন। তিনি বলেছেন যে টিডব্লিউটিএলকে নগদ পরিচালনার কাজ দেওয়া হয়েছিল তিনি মন্ত্রী হওয়ার আগেই। তিনি বলেন, “শোনেন, এই বিষয়টা নির্ধারিত হইয়া আসছে। এইটা নির্ধারিত হয়ে আসার পরে সিমপ্লি লঞ্চিংটা আমার সময়কালে হয়েছে। সুতরাং, আমার কাছে এরকম কোনো কমপ্লেইন আসে নাই। এরকম কোনো অভিযোগ করে নাই।”
তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে এই তিন ব্যক্তি ও টিডব্লিউটিএলের বিষয়ে যেই অভিযোগ এসেছে, সেই ব্যাপারে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা। তিনি জবাবে বলেন, “আমার এখানে পদক্ষেপ নেবার মতো যদি কিছু থাকে সেই দায়িত্বটা আমার। সেটা আমি দেখবো।”
নেত্র নিউজের সাথে আলাপচারিতায় মন্ত্রী জব্বার “প্রভাব” বলতে আসলে কী বোঝায়, সেই ব্যাপারে নিজের দার্শনিক মতামতও ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “দেখেন, প্রভাব শব্দটির কোনো বস্তুগত আকৃতি নাই। কাউকে সুন্দর মুখে হাসি দেওয়াকে প্রভাব বলতে পারেন। তদবির করার জন্য প্রভাব বলতে পারেন। আপনি যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। এটাতো আসলে কোনো ভিত্তি না।”●