কভিড-১৯ প্রতিবেদন: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগড়া
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের পক্ষ থেকে কপিরাইট লঙ্ঘণের একটি অভিযোগ পেয়ে ডকুমেন্ট হোস্টিংয়ের ওয়েবসাইট স্ক্রিবড বাংলাদেশে কভিড-১৯ রোগের পূর্বাভাষ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটির একটি কপি মুছে দিয়েছে। যদিও এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুইটি বিবৃতি দিয়ে বলেছিল যে, বাংলাদেশে কভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় “কোনো গবেষণা করেনি, কাউকে করতে বলেনি বা প্রকাশও করেনি”। বিবৃতিগুলোতে আরও নিশ্চিত করা হয়েছিল যে, কভিড-১৯ প্রতিবেদনটি তৈরিতে সম্পৃক্ত থাকায় নিজেদেরই এক গবেষকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সরকার এই রোগ প্রশমন ও অবদমনে কোনো পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশে কভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাবে, ওই প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাষ দেওয়া হয়েছিল।
নেত্র নিউজে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনের সাথে স্ক্রিবডে আপলোডকৃত ওই গবেষণা প্রতিবেদনের পিডিএফ কপিটি এমবেড (যুক্ত) করে দেওয়া হয়েছিল। এই বিষয়ে স্ক্রিবডের আইনি কার্যক্রম বিষয়ক ব্যবস্থাপক নেত্র নিউজকে বলেন, “[ওই ডকুমেন্টটি] মুছে দেওয়া হয়েছে কারণ ডিজিটাল মিলেনিয়াম কপিরাইট আইন, ১৯৯৮ (ডিএমসিএ) অনুযায়ী কপিরাইট লঙ্ঘণের একটি বৈধ অভিযোগ পেয়েছে স্ক্রিবড। কোনো ডিজিটাল বিষয়বস্তু নিয়ে ডিএমসিএ নোটিশ পাওয়ার পর দ্রুত তা মুছে ফেলতে স্ক্রিবড বাধ্য।” তিনি ওই ডিএমসিএ নোটিশের একটি কপি নেত্র নিউজকে দিয়েছেন।
২৩ মার্চ মুছে ফেলার আগে পর্যন্ত ওই গবেষণা প্রতিবেদন স্ক্রিবডে ১২০,০০০ বার পড়া হয়েছিল।
এর আগে ২২ মার্চ ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ একটি বিবৃতি দেয়। প্রতিষ্ঠানটির ডিন সাবিনা ফয়েজ রশিদের স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে “বাংলাদেশে কভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি, কাউকে করতে বলা হয়নি বা প্রকাশ করা হয়নি।” সেখানে আরও বলা হয়, “যদি কোনো গবেষক ব্যক্তিগতভাবে ডিনকে না জানিয়ে বা অনুমতি না নিয়ে কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, তাহলে সেখানে স্কুলের নাম কোনোভাবেই জড়ানো যাবে না।”
এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ভিনসেন্ট চ্যাঙ্গও হুবহু একই রকমের একটি বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়েছে এবং যথাযথ শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে এই দুই বিবৃতির একটিতেও গবেষণা প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু বা সঠিকতা নিয়ে সমালোচনা করা হয়নি।
নেত্র নিউজ ব্র্যাকের একজন মুখপাত্রকে প্রশ্ন করে, যেই প্রতিবেদন ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ নিজেরা প্রস্তুত করেনি, পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি বা প্রকাশও করেনি, সেই প্রতিবেদনের কপিরাইট কীভাবে তারা দাবি করতে পারে। ইমেইলে পাঠানো এই প্রশ্নের কোনো জবাব আমরা এখনও পাইনি। এছাড়া একজন গবেষকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা ও কভিড-১৯ প্রতিবেদনটি প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নিয়েও তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল।
জনস্বার্থ বিবেচনায় ওই গবেষণাপত্রের একটি পিডিএফ কপি পুনরায় প্রকাশ করছে নেত্র নিউজ। ওই প্রতিবেদনটি প্রথম আমাদেরকে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা। আইনি পরামর্শ অনুযায়ী আমরা প্রতিবেদনের কিছু অংশ মুছে দিয়েছি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তদন্তের ঘোষণা আসার পর, পৃথকভাবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দীপক কুমার মিত্র তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানান, তিনি ওই কভিড-১৯ প্রতিবেদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। অবশ্য, গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক হিসেবে তার নাম উল্লেখ ছিল।
তবে কভিড-১৯ সম্পর্কিত গবেষণা সহযোগিতার বিষয়ে ফেসবুকে তার সঙ্গে মূল লেখক মলয় কান্তি মৃধা (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়) ও আরেক লেখক এলেইন ল্যাব্রিকের (জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়) মধ্যে প্রকাশ্যেই কথাবার্তা হয়েছিল। এ বিষয়ে নেত্র নিউজ তাকে প্রশ্ন করলে তিনি নিশ্চিত করেন যে, প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী সহযোগীদলের অন্যতম ছিলেন তিনি। নেত্র নিউজের সঙ্গে কথা বলার পর দীপক মিত্র ওই বিবৃতি নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সরিয়ে ফেলেন। এ বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।
অপরদিকে জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের একজন মুখপাত্র ইমেইলে নিশ্চিত করেন যে, ওই কভিড-১৯ প্রতিবেদন প্রস্তুতে তারা কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, “জন্স হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিভাগের দুই শিক্ষক এই গবেষণায় সহযোগিতা করতে সম্মত হন। তারা প্রতিবেদন সম্পাদনা ও কিছু মন্তব্যও প্রদান করেন। তবে প্রতিবেদনের প্রাথমিক ও পিয়ার-রিভিউ না হওয়া সংস্করণে তাদের গবেষণা অবদান প্রতিফলিত হয় নি। তাই এই প্রতিবেদনের ফলাফল নিয়ে আমাদের শিক্ষকরা এখনই কথা বলতে পারবেন না। তবে আমাদের শিক্ষকগণ কভিড-১৯ মহামারীর বিভিন্ন জরুরী বিষয় যেমন সংক্রমণ হার, হাসপাতালে ভর্তির হার, মৃত্যুর হার, নিয়ন্ত্রণের কৌশল ইত্যাদি নিয়ে প্রমাণ-ভিত্তিক ও উপাত্তমাফিক গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রস্তুতে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে একযোগে কাজ করা অব্যাহত রেখেছেন।” এ বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা চাইলে তিনি আর মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
তবে কভিড-১৯ সংকট চলাকালে বিশ্বব্যাপীই জনস্বার্থ বিবেচনায় যত দ্রুত সম্ভব গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে। ফলে ক্লিনিক্যাল গবেষণা ও ভাইরাস বিষয়ক মডেলিং এখন সম্পূর্ণ পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়া না হতেই প্রাথমিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ইউএসএআইডি সম্প্রতি জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়কে ৫ লাখ ডলার সহায়তা প্রদান করে। সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্য হলো “বাংলাদেশে কভিড-১৯ নিয়ে বৃহত্তর সচেতনতা তৈরিতে গবেষণা উপকরণ, বিশেষ করে সরাসরি এ নিয়ে সম্পৃক্ত স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রস্তুত ও বিতরণ করা।” এই অনুদানের আওতায় জন্স হপকিন্সের প্রকল্প কর্মীরা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সরাসরি ব্যবস্থাপনায় কভিড-১৯ টেলিফোন হেল্পলাইনের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে কাজ করবেন। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত আচরণগত পরিবর্তন ও যোগাযোগ বিষয়ে ইউএসএআইডির অর্থায়নে পৃথক একটি প্রকল্পেও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।●
🔗 করোনাভাইরাসের পূর্বাভাষ রিপোর্ট তৈরি করে বিপাকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক