বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ সংক্রমণ কি বাংলাদেশে?
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণে অস্বাভাবিক উচ্চ মৃত্যুর হার পর্যালোচনা করে ইঙ্গিত মিলছে যে, সরকার যা বলছে প্রকৃতপক্ষে সংক্রমণের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী এ মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত মোট ৯২০ জন মানুষের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৪ জনের দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মারা গেছেন পাঁচ জন। শতকরা হিসাবে মৃত্যু হার দাঁড়ায় ১১.৩%। যার অর্থ হচ্ছে, আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রতি ১০ জনে ১ জনের। যদি সরকারের দেয়া এই পরিসংখ্যান সত্য হয়, তাহলে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী। যদিও সংখ্যায় এখনো কম, কিন্তু এ মৃত্যু হার কভিড-১৯ রোগে বৈশ্বিক গড় মৃত্যু হারের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশী। যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যু হারের চেয়ে আটগুণ বেশী। ২৬ মার্চ পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণে বৈশ্বিক মৃত্যু হার হলো ৪.৪%, আর যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১.৪%। এ ভাইরাস সংক্রমণে বাংলাদেশের কাছাকাছি মৃত্যু হার রয়েছে একমাত্র ইতালির (১০%)।
এতো উচ্চ মৃত্যু হারের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যাখা হতে পারে যে, বাংলাদেশে ভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের একটি বড় অংশের কোন পরীক্ষাই করা হয়নি। মৃত্যুর এই সংখ্যার ভিত্তিতে বলা যায়, আরও বেশি সংখ্যক সংক্রমন ধরা পড়লে, মৃত্যু হার কম হতো। তাহলে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা যদি পাঁচই হয়, কিন্তু মৃত্যু হার যদি অন্যান্য দেশের মতোই হয়, তাহলে বাংলাদেশে প্রকৃত সংক্রমনের সংখ্যা কতো হবে? যদি ধরে নেই যে, বাংলাদেশের মৃত্যু হার বৈশ্বিক গড় মৃত্যু হারের সমান, তাহলে বাংলাদেশে ২৬ মার্চ কোভিড-১৯ সংক্রমনের সংখ্যা হতো ১১৩। আর মৃত্যু হার যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো হয়, তাহলে ২৬ মার্চ সংক্রমনের সংখ্যা হতো ৩৫৭।
আনুষ্ঠানিক সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংক্রমিতের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এ কারণে যে, সরকার আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরীক্ষার জন্য শুধু রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপর নির্ভর করছে। পরীক্ষা শুধু তাদেরকেই করা হচ্ছে যাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়া লক্ষণ পরিষ্কারভাবে বিদ্যমান, যারা বিদেশ থেকে এসেছেন বা ইতোমধ্যে পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন এমন কারো সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। সোজা কথায় বললে, কোভিড-১৯ ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে এখনো খুবই কম।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষকদের উদ্ভাবিত মডেলিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষকদের একটি দল বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ, চিকিৎসা ব্যবস্থায় এর চাপ ও সম্ভাব্য মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে একটি পূর্বাভাস প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
মার্চ ২৬ অবধি সংক্রমন ও মৃত্যুর সংখ্যা কত হতে পারে, তা নিয়ে ওই পূর্বাভাস প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে?
এখানে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় মনে রাখতে হবে। তা হলো, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা, অর্থাৎ রোগ দমন বা প্রশমনে সরকার কোন ব্যবস্থা না নিলে কী হবে তা ধরে নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া গবেষণা প্রতিবেদনটির এখনো পিয়ার রিভিউও হয়নি।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ১৮ মার্চ। প্রতিবেদনে ধরে নেয়া হয় যে, বাংলাদেশে মহামারীটির যাত্রা শুরু হয় তারও ছয় সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ২ ফেব্রুয়ারী দেশে ঢোকা এক ব্যক্তির মাধ্যমে। অনুমান করা হয় যে, প্রত্যেক আক্রান্ত ব্যক্তি গড়ে আরো ২.৪ জনের কাছে ভাইরাসটি ছড়াবেন। সেই হিসাবে, প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, এভাবে ছড়াতে থাকলে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ৩২,০৩১ জন আক্রান্ত হওয়ার কথা। এদের মধ্য ৮,০৬৫ জনের শরীরে রোগের লক্ষণ দেখা যাবে, ১০৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, ৫ জনের নিবিড় পরিচর্যা দরকার হবে ও ২ জন মারা যাবেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন যে, পূর্বাভাস প্রতিবেদনে মৃত্যুর যেই সংখ্যা অনুমান করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রকৃত মৃত্যু সংখ্যা তার দ্বিগুণ! এ থেকে ইঙ্গিত মিলে যে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পাঁচ লাখ লোকের মৃত্যু হতে পারে বলে গবেষকরা যেই পূর্বাভাস দিয়েছেন, তাতে আসলে প্রকৃত ভয়াবহতা কমই ফুটে উঠেছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ ভাইরাসে বাংলাদেশে পাঁচ জনের মৃত্যু হবে ৩০ মার্চ নাগাদ।
সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকার এখন যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে তার কী ধরণের প্রভাব পড়বে?
পূর্বাভাস প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট করে এই প্রশ্নটির কোন উত্তর নেই। তবে ইম্পেরিয়াল কলেজের মূল গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রনমূলক কৌশলের বিপরীতে ফলাফল কী হতে পারে, তারও পূর্বাভাস ছিল। যেমন, স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হলে; যেসব রোগীর লক্ষণ দৃশ্যমান তাদেরকে সাত দিনের জন্য ঘরে অন্তরীন রাখা গেলে; যেই পরিবারের একজনের লক্ষণ দেখা দিয়েছে সেই পরিবারের সব সদস্যের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেলে; পুরো দেশে সামাজিক বিচ্ছিনতা ও দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলে; এবং শুধু সত্তরোর্দ্ধদের জন্য ১৪ দিনেরও বেশী সময়ের জন্য বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করা গেলে; ভাইরাসে সংক্রমণের হার ও মৃত্যু হার কত কমবেশি হতে পারে, সেই হিসাব করা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে যে, যুক্তরাজ্যে এসব কৌশল বাস্তবায়ন করা গেলে, মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পেতে হলে, এই কৌশলগুলো উল্লেখ্যযোগ্য সময় পর্যন্ত প্রয়োগ করতে হবে।
এটি স্পষ্ট নয় যে, বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনায় এই কৌশলগুলো এই দেশে কতটা কাজে আসবে। তবে, ইম্পেরিয়াল কলেজের মডেল সকল দেশের জন্যই এই পরামর্শ দেয় যে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর সুনামি এড়াতে হলে, সু-সমন্বিত ও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে যতদিন সম্ভব সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।●
* এই কলামটি ২৬ মার্চ প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।
ডেভিড বার্গম্যান নেত্র নিউজের ইংরেজী বিভাগের সম্পাদক।
🔗 Covid-19: Without government action, over 500,000 may die in Bangladesh
🔗 Impact of non-pharmaceutical interventions (NPIs) to reduce COVID19 mortality and healthcare demand