জেনারেল আজিজ আহমেদকে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগের বিষয়টি পুনরায় জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে জেনারেল সারওয়ার্দীর সাক্ষাৎকার
এই কলামটি লেখার সময় খবর আসছিলো যে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীকে আটক করার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছে ৱ্যাব-১। সারওয়ার্দী গত মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) এক ফেসবুক লাইভ সাক্ষাৎকারে সরকারের সমালোচনা ও সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে দোষারোপ করে বক্তব্য দেন। সারওয়ার্দী বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য চাইছেন মর্মে নেত্র নিউজ একদিন আগে খবর প্রকাশ করে।
সারওয়ার্দী আটক হলে দেখার বিষয় হবে তাকে গুম করা হচ্ছে (সেক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলো তাকে তুলে নেবার বিষয় সম্পূর্ণ অস্বীকার করবে), নাকি আনুষ্ঠানিক গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে, যেক্ষেত্রে খুব সম্ভব ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) এর অধীনে কোন মামলা দিয়ে তাকে আদালতে হাজির করা হবে। ডিএসএ আইনে অপরাধ এর পরিধি এতই বিস্তৃত যে সরকারকে যেমন সমালোচনাই করা হোক না কেন তা এর অধীনে নিয়ে আসা সম্ভব।
কিন্তু পরিস্থিতির আলোকে সারওয়ার্দীকে গুম করা খুব সহজ হবে না। প্রথমত, সারওয়ার্দী “নিখোঁজ” হয়ে গেলে তাতে সরকারের কোনো হাত নেই এমন অদ্ভুত দাবি রাষ্ট্রপক্ষকে করতে হবে, যেখানে একথা জানাজানি হয়ে গিয়েছে যে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এছাড়াও আরেকটি কারন হলো বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনৈতিক মহল সরকারকে এমন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবার জন্য কঠোর চাপ প্রয়োগ না করে থাকলেও অন্ততপক্ষে সতর্ক করেছে নিঃসন্দেহে।
সারওয়ার্দীর জন্য যে ভাগ্যই রাষ্ট্রপক্ষ নির্ধারণ করুক না কেন, বর্তমান অবস্থা মোকাবেলায় অতীতে ব্যবহৃত সব কায়দা-কানুনই পরিস্থিতি অনুসারে প্রয়োগে সচেষ্ট হবে সরকার। সারওয়ার্দীকে দুষ্কৃতকারী এবং সহমর্মিতা পাবার অযোগ্য প্রমান করতে তার বিরুদ্ধে বানোয়াট এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আসতে শুরু করবে সরকারি কর্মকর্তা, আওয়ামী-সমর্থক সংবাদমাধ্যম ও গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন ভূয়া ওয়েবসাইট থেকে। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে তার নিজের মতামত প্রকাশ করছেন এমনভাবে যেন সারওয়ার্দীকে কোনক্রমেই মানুষ না দেখে তাই চাইবে কর্তৃপক্ষ।
সারওয়ার্দীর পরিস্থিতি — সরকারের সমালোচনার ফলে বিপদে পড়া — বাংলাদেশের সার্বিক বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্ত্বমূলক। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
প্রথমত, সারওয়ার্দীর ক্ষেত্রে যা ভিন্ন তা হলো তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য। শুধু তাই না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিনিয়র একজন সেনা কর্মকর্তা। ২০১৮ তে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক এর স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য অনেকেই তাকে অন্যতম প্রধান প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু সেনাপ্রধানের পদ শেষপর্যন্ত পেয়েছেন জেনারেল আজিজ আহমেদ। সিনিয়র কোনো সেনা কর্মকর্তা সরকারের বিরুদ্ধে ও উপবিষ্ট সেনাপ্রধান কে নিয়ে এত তীব্র সমালোচনা করেছেন, তাও অবসরপ্রাপ্ত হবার পর এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে, এমন কোন নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই।
দ্বিতীয়ত, সারওয়ার্দীর এই সাক্ষাৎকার এর ফলে যা হয়েছে তা হলো সেনাপ্রধান পদে জেনারেল আজিজ এর প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিয়োগের বিষয়টি আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে, প্রধানত, তার আপন তিন ভাই ২০০৪ এ একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হয়েছিল সে প্রেক্ষিতে। উপরন্তু, এই ভাইদের মধ্যে আনিস আহমেদ এবং হারিস আহমেদ বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। তৃতীয় ভাই, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, যিনি হত্যার অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধান নিযুক্ত হবার ঠিক এক মাস আগে। যদিও স্বাভাবিকভাবে জেনারেল আজিজ তার ভাইদের অপরাদের জন্য দোষী হতে পারেন না, তবু এ বিষয়টি বেশ আশ্চর্যজনক যে প্রধানমন্ত্রী এমন কাউকে সেনাপ্রধান পদে নিযুক্ত করবেন যার পরিবারে এমন অপরাধ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। জেনারেল আজিজকে কখনো তার দুই পলাতক ভাই এর অবস্থান সম্পর্কে কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে?
জোসেফ যখন ২০১৯ সালে ক্ষমা পায়, তার ভাই জেনারেল আজিজ তখনও সেনপ্রধান নিযুক্ত হন নি, সেসময় সংবাদমাধ্যমে জোসেফের সাথে জেনারেল আজিজের সম্পর্ক নিয়ে কিছু খবর প্রকাশ হয়। কিন্তু আজিজের নিয়োগের পর থেকে মিডিয়াতে আর কিছুই লেখা হয়নি।
এর আলোকে জেনারেল আজিজের ভাইদের নিয়ে সারওয়ার্দী যে মন্তব্য করেছেন তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এমন সব বিষয় উন্মুক্ত করে দিয়েছেন যা সেনাপ্রধান এবং সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চেয়েছিল। সাক্ষাৎকারে যেমন তিনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন যাতে প্রকাশ পায় কিভাবে জোসেফ তার মুক্তির পর থেকে পুলিশ প্রহরা সহ ভিআইপি মর্যাদা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ সুবিধা যে সে জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই হবার সুবাদেই পেয়ে থাকে বলে সহজেই অনুমেয়।
তৃতীয়ত, যে কারনে সারওয়ার্দীর বিষয়টি আলাদা, তা হলো এ ঘটনার একটি আন্তর্জাতিক দিক রয়েছে। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে একটি বিরাজমান বিভাজন হলো ভারতপন্থী ও চীনপন্থী বিভক্তি। বাংলাদেশী রাজনীতির ভাষায় জেনারেল আজিজ ভারতপন্থী হিসেবেই পরিচিত এবং সারওয়ার্দীকে দেখা হয় চীনপন্থী হিসেবে। ভারতীয় সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক দলটিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকিয়ে রাখবার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ভারত ও চীনের মধ্যকার সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অস্থিরতায় এ সম্পর্ক এখন সমস্যায় পতিত।
সারওয়ার্দীর ভারত সমালোচনা — বিশেষত তার দাবি যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নিয়োগ, যেমন “গোয়েন্দা সংস্থা, সেনাপ্রধান নিয়োগ, সচিবদের বদলি ইত্যাদি” নিয়োগ তাদের ইচ্ছামাফিক ঘটাবার (“ম্যানিপুলেট” করার) চেষ্টা করে — এসকল বক্তব্য বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এখন বিশেষ তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকেই সারওয়ার্দী এই সাক্ষাৎকারটি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তেমনটি মোটেই অসম্ভব নয়। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে সরকারের ভেতরে অনেকেই এ ঘটনাকে চীনপন্থী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখবে। এমন চিন্তা যদিও আপাত অধিক-কল্পনা ও সীমিত-বাস্তব বলেই মনে হবে, তারপরও অনেকেই এমনটি বিশ্বাস করবে, অন্যদিকে অনেকেই এ অজুহাতে সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এতে করে এই সাক্ষাৎকারের ঘটনা ও এতে যা বলা হয়েছে তা বাংলাদেশ সরকারের জন্য বেশ নাজুক একটি বিষয় হয়ে দেখা দিবে।●
ডেভিড বার্গম্যান নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।
🔗Netra News Blog: ফেসবুক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান ও সরকারের সমালোচনার পর আত্মগোপনে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল
🔗Netra News: ওরা ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলার যত সমস্যা