সেদিন যা দেখেছিলাম ঝিগাতলায়

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যেভাবে দমন করা হয় — আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এক প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীর বয়ান। আলোকচিত্রী জীবন আহমেদের তোলা ছবিসহ।

সেদিন যা দেখেছিলাম ঝিগাতলায়
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আগস্ট ২০১৮। ফটো : জীবন আহমেদ

এইচএসসির পর আমি ঢাকায় ছিলাম না। তখন একটি ব্যাক্তিগত কারণে ঢাকায় এসেছি। দেখলাম স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে ইনসাফের জন্য। একটি ন্যায্য সড়ক পরিবহন আইনের জন্য৷ আমার নিজের স্কুল-কলেজের জুনিয়ররা পর্যন্ত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। স্লোগান দিয়ে কাঁপাচ্ছে ময়দান। তখনই ইচ্ছা হলো আমিও যোগ দিই ওদের সাথে। ঠিক এইভাবেই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া৷

৪ আগস্ট ২০১৮। সকাল ১০ টায় সাইন্সল্যাব মোড়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়। নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খানের পদত্যাগ দাবি করা হয়। সড়ক পরিবহণ আইন সংশোধনেরও দাবি তোলা হয়।

সকাল ১১.৩০ টার দিকে খবর এলো, ঝিগাতলায় কয়েকজন মিলে এক কলেজ ছাত্রকে মারধর করেছে। সবাই মিলে আমরা সেদিকে গেলাম। অনেক খুঁজেও কারা মারধর করেছে, তাদের বের করতে পারলাম না। তবে আহত শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে নেওয়া হলো। ওই স্থানে আবার যানবাহনগুলো নিয়ম মানছিলো না। তাই শিক্ষার্থীদের কয়েকটি গ্রুপ মিলে গাড়িগুলোকে নিয়ম মানতে বাধ্য করছিলো। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আগস্ট ২০১৮। ফটো : জীবন আহমেদ

দুপুর ১২.৩০ টার ঘটনা। আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি দলীয় কার্যালয়ের বাইরে নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছিলো আগে থেকেই। আন্দোলনের অনেক শিক্ষার্থীই ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় ছিলো না। এরকম একজন শিক্ষার্থীকে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী জেরা করা শুরু করে। “তোর স্কুল ড্রেস কই? তুই শিবির!”— এই কথা বলেই ছাত্রটির গায়ে হাত তোলে। ঘটনাস্থলে এক দম্পতি ছাত্রটিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে ওই আওয়ামী লীগ কর্মী তাদের ধাক্কা দেয়। সেখানেই একচোট হাতাহাতি শুরু হয়।

ওদিকে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের বাইরে কয়েকজন নেতাকর্মী শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলে। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়। তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ করে। ঠিক সেই মুহূর্তে পার্টি অফিসের ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী লাঠি হাতে ধাওয়া করে শিক্ষার্থীদের।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আগস্ট ২০১৮। ফটো : জীবন আহমেদ

কিন্তু শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় ছিলো অনেক বেশি। তারা রোড ডিভাইডারের স্টিল আর বাঁশ তুলে নিয়ে নেতাকর্মীদের পাল্টা ধাওয়া করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হেলমেট পরা কয়েকজন নেতাকর্মী পিস্তল দিয়ে গুলি ছোঁড়ে। গোলাগুলির মুহুর্মুহুঃ শব্দে শিক্ষার্থীরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

শিক্ষার্থীরা সাইন্স ল্যাবের দিকে দৌঁড়াতে শুরু করে। এদের মধ্যে অনেকে আবার পিলখানার ৪ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করতে যায়। পিলখানার দু’টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়া স্বত্বেও, শিক্ষার্থীদের গেট দিয়ে ঢুকতে দেয়নি বিজিবি। তখন হুড়োহুড়ির কারণে বেশ কয়েকজন বাজেভাবে আহত হয়।

দুপুর ১২.৩০ থেকে দুপুর ২.৩০ পর্যন্ত এভাবেই খণ্ড খণ্ড ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া চলতে থাকে।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ কিছু শিক্ষার্থীদের (ছেলে ও মেয়ে) বাজে ভাবে মারধর করে। তখন অনেক শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হয়। এদের অনেককে পপুলার মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আগস্ট ২০১৮। ফটো : জীবন আহমেদ

দুপুর ২.৩০-এর দিকে বৃষ্টি শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা সাইন্সল্যাবে আটকা পড়ে। তারা ঝিগাতলার দিকেও এগোতে পারছিলো না। কারণ ঝিগাতলার দিক থেকে পুলিশ ছাত্রদের ওপর টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে পিছু হটতে বাধ্য করে। আবার নিউমার্কেটের দিকেও যাওয়া যাচ্ছিলো না, কারণ সেদিকে ততক্ষণে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়।

বেলা ৩.৩০-এ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সাইন্সল্যাবে এসে উত্তেজিত স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে৷

বিকেল থেকে সড়কে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। সন্ধ্যা অবদিও শিক্ষার্থীরা সেখানে ছিল। কিন্তু পুলিশ ও ছাত্রলীগ মিলিতভাবে ছাত্রদের উপর হামলে পড়ে। পুলিশ কখনও ছিল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায়, পরক্ষণেই আবার নেমে পড়ে নির্যাতকের ভূমিকায়। বিকেল থেকে ক্যামেরা বা স্মার্টফোন হাতে থাকা লোকজনের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটতে থাকে। নারী সাংবাদিকের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশের প্রত্যেক আন্দোলন বা সংগ্রামে সাংবাদিকদের সাধারণত উভয় পক্ষই ছাড় দিতো। অথচ, এই আন্দোলনে ছাত্রলীগের কর্মীরা সাংবাদিক বা ক্যামেরা হাতে থাকা যে কাউকেই বেদম পিটুনি দিয়েছে। এসব পিটুনির ছবি সারাবিশ্ব দেখেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা ফটোসাংবাদিকরাও রেহাই পাননি। এমনকি পুলিশও অনেক সাংবাদিককে আটক করে ও প্রহার করে।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা পার্টি অফিসের গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছে। তারা অফিস রক্ষার্থে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ করে। তবে তাদের দাবিটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।

যে সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো, তাদের বেশিরভাগের বয়সই ছিলো ১৮ বছরের কম৷ বছর বছর শিবির তকমা দিয়ে ছাত্র নির্যাতনের ইতিহাস তো অনেক পুরোনো। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের এভাবে তকমা দিয়ে পেটানোর নজির আগে ছিল না।

বরং, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এতটা নোংরা রূপ ধারণ করেছে যে, সরকারি দলের নেতাকর্মীরা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তুললো, তাদের রক্তাক্ত করলো, আর এটা নিয়ে কোনো আইনি তৎপরতা দেখা যায়নি। সেদিন নির্দয়ভাবে সাংবাদিকদের যেভাবে পেটান হলো, তারও কোনো বিচার হয়নি। সেদিন পার্টি অফিসে অবস্থান করা যে সকল নেতারা শিক্ষার্থীদের উপর হামলার নির্দেশ দিয়েছিলো, তাদের কখনোই বিচারের আওতায় আনা হয়নি।●

কাজী মেহেদী হাসান জয়, শিক্ষার্থী ও সংগঠক।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আগস্ট ২০১৮। ফটো : জীবন আহমেদ