আমার অভিজ্ঞতা: মাদ্রাসায় যেভাবে বলাৎকারের শিকার হয়েছিলাম
মায়ের মানত রক্ষায় হাফেজ বানাতে কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়েছিলো লেখককে। সাত বছরে দুইটি মাদ্রাসায় পড়ে তিনি হাফেজ হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বলাৎকারেরও শিকার হয়েছিলেন একাধিকবার।
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অনেকের অনেক রকম সমালোচনা আছে। তবে এখানে আমি সুনির্দিষ্টভাবে কেবলমাত্র কওমি মাদ্রাসা নিয়ে লিখব। কারণ আমার অল্পবিস্তর যে অভিজ্ঞতা, তা কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক। আরও নির্দিষ্ট করে যদি বলি, কওমি মাদ্রাসাগুলোতে যে ছাত্ররা বলাৎকারের শিকার হয়, সে বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরা এবং এর কারণ খুঁজে দেখাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
আমি প্রায় সাত বছর কওমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছি। এই সময়টায় আমি বগুড়া শহরের দুটি মাদ্রাসায় থেকেছি। কওমি মাদ্রাসাগুলো সাধারণত দুই রকমের হয়। এক ধরনের কওমি মাদ্রাসা আছে যেগুলোতে গরিব বা এতিম ছাত্রদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এগুলো পরিচালিত হয় লিল্লাহ বোর্ডিং বা সম্পূর্ণ দানের ভিত্তিতে। আরেক ধরনের কওমি মাদ্রাসা আছে যেগুলো মূলত বিত্তবানদের সন্তানদের জন্য পরিচালিত হয়। আমার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খানিকটা ভালো বলে আমাকে বিত্তবানদের জন্য যে মাদ্রাসাগুলো রয়েছে, সেগুলোর একটাতে ভর্তি করা হয়। আমি এ রকম মোট দুটি মাদ্রাসায় থেকে লেখাপড়া করেছি।
আমরা জানি এসব মাদ্রাসায় ছাত্রদের ওপর কতরকমভাবে নির্যাতন চালানো হয়। সত্যি কথা বলতে, আমি এসব মাদ্রাসা চলতে দেওয়ারই পক্ষে না। খুব অবাস্তব শোনালেও একই কথা আমাদের দেশের মূল ধারার বিদ্যালয়গুলোর বেলায়ও খানিকটা সত্যি। তবে বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা মাদ্রাসাগুলোর মতো এখনও অতটা নেতিবাচক পর্যায়ে পৌছেনি।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য আমি। জন্মের পর অনেকদিন পর্যন্ত আমি কথা না বলায় আমার মা মানত করেন যে, আমাকে পবিত্র কোরআন শরীফে হাফেজ বানাবেন। এই মানতের কিছুদিন পরই আমি কথা বলা শুরু করলে, আমার মায়ের জন্য প্রতিজ্ঞা রক্ষা করাটা অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।
আমি সম্পূর্ণ কোরআন শরীফের ওপর হাফেজ হতে প্রায় সাত বছর মাদ্রাসায় অতিবাহিত করি। এ সময়টায় আমি পাঁচ বার বলাৎকারের শিকার হই। আমার জীবনের এই ঘটনাগুলো আমি একটা লেখায় আগেই বর্ণনা করেছি। তাই এখানে আর সে বিষয়ে দীর্ঘ বর্ণনায় যাব না (আগ্রহী পাঠক নিচে দেওয়া লিংকে এ বিষয়ে আমার পুরানো লেখাটা পাবেন)।
আগেই বলেছি, সাত বছরে আমি দুটি মাদ্রাসায় থেকেছি। প্রথম মাদ্রাসায় আমি এক দিনেই তিনবার বলাৎকার হই। দ্বিতীয় মাদ্রাসায় পৃথকভাবে দুইবার বলাৎকার হই। প্রথমবার একজন আমার চেয়ে বয়সে বড় ছাত্র আর দ্বিতীয়বার একজন হুজুরের কাছে বলাৎকার হই।
২০১৯ সালের ৭ জুলাই আমার ফেসবুক ওয়ালে এ ঘটনাগুলো নিয়ে একটা লেখা পোস্ট করি। তখন লেখাটি নিয়ে অনলাইনে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। আমি লেখাটি লিখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী, আমার বড় ভাই স্থানীয় হুজায়ফা আল মামদুহ নেহাল ভাইয়ের উৎসাহে।
নেহাল ভাই জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মাদ্রাসা বিষয়ক বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন ফেসবুকে। সেই লেখাগুলোতে মাদ্রাসার এ রকম কিছু ঘটনা উঠে আসে। সেই লেখাগুলোর একটির নীচে একজন মন্তব্য করেন, মাদ্রাসায় আসলে এগুলো ঘটে না। ঘটলে ভুক্তভোগীদের দিক থেকে প্রতিবাদ হতো। এই মন্তব্যটা আমি মানতে পারিনি। এরই প্রতিক্রিয়ায় আমি আমার লেখাটি লিখি। আমি লেখার পর আরও অনেকেই তাদের এ রকম বলাৎকারের শিকার হওয়ার কথা প্রকাশ করে লেখালিখি করেন। আমার এক বন্ধুও তার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি লেখা লেখে। এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন নেহাল ভাইয়ের মাধ্যমে তাদের জীবনে ঘটা এ রকম বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
এই যে অসংখ্য ছেলের বলাৎকারের শিকার হওয়া একটি অন্ধকার জগৎ, তার ভিতর থেকে এই যে আমরা কয়েকজন খানিকটা সাহস করে নিজেদের কথা বললাম, এতে নিজেদের কথা বলা আমরা সবাই নতুন কিছু মিশ্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। বহু মানুষ, যারা মুক্ত একটি সমাজ কামনা করেন, তারা আমাদের বাহবা দিলেন। কিন্তু মোটাদাগে আসলে আমরা সবাই নিজেদের কথা প্রকাশ করায় প্রচণ্ড তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হলাম। নানারকম অপপ্রচারের শিকার হলাম।
যারা নেহাল ভাইকে চেনেন, তারা জানেন নেহাল ভাই একজন অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ। কিন্তু তাকেও “ইহুদী-নাসারাদের দালাল” বলে অভিহিত করা হলো। আমাদেরকে “নাস্তিক, ইহুদী-নাসারাদের দালাল” বলে গালিগালাজ করা হলো। আমাদের এই সত্য প্রকাশকে “ইহুদি-নাসারাদের ষড়যন্ত্র” বলে আখ্যায়িত করা হলো।
আর সবচেয়ে কষ্টকর বিষয়টা হলো, নেহাল ভাই মাদ্রাসার এ সব ব্যাপার নিয়ে লেখালেখি করে শুধু সমালোচনার মুখেই পড়েননি। তিনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন আরও বেশি। কিছুদিনের মধ্যেই নেহাল ভাইয়ের একটি চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। দেশের একটি নামকরা পত্রিকায় শিক্ষানবীশ প্রতিবেদক হিসেবে। এটা হতে পারত তার জীবনের অত্যন্ত আনন্দের একটি দিন। কিন্তু চাকরিতে যোগদানের ঠিক একদিন আগে ফোন করে ওই পত্রিকার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরিতে যোগ দিতে নিষেধ করে। ওই পত্রিকায় নেহাল ভাইয়ের একজন বন্ধু আগে থেকেই চাকরিরত ছিলেন। তিনি জানান, নেহাল ভাইয়ের মাদ্রাসা সম্পর্কিত লেখালেখি প্রভাবশালী মহলের কিছু মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। তার এসব লেখালেখি অনেকের স্বার্থে আঘাত হেনেছে। এর ফলস্বরূপ নেহাল ভাইয়ের ক্যারিয়ারে এই আঘাত আসে৷
আমার সেই লেখাটি ফেসবুকে পোস্ট করার পর ফরাসি নিউজ এজেন্সি এএফপির বাংলাদেশ প্রতিনিধি শফিকুল আলম ভাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি প্রতিবেদন করেন। সেই প্রতিবেদন হিন্দুস্তান টাইমস, ডনসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নিউজ সাইটে ছাপা হয়। কিন্তু বাংলাদেশি মূলধারার সংবাদ সংস্থাগুলো এ সময় ছিল রহস্যময়ভাবে নীরব। অথচ এটা বাংলাদেশের সংস্থাগুলোতেই বেশী গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল।
এইসব অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ কিছু উপলব্ধি এনে দিয়েছে। ইউরোপের চার্চগুলো একটা সময় সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতো। বাংলাদেশের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোও যেন সেরকম এখন ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মসজিদ-মাদ্রাসা কেন্দ্রীক ক্ষমতা চর্চার ব্যাপারটা তো বেশ স্পষ্টই। স্থানীয় পর্যায়ে মসজিদ-মাদ্রাসা কেন্দ্রীক ক্ষমতা চর্চার প্রবণতা এদেশে খুবই প্রকট। মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোর কমিটিতে কারা থাকে সেদিকে লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়।
মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোতে ছোট ছোট ছেলে শিশুরা কেন এভাবে বলাৎকারের শিকার হচ্ছে, সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। মাদ্রাসাগুলোতে কোন ছেলেরা কাদের কাছে বলাৎকার হচ্ছে, তা ভেবে দেখা জরুরী। আমার অভিজ্ঞতায় আমি কয়েক ধরনের বিষয় খেয়াল করেছি৷ আমি দেখেছি, সাধারণত অপেক্ষাকৃত সবল ছাত্রদের কাছে দুর্বল ছাত্ররা বলাৎকার হয়। আবার মাদ্রাসাগুলোতে যে খাদেমরা থাকেন, তাদের কাছেও ছাত্ররা বলাৎকারের শিকার হয়। আবার, হুজুরদের দিয়েও ছাত্রদের বলাৎকার হতে দেখেছি।
হুজুরদের দ্বারা ছাত্রদের বলাৎকার হওয়ার একটা কারণ হতে পারে, এসব মাদ্রাসায় যেহেতু হুজুরদের সঙ্গে তাদের স্ত্রীদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদাটা এসব হুজুর বলাৎকারের মাধ্যমে বিকৃত পথে মেটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু যেসব অবিবাহিত খাদেম এবং ছাত্ররা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে, তারা কেন এসব করছে? এদের তো বিয়ের মাধ্যমে যৌন চাহিদা পূরণের যে অভ্যাসও গড়ে ওঠে, তাও গড়ে ওঠেনি যে সেই চাহিদা পূরণের প্রশ্ন আসবে। আর চাইলেই তো তারা যৌন চাহিদা হস্তমৈথুনের মাধ্যমেও পূরণ করতে পারে। এরপরও কেনো এরা এই জঘন্য বিকৃত পদ্ধতি বেছে নিচ্ছে? আমার মনে হয়, বিষয়টা বুঝতে হলে কেবল যৌন চাহিদা পূরণের দিক থেকেই ঘটনাগুলো বিচার করলে হবে না। এ অবস্থায় ঘটনাগুলোকে ব্যক্তির ক্ষমতা চর্চার নিরিখেই বিচার-ব্যাখ্যা করতে হবে। আর তখনই এই সব বলাৎকারের ঘটনাকে সমাজের আর দশটা ধর্ষনের ঘটনা থেকে আলাদা করা যায় না।
পুরুষ কর্তৃক নারী ধর্ষনের ঘটনায় যেমন থাকে পুরুষের বিকৃত যৌন চাহিদা পূরনের বিষয়, তেমনি থাকে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য দেখানোর প্রবণতাও। আর ধর্ষনকারী পুরুষদের বিষয়ে যদি একটু খোঁজ নেওয়া যায়, তাহলে দেখতে পাই, এ সব পুরুষেরা শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌনভাবে অবদমিত থাকে। ফলে এরা দুর্বলের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের উপায় হিসেবে ধর্ষনের মতো জঘন্য অপরাধকে বেছে নেয়৷ মাদ্রাসার এই সব বলাৎকারের ঘটনাগুলোকেও অবদমিত শারীরিক, মানসিক ক্ষমতা জাহিরের বিকৃত ক্রাইটেরিয়ার বাইরে ভাবলে হবে না।
আর সব ক্ষেত্রেই সমাজের বা রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কের প্রশ্নটি উঠে আসে। সেখানে মাদ্রাসার হুজুরেরা সমাজ বা রাষ্ট্রের বাইরের কোনো সত্ত্বা না। তাই এই সব ঘটনায় কেবলমাত্র মাদ্রাসার হুজুর বা মোল্লাদের দোষ দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এতে মূল সমস্যাকে আড়াল করা হবে। একটা মর্যাদাবোধ সম্পন্ন সাম্যের সমাজ ছাড়া তাই এসব সমস্যার কোনো সমাধান দেখি না। আর সেই সাম্যটা হতে হবে অর্থনৈতিক, ক্ষমতাকেন্দ্রীক এবং মানবিক মর্যাদাভিত্তিক। কাল্পনিক শোনালেও বাস্তবতা এটাই, জোরজবরদস্তিতে আসলে কোনো সমস্যার সমাধান আসে না।●
মোস্তাকিম বিল্লাহ মাসুম বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে ইংরেজি ভাষা বিষয়ে পড়ছেন।
🔗 #me_too: মাদ্রাসায় বলাৎকার হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে মোস্তাকিম বিল্লাহ মাসুমের ফেসবুক পোস্ট।