একজন আল্লামার প্রয়াণ
শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু ও হেফাজত-ই-ইসলামের ভবিষ্যৎ।
শতবর্ষী কোনো ব্যক্তির পক্ষে এতটা মনযোগের কেন্দ্রে থাকার ঘটনা বেশ বিরল। কিন্তু আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। ১৯১৬ সালে জন্ম নেয়া শফী তার অনুসারী ও সমর্থকদের কাছে যেমন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ধর্মীয় নেতার স্থানে ছিলেন, ঠিক তেমনই তার সমালোচকদের কাছে ছিলেন সমানভাবে নিন্দিত।
শফী দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন যখন তার বয়স ইতোমধ্যেই নব্বইয়ের কোঠা পার হয়েছে, যে বয়সে কিনা বেশিরভাগ মানুষই সামর্থ্যহীন হয়ে যান বা জনজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত, নিজের হাজার হাজার ছাত্র, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকবৃন্দ, চট্টগ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় কিছু অনুসারী বাদে বাংলাদেশের খুব বেশি মানুষ আহমদ শফীর নামও হয়তো শোনেননি।
আল্লামা শফীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ঘটনারই রূপ দিয়েছে তার শিক্ষার্থীরা।
প্রথমটি ঘটে ৫ই মে, ২০১৩ সালে। সেদিন তিনি ও তার সহযোগীরা হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্রদের ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। পুরো রাজধানী তারা অবরুদ্ধ করে রাখেন। শেষ পর্যন্ত সরকারের নৃশংস বলপ্রয়োগের শিকার হয় তাদের ওই কর্মসূচি। সেবার পিছু হটলেও, ওই ঘটনা আল্লামা শফীকে তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজত-ই-ইসলামের ছায়ায় এক রাজনৈতিক শক্তিস্থলে পরিণত করে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো দেশের সর্ববৃহৎ কওমি মাদ্রাসাতে সাম্প্রতিক ছাত্রবিক্ষোভ। ওই বিক্ষোভের ফলে তিনি ওই মাদ্রাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অথচ, তিনি চার দশক ধরে মাদ্রাসাটি পরিচালনা করে এসেছেন। এর কিছু সময় পরই তিনি মারা যান। কিন্তু তার আগে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়, কেননা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা ছিল তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সকে বের হতে দিলেই বাইরে মোতায়েন থাকা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করবে।
তার মাদ্রাসা আল-জামিয়াতুল আলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম, যেটি হাটহাজারী মাদ্রাসা নাম বেশি পরিচিত, দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া তিনি বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বা “বেফাকুল মাদারিস”-এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। তার সংগঠন হেফাজতের প্রতিষ্ঠা ২০০৯ সালে। প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা ছাত্রের চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি করা।
২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন ও ঢাকা অবরোধের মাধ্যমে রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠে হেফাজত। তাদের দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সংবিধান সংশোধন করে “মহান আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন” বাক্যটি পুনর্বহাল করা; কোরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক কোন আইন হবেনা বলে ঘোষণা দেয়া; ব্ল্যাসফেমি (ধর্ম অবমাননা) আইন পাশ করে তাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা; নারী ও শিক্ষা বিষয়ক জাতীয় নীতির পরিবর্তন; আহমেদিয়া গোষ্ঠীকে অমুসলিম ঘোষণা করা; ও, “ব্লগারদের” বিচার করা।
হেফাজতের ঢাকা অবরোধ ও শাহবাগ আন্দোলন প্রায় একই সময়ে ঘটে। আওয়ামী লীগ ও দলটির মিত্রদের সমর্থনপুষ্ট সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক শাহবাগ আন্দোলনের মূল দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি ছিল এক জটিল সন্ধিক্ষণ। সাত মাস পরেই দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে অসম আচরণের অভিযোগ তোলে। ওই বিচারে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই ছিলেন বিরোধী জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক জামায়াতে ইসলামির নেতারা।
হেফাজতের জনশক্তি ও জমায়েত হবার শক্তি দেখে বিএনপি তাদের অবরোধে সমর্থন দেয়। আর এই কারণেই হেফাজতের সমাবেশ ভণ্ডুল করতে সরকার আরও বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। সরকারি অভিযানের ফলে কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। আল্লামা শফী ও তার বেশিরভাগ সহযোগীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়। অনেকে গ্রেফতার হন। তবে নেতা হিসেবে শফীকে রেহাই দেওয়া হয়। আর সেখান থেকেই ক্ষমতাবান এক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে শফীর উত্থানের সূত্রপাত।
শফীর রাজনৈতিক উত্থান কত দ্রুত ছিল তার একটি উদাহরণ হলো, ওই ঘটনার ৫ বছর পর ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর — অর্থাৎ, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ৩ সপ্তাহ আগে — শফীর সংগঠন বেফাকুল মাদারিস সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি গণসংবর্ধনায় আমন্ত্রণ জানায়। আল্লামা শফীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই গণসংবর্ধনায় অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন একজন কর্তব্যরত সেনা জেনারেল জয়নুল আবেদীন, যিনি পরে মারা যান। মেজর জেনারেল আবেদীন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন সামরিক সচিব। সরকার ও শফীর মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি তিনিই দেখভাল করতেন বলে অনেকে বর্ণনা দিয়েছেন।
নির্বাচনী প্রচারণা চলার সময়ই ওই সমাবেশে একজন জেনারেলের প্রকাশ্য বক্তৃতা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। ওই সমাবেশেই কওমি ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রির সমমর্যাদা দেওয়ায় শেখ হাসিনাকে “কওমি জননী” উপাধি দেওয়া হয়। রাজনীতিতে আসলেই শেষ কথা বলে কিছু নেই। যেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা একসময় শফীকে নারীদের বিরুদ্ধে তার তির্যক মন্তব্যের জন্য তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, সেই হাসিনাই অত্যন্ত আগ্রহভরে শফীর সংগঠনের দেওয়া উপাধী গ্রহণ করলেন।
২০১৩ সালের কওমি সমাবেশের উপর আক্রমণ আর পরবর্তীতে কওমি ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যবর্তী সময়টাতে, দেশের জাতীয় পাঠ্যসূচিতে নীরবে বড় কিছু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। অনেক অমুসলিম লেখকদের লেখা বিদ্যালয়ের পাঠ্য বইগুলো থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। ইসলামবাদী রাজনীতিকদের পছন্দসই লেখা ঢুকে পড়ে। বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কঠোরতর শাস্তির বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। আল্লামা শফী তার বিভিন্ন দাবি আদায় করেছেন, তবে তেমন প্রচারণা ছাড়াই। এতে করে ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থকদের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী, যারা নিজেদের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে, তাদের সম্ভাব্য প্রতিরোধ বা আপত্তি এড়ানো সম্ভব হয়।
তার কটূক্তিমূলক মন্তব্য — যেমন, তিনি বলেছিলেন রাস্তায় নারীরা বের হলে পুরুষদের মুখে লালা বের হয় — নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। আর এ কারণে তিনি “তেঁতুল হুজুর” উপাধীও পান।
নারী শিক্ষার বিপক্ষে তার প্রকাশ্য অবস্থান ছিল রক্ষণশীল ইসলামের এমন এক সংস্করণ, যা তালেবান শাসনাধীন আফগানিস্তানের সাথেই তুলনীয়। এ কারণেই পশ্চিমা অনেক দেশ শফীর সাথে সরকারের জোট নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। এ নিয়ে নিজেদের অস্বস্তিও গোপন করেননি তারা।
কিন্তু কিছু সুবিধা পেলেও, গোপনে সরকারের সাথে লেনদেন তার জন্য কিছু সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। মাদ্রাসা ও হেফাজতের ভেতর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অভ্যন্তরীন অন্তর্কোন্দল শুরু হয়। ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর প্রতি তার বিশেষ আবেগ হয়তো তার সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। আর এর ফলেই মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে বহিষ্কার হতে হয়, যিনি হয়ে উঠেন তার প্রতিপক্ষ। আরো কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকের সাথে আনাস মাদানীর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়, যা শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় ছাত্র বিদ্রোহে। শফীর ছেলে মাদানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সরকার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা আদায় করে কওমি আন্দোলনের মুরুব্বী ঘরানার ব্যক্তিদেরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাপিয়ে রাখা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলনরত ছাত্রদের লেখা থেকে দেখা যায়, সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে হেফাজতের নিরবতাও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিলো।
শফীর অনুপস্থিতিতে সবার মনেই প্রশ্ন যে কওমি আন্দোলন ও হেফাজত এখন কোনদিকে ধাবিত হবে। শফী-পরবর্তী হাটহাজারী মাদ্রাসা ও হেফাজতের নেতৃত্ব কেমন হবে, তা অনুমান করার সময় এখনও আসেনি। আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল, শফী জীবিত থাকা অবস্থায়ই সরকার হস্তক্ষেপ করে মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়। মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি অর্থাৎ শূরা কমিটির পুনর্গঠন এখনও সম্পন্ন হয়নি। তবে সাময়িক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে আনাস-পন্থী দলের অনেকেই ছাত্র আন্দোলনে মদদ দেওয়া ও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে মিত্রতা করার অভিযোগ তুলেছেন বাবুনগরির বিরুদ্ধে।
আল্লামা শফী জীবনের শেষপ্রান্তে যে বিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন, তাতে সংগঠনের ভেতর তিক্ত অন্তর্কোন্দল ও ক্ষমতা দখলের লড়াই রয়েছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সহসাই এ বিরোধ মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলস্বরূপ, সংগঠনটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সত্যিকার ঝুঁকির সম্মুখীন। আর সেক্ষেত্রে সংগঠনে যারা সরকারবিরোধী বলে পরিচিত, তারা সংগঠন থেকে রূঢ়ভাবে বহিষ্কৃত বা সম্ভাব্য পরিণাম ভোগ করার ঝুঁকিতে থাকবেন। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, শিক্ষার ইসলামীকরণ, নারীদের বৃহত্তর সামাজিক স্বাধীনতা নিশ্চিতে যেসব অগ্রগতি হয়েছে, তা বাধাগ্রস্থ করাসহ সমাজে যেসব গভীর পরিবর্তন এনেছে হেফাজত, তা আরও বেশ কিছুকাল দীর্ঘস্থায়ী রয়ে যাবে।●
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।
* ইংরেজি থেকে অনুবাদিত।