পারিবারিক উত্তরাধিকার: শেখ হাসিনার পর
৭৩ বছর বয়সী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে আরও অনেক বছর থাকতে পারেন, যে পদটি তিনি এরই মধ্যে প্রায় ৪০ বছর ধরে রেখেছেন। কিন্তু তার পর কে তার স্থান নেবেন (তা যখনই হোক), বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদিও এটি নানান কানাঘুষা এবং ঢাকায় বিভিন্ন বসার ঘরের আলাপের বিষয় হিসেবে আছে, তবু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আরও অনেক বিষয়ের মতই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের উত্তরাধিরারের প্রশ্নটি সচরাচর এড়িয়ে যেতে চায়।
বিষয়টি স্পর্শকাতর, কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব একটি পারিবারিক ব্যবসা হয়ে উঠেছে — হাসিনার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সদস্যদের বাইরে কেউ পরবর্তি নেতা হবেন না। আর কোনো সংবাদমাধ্যমেরই সাহস নেই দেশের ক্ষমতাসীন পরিবারের ভেতরের এসব দিক নিয়ে আলোচনা করার, তাদের নেতৃত্বগুণের মূল্যায়ন করার।
শেখ-ওয়াজেদ পরিবারের ক্রিয়াকলাপ (সম্ভবত প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও ভালো শব্দ হবে) সরল কোনো বিষয় নয়। এ নিয়ে নিশ্চিত তথ্য আছে সামান্যই, কিন্তু অপ্রমাণিত গুঞ্জন আর অনুমান রয়েছে প্রচুর।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত উত্তরাধিকারের দৌড়ে সবার সামনে ছিলেন হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় — যিনি তার মায়ের তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টাও। পরিবারের অন্যদের চেয়ে সামাজিক মাধ্যমে তার ফলোয়ার সবচেয়ে বেশি; ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে তার ফলোয়ার ২০ লাখের বেশি। এর মাধ্যমে তিনি তার মা ও দলের অনানুষ্ঠানিক কিন্তু আগ্রাসি মুখপাত্র হিসেবে তৎপরতা চালান। যাহোক, আওয়ামী লীগের বৃহত্তর নেতৃত্ব এবং ঘাঁটিগুলোর সাথে তার বিশেষ ভাল সম্পর্ক নেই, শুধু যাদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে টেনে এনেছেন তাদের সাথে ছাডা। যেমন, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং বিটিআরসির চেয়ারপারসন শাহজাহান মাহমুদ।
যদিও বাংলাদেশের “বিজয়ীরাই সব পাবে” ধরণের রাজনীতি নিয়ে জয়ের আগ্রহ থাকতে পারে — সত্যিকার অর্থে তিনি তা উপভোগও করেন — কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে পারিবারিক প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, জয়ের আমেরিকান স্ত্রী চান, তিনি বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকুন। যে কারণেই হোক, এটা নিশ্চিত যে যখন কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হয়, তখনই জয় তার পরিবারের সাথে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চলে যান।
তার জায়গা নিতে পারেন তার বোন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এটি কিছুটা চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা যে কিছুদিন আগে পর্যন্তও পুতুল বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনুপস্থিত ছিলেন। কেবল তখনই তিনি দেশের মানুষের নজরে আসতেন যখন কানাডায় (সেখানে তিনি তখন বসবাস করতেন) অটিজম নিয়ে তার কাজের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খবর হতো।
পুতুল এখন বাংলাদেশে থাকছেন এবং তার মা তাকে অনেকগুলো সরকারি দায়িত্ব দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাকে ক্লাইমেট ভারনারেবল ফোরামের দূত নিয়োগ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে এই ফোরামের প্রধান। তাকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারসের চেয়ারপারসন করা হয়েছে; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অন ডিজ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্টের আন্তর্জাতিক ফোকাল পয়েন্ট করা হয়েছে। তিনি একই সাথে আওয়ামী লীগের প্রধান থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ভাইস চেয়ারপারসন এবং অনেক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বৈঠকে তিনি তার মায়ের সঙ্গে যোগ দেন। অনেক কূটনীতিক এবং আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে পরবর্তী উত্তরাধিকার হিসেবে দেখেন যাকে নেতৃত্বের জন্য তৈরি করা হচ্ছে।
পুতুলের ছোট বাচ্চা আছে যারা দুবাইয়ে তার প্রাক্তন স্বামীর সাথে থাকে, যার সাথে তার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তারা দেশে না আসলে তিনি কিভাবে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করবেন তাও ভেবে দেখার বিষয়।
হাসিনার ছোটবোন শেখ রেহানাকে এই বিবাদের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি তার বোন প্রধানমন্ত্রীকে অনেক অনুষ্ঠানে সঙ্গ দেন এবং শোনা যায়, সরকারের প্রধান প্রধান সিদ্ধান্ত, নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। গুঞ্জন আছে দুই বোনের মধ্যে বিবাদ চলছে — সম্ভবত শেখ হাসিনা তার মেয়েকে গুরুত্ব দিচ্ছেন সেটা নিয়েই — এবং এখন তিনি ঢাকার দৃশ্যপটে অনুপস্থিত আছেন। তবু, দুই বোনের সম্পর্কের ভেতরে যাই ঘটুক, শেখ রেহানা যথাযথ নির্বাহী ক্ষমতা পেতে আগ্রহী এবং বর্তমান দ্বন্দ্ব নিশ্চিতভাবেই সাময়িক হতে পারে।
এই হিসাবনিকাশে আরেকটি চরিত্র হলেন রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে ফেরার পর প্রথমে তিনি জাতিসংঘে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন, এবং ছায়ায় থেকে আওয়ামী লীগের ভেতরে তার ক্ষমতা ও প্রভাব তৈরির চেষ্টা করেছেন। তিনি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) দেখভাল করেন, যেটি দলের কার্যকর প্রপাগান্ডা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি তিনি তার সম্পাদনায় সিআরআইয়ের নতুন ম্যাগাজিন, হোয়াইটবোর্ড, প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার প্রথম সংখ্যাটি পুরোপুরি তার নানা শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে।
যাহোক, ববিও বাংলাদেশে থাকছেন না, পরিবারসহ থাইল্যান্ড চলে গেছেন। বিষয়টি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষস্থানে যাওয়া নিয়ে তার আগ্রহ সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে আরেক ব্যক্তির নাম মাঝেমধ্যে আলোচিত হয়; তিনি হলেন শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকার দক্ষিণের বর্তমান মেয়র। তিনি শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির ছেলে। তাপস যদিও সরাসরি হাসিনার মূল পরিবারের কেউ নন, তবু তিনি শেখ পরিবারেরই অংশ; ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের সাথে তার বাবা-মাকেও হত্যা করা হয়েছিল। তার মেয়রের পদ গ্রহণ করাটা নিশ্চিতভাবেই রাজনীতি নিয়ে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দেয়।
অবশ্য তাপসকে উত্তরাধিকার দৌড়ের দূরবর্তী একজন হিসেবেই দেখতে হবে; হাসিনার মূল পরিবারের কোনো উত্তরাধিকারীকে রাজি করানো না গেলে তিনিই হতে পারেন আপসরফার পছন্দ যিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দায়িত্ব নেবেন।●
ডেভিড বার্গম্যান — ব্রিটেনভিত্তিক সাংবাদিক — সম্পাদক, ইংরেজি সংস্করণ, নেত্র নিউজ।