চীন বনাম ভারত: যুদ্ধক্ষেত্র বাংলাদেশ?

বাংলাদেশের ওপর দুই দেশের বৃহত্তর প্রভাব বিস্তার প্রচেষ্টায় চীনের “অর্থনৈতিক সুবিধা” কি ভারতের “রক্তের বন্ধন” ছাপিয়ে যেতে পারবে?

চীন বনাম ভারত: যুদ্ধক্ষেত্র বাংলাদেশ?

এই জুনে চীন যখন বাংলাদেশকে তার বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দেয়, তখন ভারতের কিছু সংবাদপত্র বিদ্রুপ করেছিল। তারা লিখেছিল, “খয়রাতি”। স্পষ্টভাবেই স্পর্শকাতরতা বেড়েই চলছিল। এর এক সপ্তাহ আগেই সীমান্তে চীন ও ভারতের বাহিনীর সংঘাতে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। বাংলাদেশিরা অবশ্য ভারতের আহত অহংয়ে আরাম জোগাতে পাঞ্চিং ব্যাগ হিসেবে ব্যবহৃত হতে চায়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আবদুল মোমেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষোভে ঘি ঢেলেছেন, ভারতের একটি সংবাদপত্রের ভাষাকে তিনি “ক্ষুদ্র মানসিকতার” এবং “একেবারেই অগ্রহণযোগ্য” বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশে চীনপ্রীতি খুব কম এবং দূরবর্তী একটি বিষয়, তবে ভারতের একটু দাদাগিরি চীনের জন্য যে আগ্রহের ঢেউ তৈরি করে তা অন্য কোনোকিছু দ্বারা হয় না।

ঢাকার সরকার সাধারণত সবদিকেই খেলতে পারদর্শী। কিন্তু ঠিক যখন ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন চীন প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসায় ভারসাম্য রক্ষা করা দিনদিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। ভারতের সামরিক শক্তি এবং অর্থ তখনকার দরিদ্র পূর্ব পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তার স্বাধীনতা এনে দিতে সাহায্য করেছিল। তখন থেকেই ভারত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের স্বঘোষিত বড় ভাই হাত বাড়িয়ে দেয় — এর পরে আরও দুটি বিতর্কিত নির্বাচন হয় যা দলটির নেত্রী এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আনুগত্য পোক্ত করে।

এখন অবশ্য ১৯৭১ সালের স্মৃতিগুলো সেই গোলাপী আভা হারাতে শুরু করেছে। সাধারণ বাংলাদেশিরা নতজানুতার নীতির ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে উঠছে। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতের চেয়েও অনেক দ্রুততার সঙ্গে বিকশিত হয়েছে। উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রয়েছে গেছে কড়া শাসনে থাকা ছোটভাইয়ের মতোই। ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশির ভাগটাই এখনো ভারতের হাতে — বাণিজ্য ঘাটতি ৭.৩৫ বিলিয়ন ডলারের। এছাড়াও দুদেশের মধ্যে বয়ে চলা নদীগুলোর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। এটি বাংলাদেশিদের ক্রমাগতভাবে বিরক্ত করে তুলেছে, অনেকে মনে করেন, এর ফলে বর্ষাকালে তাদের আবাদি জমি তলিয়ে যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে শুষ্কই থেকে যায়। ভারত সীমান্তে বাংলাদেশিদের ক্রমাগত হত্যা, পেঁয়াজ আমদানি নিয়ে শোরগোল অবিচারের দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের প্রচণ্ড দলীয় পক্ষপাতমূলক ভূমিকা বিরোধী দল সমর্থনকারীদের ক্ষুদ্ধ করে তুলেছে।

বাংলাদেশিরা, যাদের প্রায় ৯০% মুসলিম, আতঙ্কিত হয়েছেন যখন ভারত সরকার সেদেশে একই ধর্মালম্বীদের বিরুদ্ধে দফায় দফায় বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি সচরাচর তোয়াজকারী শেখ হাসিনাও হিন্দু জাতীয়তাবাদের ক্রমবৃদ্ধি নিয়ে তার সবচেয়ে বড় বিদেশি বন্ধুকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের একটি রাজ্য আসামের মুসলিম নাগরিকদের তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণে নিবন্ধন করতে নির্দেশ দেয়ার কয়েক মাস পর ভারতের সরকার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীসহ অমুসলিম অভিবাসীদের জন্য ভারতীয়করণের একটি আইন পাশ করে। “আমরা বুঝতে পারি না, কেন (ভারতীয় সরকার) এটা করল। এটার প্রয়োজন ছিল না”, শেখ হাসিনা আরব আমিরাতের সংবাদপত্র গালফ নিউজকে এমন কথা বলেন। এর আগে তার সরকারের মন্ত্রীরা ভারত সফর বাতিল করেন।

বাড়তে থাকা ভারতবিরোধী মনোভাব দিল্লীর সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক পুনর্গঠনে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে। কোভিড-১৯ মহামারী আরেকটি এবং সম্ভবত আরও বড় চাপ তৈরি করেছে। মহামারী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং তা বাংলাদেশকে পূর্বমুখী হতে আগ্রহী করে তুলছে।

শেখ হাসিনার দশ বছর মেয়াদের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে বেশি অর্থের অভাবে রয়েছে। পশ্চিমা দাতা এবং আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে যখন অর্থ আসে, তখন তা অনেকগুলো শর্তও নিয়ে আসে। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরু করার পর বাংলাদেশ পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যাংকটির ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রত্যাখান করে। বাংলাদেশ সরকারকে অনেক শর্তও দেয় ব্যাংকটি। বাংলাদেশের সরকার তা পছন্দ করেনি। চীন ঢুকে পড়ে।

চীন তুলনামূলক কম কঠোর ব্যবসায়িক অংশীদার, একই সঙ্গে খুব উদারও। ২০১৬ সালে ঢাকা সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগে যোগ দিতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানান; ২৭টি অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রতিশ্রুতি দেন। এর ফলে বাংলাদেশে চীনের মোট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী চীন বড় বড় প্রকল্পে অর্থ ছাড় করতে শুরু করেছে; শেখ হাসিনার সরকার তা পছন্দও করছে। তারা শুধু উন্নয়নের একটি রাবার স্ট্যাম্প নিয়ে আসেনি, দেশের ভেতরে জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি করেছে। পদ্মা সেতুসহ রেল লাইন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প এলাকা নির্মাণে চীন অর্থ দিচ্ছে — হয় সরাসরি, না হয় চীনা কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বৃহত্তর বন্দরও হালনাগাদ করছে চীন।

চীনের আকর্ষণ শুধু অর্থনৈতিক নয়। চীন এ যাবৎ বাংলাদেশে সাতটি মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে এবং এটি বাড়ছে। বিগত কয়েক বছরে চীন সরকার খোলামেলাভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে কাছে টানার চেষ্টা করছে; সাংবাদিকদের শিক্ষামূলক সফরে নিচ্ছে। তারা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরও কাছে টানছে; অনেকেই এখন চীনে পড়াশুনা করছেন; তাদের মধ্যে বহু শিক্ষার্থী পড়ছেন বৃত্তি নিয়ে। কোভিড-১৯ আরো একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। যেমন, কোনো ভ্যাকসিন প্রস্তুত হলে দ্রুত অগ্রাধিকার পাবে বাংলাদেশ, এমনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন।

এসব দিয়েই অনুধাবন করা যায়, কেন ভারতের সমালোচনা দস্তুর হয়ে উঠেছে; আর বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও জনগণ কেন চীনের ভুল-ত্রুটি নিয়ে একেবারেই চুপ। এসবই চলছে। চীনে মুসলিম উইঘুরদের প্রতি তাদের আচরণের তুলনায় ভারতের মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ খুবই নগন্য মনে হয়। একইভাবে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ভারতের থেকেও অনেক বেশি (ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে এক যুগ আগে)। চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যারা মায়ানমার থেকে আসা একটি নিপীড়িত সংখ্যালঘু, যাদের মধ্যে ১০ লাখ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন এবং এখন পর্যন্ত তাদের দেশে ফিরতে পারেননি।

চীন যতই দক্ষ খেলোয়াড় হোক না কেন, অধিকাংশ বাংলাদেশীই এ বিষয়গুলো উপেক্ষা করতে চান, এর কারণ চীন আসলে কী তা না, বরং চীন কী না। চীন ভারত না। চীন, অন্তত দৃশ্যমানভাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না। চীনের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেনা বা দাদাগিরি করেনা।

বাংলাদেশের সরকার খুব শিগগিরই তার সবচেয়ে পুরনো বন্ধুকে পিঠ দেখাবে বলে মনে হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে চীনা ঋণের গর্ত নিয়ে সতর্কতা চীনা অর্থের জন্য উচ্ছ্বাসে চিড় ধরিয়েছে। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে ভারত — এই অবস্থা দিল্লির জন্য অনুকূল ভূমিকা রাখে। ইতিহাস এমন ইঙ্গিতই দেয় — পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন যেমন বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক “অর্থনৈতিক”, আর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক “রক্তের”। অন্তরঙ্গতা অবশ্য অনেক সময় ঘৃণার জন্ম দেয়, ভারত তা মনে রাখলে ভালো।●

সুসানা স্যাভেজ, সাংবাদিক — বাংলাদেশ বিষয়ে তিনি দ্য ইকোনোমিস্ট, টেলিগ্রাফ, ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে লিখেন।