ধর্ষণের রাজনীতি ও যৌন সন্ত্রাস
সারাদেশে চলমান ধষর্ণবিরোধী আন্দোলন থেকে এবার যে বিষয়টি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো: নারীর উপর যৌন সন্ত্রাস আর সহ্য করা হবে না। প্রেসক্লাব, শাহবাগসহ সারাদেশে তরুণ-তরুণীরা সরকার, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সামনে এবার স্পষ্ট যে বার্তাটি দাঁড় করাল, সেটি হচ্ছে: এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। সরকার দলীয় মন্ত্রী-সাংসদদের ছত্রছায়ায় ও আঞ্চলিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে যখন একের পর এক ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে, অথচ কাউকে কোথাও জবাবদিহি করতে হচ্ছে না, আইন-পুলিশ-সাংসদ-মন্ত্রীরা কেউ কোথাও কোনো দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না, তখন দেশের তরুণরা পথে নেমে এসেছে। পথে নেমে তারা তাদের স্পষ্ট বক্তব্য হাজির করেছে। ২০২০ সালে সারাদেশের এই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
ধর্ষণকারী বা যৌন সন্ত্রাসীর ক্ষমতায়ণ নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে ধারণাগতভাবে ধর্ষণ কী সেটা বোঝা প্রয়োজন। এরপর একজন পুরুষ কখন, কেন ও কোন নিয়ামকের কারণে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ষক হয়ে ওঠে, সেই আলোচনাটি সামনে আনা প্রয়োজন।
ধর্ষণ কী? প্রথমত ধর্ষণ একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ধর্ষক একজন সন্ত্রাসী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নাসরিন আখতার বিষয়টি চমৎকারভাবে স্পষ্ট করেছেন। তার মতে, “আমরা এমনভাবে ধর্ষণকে উপস্থাপন করি যেন এটি সহিংস যৌনতা; কিন্তু আসলে তা নয়। ধর্ষণ হচ্ছে একটি যৌন সহিংসতা।” ধর্ষণের সঙ্গে আসলে যৌন প্রবৃত্তির কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্ষণ শুধুমাত্র ও শুধুমাত্র যৌন সন্ত্রাস। আমাদের সামাজিক মনস্তত্বে বিষয়টি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যেন ধর্ষণের ফলে নারীর সম্ভ্রমহানী ঘটে; ধর্ষণ মানে নারীর শ্লীলতাহানী, নারীর জন্য বিরাট লজ্জা। সমাজের এই প্রচলিত “লজ্জা” ধারনাকে খারিজ করে ভারতের নারীবাদী কমলা ভাসিন প্রশ্ন তুলেছেন, নারীর যোনিতে সমাজের সম্ভ্রম, লজ্জা কে রেখেছে? নারী তো নিজের সম্ভ্রম, মর্যাদা তার যোনিতে রাখেনি। তাহলে এই দায় কেন তাকে নিতে হবে?
একজন ব্যক্তি মনে বা মস্তিষ্কে ধর্ষণ-আকাঙ্খা ধারণ করা মানেই সে ধর্ষক বা যৌন সন্ত্রাসী নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যক্তি তার ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে, ততক্ষণ তাকে ওই কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। যেমন কেউ তার মনে যতই খুনের চিন্তা নিয়ে ঘুরুক, খুন না করা পর্যন্ত সে খুনি নয়; তেমনি কারও মনে যতই ধর্ষকাম থাকুক, সে যতক্ষণ অপরাধটি না করছে, ততক্ষণ সে ধর্ষক বা যৌন সন্ত্রাসী নয়। অর্থাৎ সন্ত্রাস একটি বাস্তব পদক্ষেপ।
অন্য সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মতোই একজন ব্যক্তি মূলত চারটি প্রতিষ্ঠানের ও সেগুলোর ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যৌন সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। একটি দেশের এই প্রতিষ্ঠান চারটি হচ্ছে পরিবার, সমাজ, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। যে কোনো দেশেই ব্যক্তি আসলে এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিচরণ করে। এই চারটি প্রতিষ্ঠানের যে কোনো একটির ব্যর্থতা কিংবা একই সঙ্গে একাাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা তাকে যৌন সন্ত্রাসী করে তুলতে পারে। পরিবার, সমাজ, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্র — এই চারটি প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে চার ধরনের দায়িত্ব পালন করে। কাজেই যৌন সন্ত্রাসকে বুঝতে গেলে ও নির্মূল করতে চাইলে আমাদের এই প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানকে আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করতে হবে। এরপর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকটগুলোকে আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করতে হবে। সংকটের সমাধানও আলাদা আলাদা করেই খুঁজতে হবে।
আলোচনাটা পরিবার ও সমাজকে এক সঙ্গে রেখে করছি, কারণ পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক কোষ। নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়াগুলো সমাজ ‘নিয়ম-কানুন’ ও ‘তয়-তরিকা’র নামে পরিবারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। একটি পরিবারে নিয়ম-শৃঙ্খলা বলতে তা-ই চালু থাকে যা সমাজ চায়। এখন সমাজ যদি পিতৃতান্ত্রিক হয়, তাহলে সেই সমাজ পরিবারগুলোতেও পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখার চেষ্টা করবে। এই ধরনের সমাজে একা মা হিসেবে একটি পরিবার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজ তখন মা-প্রধান পরিবারটিকে নিরুৎসাহিত করতে নিজের সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে হাজির হয়। কারণ এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কখনই চায় না তার সমাজ ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে, এমন কোনো বিষয়কে উৎসাহ দিতে।
আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। তার মানে পিতা বা পুরুষ পরিবারের প্রধান। এখন একটা পরিবারে যখন একটি শিশু জন্মের পর থেকে দেখে দেখে বড় হয় যে তার পরিবারে পুরুষই সব, পুরুষই কামাই করে ও যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়, আর নারী শুধু দায়িত্ব পালন করে; কিংবা বাবা যখন ভাত খায়, মা দাঁড়িয়ে থেকে বাতাস করে; অথবা যখন টিভিতে দেখে রাজু আস্ত ডিম খাবে, মিনা ডিমের ঝোল, রাজু বাইরে যাবে, মিনা ঘরে থাকবে; মানে রাজু উত্তম, মিনা কম উত্তম বা অধম — তখন তা-ই হয়ে দাঁড়ায় আমাদের পারিবারিক কাঠামো।
সমাজ তার পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জারি রাখতে পুরুষ সেরা বা উচ্চতর, এই ধারনাকে প্রতিনিয়ত চর্চা করায় তার সদ্যদের দিয়ে। কোনো পুরুষ এই উচ্চতরের ধারণা চর্চা না করলে সমাজ তাকে “কম পুরুষ” হিসেবে বিবেচনা করে। “বেশি পুরুষ” বা “বেটাগিরির” মূল চাবিকাঠি হিসেবে সে চিহ্নিত করতে শেখে লিঙ্গকে। অল্প বয়সেই ব্যক্তি পুরুষ ভাবতে শেখে, সমাজে ও পরিবারে সে নারীর চেয়ে বিশেষ কিছু। কারণ তার পুরুষাঙ্গ আছে। যৌন সন্ত্রাসীর প্রথম ক্ষমতায়ণ শুরু হয় এখান থেকেই; লিঙ্গভিত্তিক পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ণের মধ্য দিয়ে।
এরপর আছে আমাদের পরিবার ও সমাজে সুস্থ যৌন শিক্ষার অভাব। সুস্থ যৌন শিক্ষা তো দূরের কথা, আমরা খোলামেলাভাবে, স্বাভাবিকভাবে যৌনতার আলোচনাও করি না। বয়ঃসন্ধির সময় একটি ছেলের শরীর স্বাভাবিক কৌতুহলেই যৌনতাকে বুঝতে চায়, দেখতে চায়। আরেকটু বড় হলে যৌন তাড়নাও বোধ করে ও অভিজ্ঞতা নিতে চায়। কিন্তু যৌনতা নিয়ে পরিবার বা সমাজে সুস্থ, স্বাভাবিক আলোচনা না থাকায়, সহজে বোধগম্য সুস্থ তথ্য মাধ্যম না থাকায়, পর্ণগ্রাফি, চটি বই, লুকিয়ে নারীকে গোসল করতে দেখা, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে প্রতিবেশীর যৌনসঙ্গম দেখার চেষ্টা, বন্ধুদের আড্ডায় যৌন রসালো আলোচনাই হয়ে যায় যৌনতা কেন্দ্রিক তথ্যভাণ্ডার। অথচ, এই যে তথ্য ভাণ্ডার, যেখান থেকে ছেলেটি তার যৌনতার ধারণা নিচ্ছে, এর প্রত্যেকটিই বিকৃত ও অস্বাভাবিক।
আমাদের সমাজে যৌনতাকে এমন এক ট্যাবু করে রাখা হয়েছে যে বাবা-মা-ভাই-বোন মিলে কখনই পারিবারিক পরিবেশে স্বাভাবিকভাবে এগুলো নিয়ে আলাপ হয়না। বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা পাশের বাসায় থাকা উপদেশ দিতে ওস্তাদ যে বড় ভাই বা বোন থাকে, তারাও এগুলো নিয়ে সুন্দর, সুস্থ দু’ টো কথা বলে না। যৌনতা নিয়ে আমরা যা জানি, যা প্রচার করি তা হচ্ছে যৌনতা খারাপ, এটা নিষিদ্ধ।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা মৌলানা-হুজুর – এরাও যে সমাজের বাইরের কোনো মানুষ, এমন নয়। তারাও সমাজেরই অংশ. আবার তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আছে যেগুলো তারা নিজেদের মতো করে সমাজে প্রচার করে। সেই জায়গা থেকে সমাজের সঙ্গে তাদের আদান-প্রদান ঘটে। তারাও সমাজে প্রচলিত প্রবণতার মতো মনে করে ও প্রচার করে যে, যৌনতা খারাপ ও নিষিদ্ধ একটি বিষয়। এর সম্পর্কে জানা যাবে না, কথা বলা যাবে না। যৌনাঙ্গ ব্যবহারের তাগিদ বোধ করলেও এটাকে কী করে, কোথায় ব্যবহার করতে হবে, তা একটি ছেলেকে কেউ শেখায় না। ফলে বড় হতে হতে নিজের পুরুষাঙ্গ থাকায় একটি ছেলে সমাজে উচ্চতর অবস্থানের বোধ নিয়ে, সমস্ত যৌন কামনা-বাসনা নিয়ে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত একটি যৌন জগতে প্রবেশ করে।
তবে কথা হচ্ছে, এই বিভ্রান্তিও কিন্তু তাকে যৌন সন্ত্রাসী হিসেবে হাজির করে না। এই যৌন বিভ্রান্তি ও উচ্চতর অবস্থানের বোধ পুরুষকে শেখায় নারীকে ছোট করতে, হেয় করতে ও যৌন প্রাণী হিসেবে ভাবতে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে খারাপ দিকটা হলো, সে পুরুষকে শেখায় যে নারী তার সম্পত্তি। আর তাই নিজের সম্পত্তির ওপর পুরুষ যে কোনো ধরনের অধিকার খাটাতে চায়। এই সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ ও পরিবার একজন পুরুষের মাঝে সম্ভাব্য যৌন সন্ত্রাসের বোধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
এদিকে আবার পুজিঁবাজার তাঁর বৈশিষ্ট্য মেনেই ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে চলে। একটা সমাজে যখন নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখা হয়, তখন পুঁজি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে নারীকে পণ্য হিসেবে বাজারে হাজির করে; নারীর পন্যায়নকে জাগিয়ে দেয়, উষ্কে দেয়। এই অবস্থাও যৌন সন্ত্রাসীর মনন বা মনের জগৎ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, পুরুষ তার এই বোধ বাস্তবায়ন করবে কিনা, সেটা নির্ভর করে দেশে আইনের শাসন কতখানি বাস্তবায়ন হচ্ছে তার ওপর। একজন সম্ভাব্য ধর্ষকও ধর্ষণের মতো সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়াবে না, যদি সে জানে যে এই কাজের জন্য পরবর্তীতে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আর যদি পরর্বতীতে কোনো শাস্তির ভয় তার না থাকে, তখন আসলে সে আর কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করে না। তখনই সে ধর্ষণ বা যৌন সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে।
অর্থাৎ, একজন যৌন সন্ত্রাসীর মনন ও মানসিক গঠন তৈরি করা পর্যন্ত সমাজ ও পরিবারের হাত থাকতে পারে। কিন্তু অপরাধটি সংঘঠিত করার পেছনে আসলে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দায়ী।
বতর্মানে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, একজন সন্ত্রাসীর যৌন সন্ত্রাসী হিসেবে আত্মপ্রকাশে এক ধরনের আঞ্চলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভূমিকা কাজ করছে। কাজেই ব্যক্তির যৌন সন্ত্রাসী হওয়ার পিছনে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো কী ও কীভাবে কাজ করছে, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাগুলোই বা কী এবং সেই ব্যর্থতা কীভাবে ভূমিকা রাখছে, এই বিষয়গুলো আলাদা আলোচনার দাবী রাখে।
ধর্ষণ বা যৌন সন্ত্রাসের সঙ্গে দুই ধরনের সন্ত্রাসী জড়িত থাকে। এক ধরনের তরুণ-যুবক আছে যারা সমাজে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত নয়, কোনো ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গেও যুক্ত নয়; কিন্তু সুযোগ বা সুবিধা পেয়ে ধর্ষণের মতো যৌন সন্ত্রাসের কাজটি করে। আরেক ধরনের লোক আছে যারা এলাকায় এরই মধ্যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতার অংশ হিসেবেই ধর্ষণ বা যৌন সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধষর্ণকে শুধুমাত্র যৌন বিকার বলার মতো সরল পরিস্থিতি আসলে আর নেই। আমরা যদি দেশে ক্রমবর্ধমান যৌন সন্ত্রাসের হিসাব লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব এই হিসাবের সংখ্যাগত রেখাটি উপরের দিকে উঠার সঙ্গে নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির সরাসরি যোগসংযোগ রয়েছে। আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত যৌন সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো দেখি, তাহলে দেখব যে প্রত্যেকটার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন দলের আঞ্চলিক নেতা-কর্মীরা জড়িত।
২০১৫ সালে ১লা বৈশাখে টিএসসিতে যে গণ যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে, সেখানে সরাসরি যুক্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর শুধুমাত্র ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় নোয়াখালীতে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক পর্যায়ের কর্মীরা। ২০২০ সালে সিলেটের এমসি কলেজ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সংঘটিত ধর্ষণ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল আঞ্চলিক পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।
বেগমগঞ্জের ঘটনার পর যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যেই দেলোয়ার বাহিনী এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছিল, সেই দেলোয়ার ২০১৮ সালে ভোটকেন্দ্র দখলের মধ্যদিয়ে দলীয় নেতাদের চোখে পড়ে। এখানে লক্ষ্য করুন, কীভাবে একটি রাজনৈতিক দলে নেতাদের স্বীকৃতির মাপকাঠি হয়ে উঠছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। যে রাজনৈতিক দলে বা সংগঠনে ঢোকার জন্য বা দলীয় নেতাদের চোখে পড়ার জন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে মাপকাঠি, সেই সংগঠনে ঢোকার পর এসব তরুণ-যুবকের আরও বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়াইতো স্বাভাবিক।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করছেন, পরপর দু’ দফায় কার্যত নির্বাচনবিহীন সরকার পরিচালনার বাধাবিঘ্ন দূর করতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আঞ্চলিক পর্যায়ে এসব গুণ্ডাবাহিনী বানাতে হয়েছে। এসব গুণ্ডা-মাস্তানদের সব ধরনের অপরাধ করার ছাড়পত্রও দিতে হচ্ছে। এটা একটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যার প্রতিফলন ঘটেছে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায়। আপনি যদি গ্রামে যান, সেখানেও এই রাজনৈতিক কাঠামোর গ্রামীণ রূপ দেখতে পাবেন। এই সন্ত্রাসী রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়েই দেশে অন্যান্য সন্ত্রাসের মতো যৌন সন্ত্রাসেরও ক্ষমতায়ন ঘটেছে।
বাংলাদেশে এখন পযর্ন্ত ধর্ষণ বা যৌন সন্ত্রাসের পেছনে যাদেরকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় এবং যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয় ও হয়েছে, সেটা হচ্ছে দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো। যে সংস্থাগুলো মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেগুলো আসলে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। আমাদের পুলিশ ব্যবস্থা নারী অসংবেদনশীল। যৌন সন্ত্রাসের শিকার কোনো নারী পুলিশের কাছে সাহায্যের জন্য গেলে তাকে উল্টো হেনস্থা হতে হয়, পুলিশ মামলা নিতে চায় না, এমনকি অনেক সময় টাকার বিনিময়ে মামলা মীমাংসাও করে ফেলে পুলিশ।
এরপর আসে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এটাকেই আসলে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ সন্ত্রাস বিস্তারের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র নোয়াখালির নারী ও শিশু আদালতেই ২০০০ মামলা ঝুলছে। অথচ এক বছর হলো সেখানে কোনো বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ঘোষণা আছে কিন্তু আদালতে মামলা নিস্পত্তি হয় না। ৮/১০ বছর পার হয়ে যায় একেকটা মামলা নিস্পত্তি হতে। সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন আছে, যাদের কাজ কী, সেটা আসলে পরিষ্কার না। ভয়াবহ একেকটি যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটার পরও স্থানীয় সাংসদকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ জবাবদিহিতার অভাব। এ দেশে কাউকে তার দায়িত্বে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি করতে হয় না। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এমন কোনো উপায়ই রাখা হয়নি যার উপর নির্ভর করে নিচ থেকে উপর বা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
এই সবকিছুর ফলস্বরূপ দিনে গড়ে চারজন নারী যৌন সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে হলে সমাজ, পরিবার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো — এই চারটি ভাগ নিয়েই কথা বলতে ও কাজ করতে হবে। শুধু এক সমাজের ঘাড়ে দোষ চাপালে পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন ঘটবে না।●
দিলশানা পারুল, লেখক ও গবেষক।