আইজিপি বনাম কমিশনার: একটি চিঠি
বাংলাদেশ পুলিশের শীর্ষপর্যায়ে ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্বে বদলি হলেন পরস্পরবিরোধী শিবিরের দুই কর্মকর্তা।
৩০ মে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম গোপনে একটি চিঠি পাঠান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজির আহমেদের কাছে। চিঠিতে ডিএমপির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। শুধু তাই নয়, ডিএমপি কমিশনার অভিযোগ করেন, তাকেও এই দুর্নীতির ভাগ বা “পার্সেন্টেজ” দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওই কর্মকর্তা।
ওই চিঠি কিছু দিন পরই সংবাদ মাধ্যমের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। সেখানে অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তা অর্থাৎ ইমাম হোসেনকে ডিএমপি থেকে অতিসত্বর অন্যত্র বদলি করার অনুরোধ জানানো হয় পুলিশ প্রধানের কাছে। বাংলাদেশ পুলিশে ইমাম হোসেনের মতো কর্মকর্তারা “সুপিরিয়র” (উর্ধ্বতন) কর্মকর্তা হিসেবে পরিগণিত। মূলত, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে এসব কর্মকর্তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। “প্রথম শ্রেণির গ্যাজেটেড কর্মকর্তা” হিসেবে সহকারি পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে আইজিপি পদ পর্যন্ত তাদের পদায়ন হয়। বিপরীতে, কনস্ট্যাবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত কর্মকর্তারা হলেন “অধস্থন (সাবঅর্ডিনেট) কর্মকর্তা”।
ডিএমপিতে কর্মরত থাকায় ইমাম হোসেন সংস্থার প্রধান অর্থাৎ ডিএমপি কমিশনারের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তবে আইনানুযায়ী এই ধরণের কর্মকর্তাদের এক ইউনিট থেকে আরেক ইউনিটে বদলি বা চাকরিচ্যুতির ক্ষমতা কেবল সরকারের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ও আইজিপির।
যাই হোক, দুর্নীতির সাজা হিসেবে ইমাম হোসেনের বদলি চেয়ে যেই চিঠি ডিএমপি কমিশনার লিখেছিলেন, তা পুলিশ বাহিনীতে একেবারে নজিরবিহীন না হলেও, খুবই বিরল দুর্নীতির বিরুদ্ধে চিঠি চালাচালির ঘটনা। বিশেষ করে এই কারণে যে, এই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশ প্রকট। এছাড়া বাহিনী হিসেবে সদস্যদের গুরুতর অসদাচরণও এড়িয়ে যাওয়ার কুখ্যাতি রয়েছে পুলিশের।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বাংলাদেশ বিষয়ক মানবাধিকার প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দায়মুক্তি ভোগ করার বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। দুর্নীতি-বিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৮ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে। সেখানেও দেখা যায়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ।
গুরুতর অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ এলে, অধস্থন পুলিশ সদস্যরা মৃদু সাজা হলেও ভোগ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য বদলি হয়েই তারা পার পান। তবে উর্ধ্বতন বা সুপিরিয়র কর্মকর্তারা প্রায় নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি ভোগ করেন। এই কারণে ইমাম হোসেনের মতো সুপিরিয়র অফিসারের এত গুরুতর অসদচারণের জন্য সাজা হিসেবে স্রেফ বদলির সুপারিশ করেও এত হইচই সৃষ্টি হয়েছে ওই চিঠি নিয়ে। ইমাম হোসেনের অপরাধের মাত্রার তুলনায় সাজা হিসেবে বদলি নগন্য হলেও, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়হীনতার যেই দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি, চিঠিটিতে তার এক ধরণের ব্যাত্যয়ের প্রতিফলন ঘটেছিল।
কিন্তু নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ওই চিঠি দুর্নীতি মোকাবিলার অংশ ছিল না মোটেই। পুলিশ ও শাসক দল আওয়ামী লীগের একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপচারিতা ও সরকারি নথিপত্র পর্যালোচনা থেকে ইঙ্গিত মিলে যে, ডিএমপি বা আইজিপির জন্য দুর্নীতি খুব বড় ইস্যু ছিল না। বরং, ওই বহুল-আলোচিত চিঠিটি ছিল প্রভাবশালী কমিশনার ও খোদ পুলিশ প্রধানের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের অংশ মাত্র। এমনকি এই পুরো ঘটনাবলী ছিল মূলত দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান দলাদলি ও স্থূল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে জর্জরিত একটি বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গুর হয়ে পড়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীভূত পুলিশ বাহিনীর সামগ্রিক নেতৃত্বে থাকেন পুলিশ প্রধান বা আইজিপি। তবে ডিএমপি এই বাহিনীর সর্ববৃহৎ ইউনিট। এই বিভাগে কাজ করেন হাজার হাজার সদস্য। সবচেয়ে বড় কথা, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে ক্ষমতা ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত রাজধানী শহরের পুরোটাই এই বাহিনীর জুরিসডিকশন বা অধিক্ষেত্র। এ কারণে পদমর্যাদায় বেশ নিচের দিকে হলেও, ঢাকার পুলিশ কমিশনারের পদটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।
বর্তমান আইজিপি বেনজির আহমেদ শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশের ক্ষেত্রে কখনও কোনো লুকোচুরি করেননি। তিনি ২০১৪ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের (যেটি বেশিরভাগ বিরোধী দল বর্জন করেছিল) প্রাক্বালে কোনো রাখঢাক না রেখেই শাসক দলের প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন।
পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে তার যেই অবিশ্বাস্য উত্থান, তার শুরু হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর। একেবারে ক্ষীণালোক থেকে তাকে তখন উঠিয়ে আনা হয় পাদপ্রদীপের আলোয়। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ, যেটি শেখ মুজিবুর রহমানের আদি শহর ও পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী জেলা। এসব কারণে বেনজির আহমেদকে অত্যন্ত ক্ষমতাধর একজন কর্মকর্তা হিসেবে দেখা হয়।
২০০৯ সাল থেকেই জ্যেষ্ঠতর কর্মকর্তাদের অগ্রাহ্য করে তাকে পদন্নোতি দেওয়া হয়। ডিএমপি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পর এবার পুরো পুলিশ বাহিনী — অর্থাৎ, একজন পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব, বেনজির আহমেদ তার প্রায় সব ক’টিতেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি শেখ হাসিনার প্রতি এতটাই অনুগত যে, প্রধানমন্ত্রী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে তাকে পুলিশ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
এদিকে গত বছর বেনজির আহমেদের চেয়ে বয়সে বড় তবে এক ব্যাচ কনিষ্ঠ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামকে ডিএমপির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বেনজির আহমেদ ও শফিকুল ইসলাম বর্তমান স্ব স্ব পদে আসার আগেই, তাদের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য ছিল বলে জানিয়েছেন ঢাকায় বহুদিন ধরে কাজ করা একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা।
পুরোনো সেই দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত হয় দুই কর্মকর্তার নয়া অভিলাষ ও উচ্চাকাঙ্খা। ফলে দুই জন জড়িয়ে পড়েন একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে। বিষয়টি এতটাই তিক্ত হয়ে উঠে যে, শফিকুল ইসলামকে ডিএমপি প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবরও গিয়েছিলেন বেনজির। এই গুঞ্জনের কথা একজন রাজনৈতিকভাবে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিও স্বীকার করেছেন। আর ঠিক এই কারণেই ডিএমপি কমিশনারও শুরু করেন তার নিজস্ব তৎপরতা।
আইজিপির শত্রুভাবাপন্ন আচরণে দিশেহারা শফিকুল ইসলাম টার্গেট করেন আইজিপির প্রতি অনুগত তবে পেশাদারিত্বের দিক থেকে নাজুক কর্মকর্তা ইমাম হোসেনকে। এটি সত্য যে, ইমাম হোসেন খুব অনুকরণীয় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা নন। ডিএমপির লজিস্টিক বিভাগের প্রধান হিসেবে দেশের সর্ববৃহৎ পুলিশ ইউনিটটির যাবতীয় ক্রয়বিক্রয় প্রক্রিয়ায় তার নিয়ন্ত্রণ ছিল। বস্তুত, ডিএমপিতে কর্মরত খুব কম কর্মকর্তাই আছেন যারা ইমামের বিরুদ্ধে কমিশনারের আনা অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। কমিশনার শফিকুল ইসলাম একান্ত আলাপচারিতায় তার মিত্র ও অনুগত কর্মকর্তাদেরও বলেছেন যে, ইমাম হোসেনের কাছ থেকে তিনি সত্যি সত্যিই ঘুষ ভাগাভাগির প্রস্তাব পেয়েছিলেন।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের করা একটি গোপনীয় নথিতে অভিযোগ করা হয়, ইমাম হোসেন তার বৈধ ও প্রদর্শিত আয়ের বাইরেও বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। যেমন, ওই নথি মোতাবেক, তিনি ঢাকা শহরে ৪টি বাড়ি ও কক্সবাজারে ১টি বাড়ির মালিক। ওই ডোসিয়ার বলছে, যুক্তরাজ্য ও ফিলিপাইনে রয়েছে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক; এমনকি ঢাকার একটি বাণিজ্যিক এফএম রেডিও স্টেশনেও রয়েছে তার মালিকানা। নেত্র নিউজের পক্ষে এসব অভিযোগ নিজস্বভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
তবে আমরা পুরোনো কিছু সংবাদ প্রতিবেদন পেয়েছি, যা থেকে ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে অন্তত একটি অভিযোগের কিছুটা সত্যতা মিলে। ওই গোপন ডোসিয়ারে বলা হয়, সুফিয়া সুন্দর নামে ইমাম হোসেনের “কোটি কোটি টাকার” একটি দাতব্য সংস্থা আছে। ওই ফাউন্ডেশনের নিজস্ব সংবাদ ওয়েবসাইট, বাংলাদেশ২৪অনলাইন.কম-এর সংবাদও বলছে যে, ইমাম হোসেন ওই দাতব্য সংস্থার পক্ষে বিপুল অংকের অর্থ, বৃত্তি ও খাদ্য বিতরণ করেছেন।
ডিএমপির ওই গোপন প্রতিবেদনে ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে ২০১৪-১৫ সালে ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে একটি খুনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়। এতে বলা হয়, বিতর্কিত ওই জমি পরে ইমামের ভাই কিনে নেন, এরপর তার ভাই তাকে “দান” করে দেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ওই কথিত ভূমি দখল ও খুনের ঘটনায় কারও কোনো সাজা বা মামলা হয়নি।
প্রতিবেদনে অবশ্য ইমাম হোসেনকে বিএনপি সমর্থক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে দাবি করা হয়, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ইমাম হোসেন তার সরকারি নিরাপত্তা দলের সদস্য ছিলেন। এতে এই মন্তব্যও করা হয় যে, ডিএমপিতে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করলেও, তাকে বারবার ডিএমপি থেকে বদলির চেষ্টা রহস্যজনক কারণে সফল হয়নি।
কিন্তু তারপরও শফিকুল আলম দুর্নীতি অপছন্দ করেন বলে ইমাম হোসেনকে বদলির সুপারিশ করে চিঠিটি লিখেছিলেন, এমন সম্ভাবনা কম। কারণ, কমিশনার যদি ইমামকে দুর্নীতি থেকে দূরে রাখতে চাইতেনই, তাহলে তিনি নিজেই তাকে ডিএমপির মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিভাগে বদলি করতে পারতেন। অন্তত এতটুকু ক্ষমতা আইনে তাকে দেওয়া হয়েছে। পরে তিনি সেটা করেছেনও। কিন্তু তার আগে ওই চিঠি লিখে তিনি বল ঠেলে দিয়েছিলেন আইজিপির কোর্টে।
এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে আইজিপিকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে, ডিএমপি কমিশনার “এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছিলেন।” তিনি বলেন, “প্রথমত, আইজিপির যদি সত্যিই ডিএমপি কমিশনারকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতোও, এই চিঠির কারণে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। কারণ, এই চিঠির পর যদি ডিএমপি কমিশনারকে (পূর্ব পরিকল্পনামাফিক) সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সবাই ভাবতো যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়ায় কমিশনারের এই অবস্থা। দ্বিতীয়ত, এই অভিযোগটা এত মারাত্মক যে, [এর মাধ্যমে] একজন বিরূপ মনোভাবের কর্মকর্তার ট্রান্সফার নিশ্চিত করে ফেলেন [কমিশনার]।”
দ্বিতীয় আরেকজন কর্মকর্তা জানান, এই চিঠির চেয়েও চিঠি “ফাঁস” হয়ে যাওয়াই আইজিপিকে বেশি ক্ষুদ্ধ করেছিল। তার ভাষ্য, “শত্রুশিবিরে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এক সমর্থককে হারাতে দেখে ভালো লাগেনি [আইজিপির]।”
উভয় কর্মকর্তাই বলেছেন যে, আইজিপির অধীনস্থ পুলিশ সদর দপ্তরের চাপেই মূলত ডিএমপি ওই চিঠি ফাঁসের ঘটনায় তদন্ত শুরু করে। তদন্তের অধীনে প্রায় এক ডজন সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়। তবে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর চাপে ওই তদন্ত এখন নিশ্চল হয়ে আছে।
তবে এখানে পরিহাস হলো, এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পরও ইমাম হোসেনকে তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়নি। অথচ, যেসব সাংবাদিক এ নিয়ে প্রতিবেদন করেছিলেন, তাদেরই বরং — সাময়িকভাবে হলেও — জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়। বিষয়টি অনেকটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, এত বড় কেলেঙ্কারির চেয়েও কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ পুলিশের কাছে।
এদিকে কমিশনারের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে না পেরে, আইজিপি অন্তত সমান মাত্রার প্রতিঘাত করতে মনস্থির করেন। ইমাম হোসেনকে যেহেতু বদলি করতেই হচ্ছে, তাই কমিশনারের পক্ষের এক কর্মকর্তাকেও তিনি বদলি করার উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে কোপানলে পড়েন শাহ মিজান শফিউর রহমান। তিনিও ইমাম হোসেনের মতো ডিএমপির একজন যুগ্ম কমিশনার ছিলেন। তাকে বদলি করা হয় সুদূর রংপুরে। শাহ মিজান শফিউর রহমান ডিএমপি কমিশনারের মিত্র হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিকভাবে ওয়াকিবহাল এক ব্যক্তি জানান যে, ইমাম হোসেনের বিষয়ে কমিশনার যেই চিঠিটি লিখেছিলেন, তা ছিল শাহ মিজান শফিউর রহমানের “মস্তিষ্কপ্রসূত”।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ২৯ জুন একই পত্রে ইমাম হোসেন ও শাহ মিজানের বদলির আদেশ জারি করে। শফিউর রহমান নিজেও প্রভাবশালী ও দলঘেঁষা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রথমে চেষ্টা করেন এই বদলি ঠেকানোর। এর আগে ঢাকার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শফিউর নিজের ব্যাপক রাজনৈতিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে আইজিপির সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের চেষ্টা চালান। তবে আইজিপি পিছু হটার পাত্র ছিলেন না।
৬ জুলাই পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পরপর দুইটি পত্র যায় শফিউর রহমানের কাছে। প্রথম চিঠিতে বলা হয়, তার বদলির বিষয়ে ডিএমপির কাছ থেকে তথ্য চেয়েছে সদর দপ্তর। এতে উল্লেখ করা হয়, বদলির আদেশে তাকে ৫ জুলাইয়ের মধ্যে ডিএমপি ত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। তিনি সেই আদেশ মানতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেই চিঠিতে তাকে পরদিনই রংপুরে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, “অন্যথায় আগামী ৮/৭/২০২০ খ্রি. তারিখে আপনি বর্তমান কর্মস্থল হতে তাৎক্ষণিকভাবে অবমুক্ত হয়েছেন মর্মে গণ্য হবেন।”
একই দিনে জারি করা দ্বিতীয় চিঠির ভাষা ছিল আরও আক্রমণাত্মক। এতে বলা হয়, শফিউর রহমান “কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশের লঙ্ঘন” করেছেন, যা “গুরুতর অসদাচরণের শামিল।” শুধু তা-ই নয়, সরকারি আদেশ মানতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) অন্তর্ভূক্ত করারও হুমকি দেওয়া হয় চিঠিতে। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি বা নিয়োগের সময় এসিআর মূল্যায়ন করা হয়।
একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা বদলির আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন কিনা তা খোদ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার বিষয়টি অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঘটনা। এজন্য “সতর্ক” করার ঘটনা আরও বিরল। দ্বিতীয় পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এই ধরণের বিষয়ে এই মাত্রার তৎপরতার কথা কখনও শোনা যায়নি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, [পুলিশ প্রধান] ডিএমপি কমিশনারের ঘনিষ্ঠ অফিসারকে সরিয়ে ওনাকে শিক্ষা দেওয়ার সংকল্প নিয়েছেন।”
শেষ পর্যন্ত, শাহ মিজান শফিউর রহমান হাল ছাড়তে বাধ্য হন। রংপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১০ জুলাই তিনি ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেন, ঢাকার বাইরে তাকে বদলি হতে দেখে সবচেয়ে খুশি হয়েছে “সরকার-বিরোধী চক্র”। তিনি আরও যোগ করেন, তিনি সবসময়ই “দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিবিশেষ” ও অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবেন। শেষে তিনি লিখেন, তিনি “প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা”র প্রতি কৃতজ্ঞ।
একজন মধ্যম সারির পুলিশ কর্মকর্তা তার বদলির পেছনে সরকার-বিরোধীতার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিনি আসলে কাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো লিখেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কাগজেকলমে প্রতিকী — তবে বাস্তবে কঠোরভাবে প্রতিপালিত — ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স অনুযায়ী আইজিপির অবস্থান সরকারের সচিবদের উপরেই। সম্ভবত, এই ফাঁকে কটাক্ষও করতে চেয়েছেন শাহ মিজান শফিউর রহমান।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির মাধ্যমে ইমাম হোসেনকেও ডিএমপি থেকে বদলি করা হয়। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, তাকে এই সামান্য “শাস্তি” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে চিঠি পাওয়ার পর। ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে ১৪ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় দুদক। এরও ২৩ দিন পর ইমাম হোসেনকে (শাহ মিজান শফিউর রহমান সহ) বদলির চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আবার শাহ মিজান শফিউর রহমানকে রংপুর পাঠানো হলেও, এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ইমাম হোসেন ঠিকই থেকে যান ঢাকায়। বদলি হন মর্যাদাবান অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডিতে। অনুগত একজন কর্মকর্তাকে ঢাকাতেই রেখে দিতে পারাকে আইজিপি বেনজির আহমেদ হয়তো নিজের ছোটখাট অর্জন হিসেবেই দেখে থাকবেন।
এই প্রতিবেদনে বর্ণিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে নেত্র নিউজ, বাংলাদেশ পুলিশের একজন মুখপাত্রের কাছে কিছু প্রশ্নও পাঠানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোন জবাব পাইনি।●