ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল: বাংলাদেশে মার্কিন তৎপরতা
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছেন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তারা। ১৪ থেকে ১৬ অক্টোবর মার্কিন উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্টিফেন বিগেন বাংলাদেশ সফর করেছেন। তার তিন দিনব্যাপী এই সফরের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি কেইথ জে. ক্র্যাচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ. রহমান ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় ভার্চুয়াল সভায় যোগ দেন। এই দুই জন বিগেনের সঙ্গেও ঢাকায় সাক্ষাৎ করেছিলেন। তারও আগে সেপ্টেম্বরের শুরুতে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোনালাপে মিলিত হন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার যে রোহিঙ্গা সংকট, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। যেমন, মার্ক এসপারের সঙ্গে ফোনালাপের পর শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে বলা হয় যে, তারা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। আবার বিগেনের সঙ্গে বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যয় নির্বাহের জন্য দশ বছরের অর্থায়ন পরিকল্পনা নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি দাতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলাদেশে অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের পরিকল্পনা এই সংকটকে বরং আরও দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করবে, আর মিয়ানমারকে স্বস্তি দেবে। এই প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশ তার অস্বস্তি লুকানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। কনফারেন্সে বাংলাদেশ বক্তব্য দিতে পাঠায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন মিয়ানমার-বাংলাদেশ-চীন ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের সম্ভাবনা নিয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতায়। তারপরও পশ্চিমা কূটনীতিকদের কারও কারও বিশ্বাস যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন ও মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবসনের ব্যয় এই প্রস্তাবে অন্তর্ভূক্ত করা হলে, বাংলাদেশ সম্ভবত এই অর্থায়ন প্রস্তাব নিয়ে আগ্রহী হবে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের যতই আন্তরিকতা থাকুক না কেন, এই অঞ্চলে এটিই দেশটির প্রধান উদ্বেগের বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল।
বিগেনের সফর এবং এর আগে দুই দেশের মধ্যকার অন্যান্য উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা প্রভাবকে টেক্কা দিতে মার্কিন প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। চীন বাংলাদেশে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে। বিপরীতে বাংলাদেশও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উচ্চাকাঙ্খী রোড অ্যান্ড বেল্ট প্রকল্পে যোগ দিয়েছে। এক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারতের আপত্তিকেও প্রকাশ্যে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে ঢাকা। চীনের এই প্রকল্পকে ভারত নিজের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে মনে করে।
চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে উষ্ণ হয়েছে। অবশ্য মাঝেমাঝে কিছু ধাক্কাও যে ছিল না, তা নয়। অপরদিকে ভারতের ঘরোয়া রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরণের হতাশার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এতসব কিছু যখন ঘটে যাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ছিল নগন্য এক খেলোয়াড়। কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে ফের সরাসরি খেলার ময়দানে উপস্থিত মার্কিনিরা। বিগেনের ঢাকা সফরের সময় চীনের অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছিল সর্বত্রই। মার্কিন কূটনীতিক দলের এক সদস্য চীনকে (নাম উল্লেখ না করে) তুলনা করেন শহরে আসা “নতুন এক ব্যাংকারে”র সঙ্গে, যে কিনা দীর্ঘদিনের বন্ধুদের কাছ থেকে বাংলাদেশকে পটিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, সকল দিকে ভারসাম্য রক্ষা করার যেই সুনাম শেখ হাসিনার রয়েছে, তা আরও কঠিন হয়ে গেছে। বিগেনের সফরের পর সম্ভবত চীনকে আশ্বস্ত করতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে মোমেন টেলিফোনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে আলাপ করেছেন।
আবার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে যতই সবার জন্য সমৃদ্ধি ও উন্মুক্ত পরিবেশের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হোক না কেন, বাস্তবে এই কৌশলে নিরাপত্তা ও সামরিক বিষয়াদিও জড়িত। আর সামরিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশিরা সাধারণ অর্থে খুবই সংবেদনশীল; শেখ হাসিনা তো বটেই।
মহাশক্তিধর দেশগুলোর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়া নিয়ে বাংলাদেশের অস্বস্তি বেশ লক্ষনীয়। যেমন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে মোমেন মন্তব্য করেছেন যে, “তারা চায় অস্ত্র বিক্রি করতে, আর আমরা চাই শান্তি।”
অবশ্য বাংলাদেশের অকূটনৈতিক-সুলভ এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনে আদৌ কতটা প্রভাব রাখেন তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। তারপরও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে সামনে রেখে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উপস্থিতিকে বেশ সন্দেহ নিয়েই দেখা হয় ঢাকায়।
এসব জেনেশুনেই একেবারে আদর্শ অতিথির মতো বিগেন স্বাগতিক দেশকে তুষ্ট করতে কোনো চেষ্টা বাদ রাখেননি। তিনি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন কার্যক্রমের “মূলকেন্দ্র” (সেন্টারপিস) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের ভয়াবহ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে করা প্রশ্ন করা তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ঢাকায় তিনি রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের কোনো নেতার সঙ্গে সাক্ষাতই করেননি, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি দীর্ঘদিনের মার্কিন সমর্থনের ব্যাত্যয়। বিগেন ভারতে যতদিন ছিলেন, ঢাকাতেও ঠিক ততদিন ছিলেন। বাংলাদেশকে যে যুক্তরাষ্ট্র স্বতন্ত্রভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, তারই হয়তো বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান সম্প্রতি হংকংয়ের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আগে দেশটির শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফরের রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। বিগেনের এই সফরও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সপ্তাহ কয়েক আগে হয়েছে। এর আগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও তারও আগে হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আগে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তাহলে বিগেনের এই সফরও কি বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের প্রতিকী বিদায়ী উপহার মাত্র?
বিগেনের দলের সদস্যরা অবশ্য তা মনে করেন না। মার্কিন প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বা এই কৌশলের বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে দলমত নির্বিশেষে জোর সমর্থন রয়েছে। ঠিক একই বার্তা বিগেন নিজেই দিয়েছেন পরবর্তীতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে।
লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বেশ আটঘাট বেধেই নেমেছে। মার্কিন এসব কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড মামলার এক আসামীর আশ্রয়ের মামলা পুনরায় সক্রিয় করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা। শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের আগস্টে নিজের পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বদলা নেওয়াকে নিজের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে ঠিক করে রেখেছেন। তাই তার কাছে ওই সন্দেহভাজন হত্যাকারীকে ফিরিয়ে আনতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাভাবিক সময়ে মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয় (অ্যাটর্নি জেনারেল যার প্রধান) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতা বা প্রভাবের বাইরে কাজ করে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন কোনো স্বাভাবিক প্রশাসন নয়। লেনদেন বা আদান-প্রদানের ভিত্তিতে কাজ করার সুনাম (বা দুর্নাম) রয়েছে বর্তমান প্রশাসনের। তাই রাশেদ চৌধুরীর আশ্রয়ের মামলা পুনরায় সক্রিয় করার বিষয়টি যদি শেখ হাসিনার কাছ থেকে কোনো বড় ধরণের ছাড় আদায় করার রাজনৈতিক চাল হয়ে থাকে, তাহলেও আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই।
আর এই সবকিছুকে যদি লক্ষণ হিসেবে বিচার করতে হয়, তাহলে মনে করতে হবে যে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সহসাই মিইয়ে যাওয়ার নয়। তার মানে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরুন বা জো বাইডেন নির্বাচিত হোন, শিঘ্রই হয়তো চীনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে চাপের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
চীন নিয়ে জো বাইডেনের নীতি হয়তো ট্রাম্পের মতো চাঁচাছোলা হবে না, তবে কোনো অংশে কম আক্রমণাত্মকও হবে না। বাইডেন বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আর বারাক ওবামার আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের “পিভোট টু এশিয়া” নীতির সূচনা হয়েছিল, যেখানে বাইডেনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ট্রাম্প নিজের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেই নীতিই স্রেফ ভিন্ন আঙ্গিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ওবামার অন্যান্য পররাষ্ট্র নীতি বাইডেন বহাল রাখবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তাই দ্বিদলীয় সমর্থনপুষ্ট “ইন্দো-এশিয়া প্যাসিফিক” কৌশলে বাইডেনও খুব পরিবর্তন আনবেন না। তাই বাইডেন নির্বাচিত হলেও, শেখ হাসিনা অনুভব করবেন, দ্য প্রেশার ইজ অন।●