ব্যতিক্রমী শক্তি?
করোনাকালে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের অবস্থা।
করোনা মহামারীর শুরুর দিকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইয়ের সভাপতি রুবানা হক বলেছিলেন, “দরিদ্র মানুষদের এক ধরনের ব্যতিক্রমী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে”। ব্যাপারটা এমন যেন, দরিদ্র এসব মানুষকে কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষার দেওয়ার আর প্রয়োজন নেই।
আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে একজন পোশাক শ্রমিক খুব সামান্যই সুযোগ-সুবিধা পান। এসব মানুষের শ্রমে গড়ে ওঠা কোটি কোটি ডলারের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের অংশীদারিত্বের সুযোগ নেই। এমনকি তারা খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতো নূন্যতম মজুরিটাও পান না। উপরন্তু বস্তিবাসী পোশাক শ্রমিকদের মাঝে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
পোশাক শ্রমিক নাজমার জীবনটার দিকেই একবার নজর দেওয়া যাক। তিনি একজন সিঙ্গেল মা। তিন সন্তান। মাসে আয় করেন মাত্র নয় হাজার টাকা। তিনি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। ইপিজেডের ভিতরে যেসব পোশাক কারখানা, সেগুলোতে কাজ করলে বাইরেরগুলোর চেয়ে বেশি বেতন পাওয়া যায়। সেই হিসেবে নাজমা অন্য অনেক পোশাক শ্রমিকের চেয়ে বেশিই আয় করেন।
কোভিড-১৯ এর এই সময়ে “ওভারটাইম” করে তিনি মাসে আরও এক থেকে দুই হাজার টাকা বেশি রোজগার করেছেন। এখানে বলা বাহুল্য, নাজমা সেই ভাগ্যবানদের একজন যাদের এই করোনাকালেও একটা চাকরি আছে এবং লকডাউনে এক মাস যখন কারখানা বন্ধ ছিল, তখন সাত হাজার টাকা (৮৭ ডলার) পেয়েছিলেন। তো এই নাজমাকেই তার মাসিক আয় থেকে চার হাজার টাকা (৪৭ ডলার) ঘরভাড়াসহ মাসকাবারি খরচ মিটিয়ে স্থানীয় মুদি দোকান থেকে নিয়মিত ধার করতে হয়। নাজমার এখনকার সবচে বড় দুশ্চিন্তা তার ছোট মেয়েটাকে নিয়ে। ওর কাশির সঙ্গে রক্ত যায়। মেয়েটার চিকিৎসার পেছনে এরইমধ্যে ২২০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটার আসলে কী হয়েছে, সেটাই এখনো নাজমা জানতে পারেননি। আট বছর ধরে নাজমা একজন পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে আজও কেন তিনি নিজের নূন্যতম প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারছেন না?
সর্বশেষ ২০১৯ সালে সংশোধিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, ইপিজেড অঞ্চলের বাইরের কোনো কারখানায় কর্মরত একজন পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকের সর্বনিন্ম বেতন আট হাজার টাকা (৯৪ ডলার)। সেই সময় সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক জরিপে দেখা গেছে, দুজন রোজগারি মানুষের একটা পরিবারে ৬ষ্ঠ ধাপের একজন পোশাক শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি হওয়া উচিত ১০০২৮ টাকা (১১৮ ডলার)। এটা বর্তমানে ওই একই ধাপের একজন শ্রমিক যা পান, তার চেয়ে ২০২৮ টাকা (২৪ ডলার) বেশি। এই জরিপে আরও দেখা গেছে, ৩২.২% শ্রমিকই প্রতিমাসে ধার করেন। আর ঢাকা, টঙ্গী ও গাজীপুরে যে সব শ্রমিক থাকেন, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অন্যদের তুলনায় আরও বেশি।
তাই এ রকম কম মজুরিতে জীবন ধারণকারী পোশাক শ্রমিক বিশেষ করে নারী পোশাক শ্রমিকদের অপুষ্টিতে ভোগা কিংবা দ্রুত কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, বিরাট সংখ্যক পোশাক শ্রমিক বরাবরই রক্তশুণ্যতা ও কারখানায় কাপড়ের ধুলা কণা এবং অসাস্থ্যকর কর্ম পরিবেশের কারণে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে ভোগেন। গত সেপ্টেম্বরে ব্র্যাকের স্কুল অফ পাবলিক হেলথ ও অন্যদের করা এক জরিপে দেখা গেছে যে, জরিপে অংশ নেওয়া ৭৭% পোশাক শ্রমিকই কোভিড-১৯ এর এই সময়ে মুজুরি কমে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের জন্য ডাল-ভাত জোটাতেও হিমশিম খাচ্ছেন। বাংলাদেশে গত চার দশকে বিকশিত হওয়া পোশাক শিল্পখাতের বেশিরভাগ শ্রমিক আজও নিজের তিনবেলার খাবার জোটাতেই হাবুডুবু খায়।
এদিকে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কোনো আলোচনা উঠলেই আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন স্থানীয় পোশাক কারখানা মালিকেরা। তখন বিভিন্ন মহল আবার তাদের এসব দায় এড়ানো আচরণকে সমর্থন জানাতে নেমে পড়ে মাঠে। উল্টোদিকে রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নত করতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় পোশাক কারখানাগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু তা সত্বেও উন্নত দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো কারখানাগুলোর ওপর সেলাইয়ের খরচ কমানোর জন্য যে চাপ দিচ্ছিল গত কয়েক দশক ধরেই, তা তারা জারি রেখেছে। আর এই দুপক্ষের দর কষাকষির চাপ এসে চাপছে অত্যন্ত অপ্রতুল মজুরি পাওয়া পোশাক শ্রমিকদের ঘাড়ে।
কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর আন্তর্জাতিক অনেক ব্র্যান্ড বাংলাদেশে তাদের কাজের আদেশ বাতিল করেছে কিংবা পোশাক প্রস্তুতকারকদের ওপর দাম কমাতে চাপ সৃষ্টি করেছে। যেমন শুধু টপশপ ব্রান্ডের পোশাক কোম্পানি আর্কাডিয়া গ্রূপ একাই তাদের ৯০ লাখ পাউন্ডের অর্ডার বাতিল করেছে। সেই সঙ্গে চলমান কাজের অর্ডারগুলোর দাম ২% কমিয়ে আন্তে চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই চাপটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে পড়েছে পোশাক শ্রমিকদের ওপর। অথচ এসব শ্রমিকদের বিপদের দিনের সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই।
একটা সুখবর হচ্ছে, এই করোনাকালীন সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশকে ৩৩.৪ কোটি ইউরো অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। টাকার হিসেবে যার পরিমাণ ৩৩৬ কোটির বেশি। তবে এই অনুদানের মাত্র ৩৩% শ্রমিকদের জন্য নগদ আর্থিক সহযোগিতা। তাছাড়া এই অনুদান করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইইউয়ের বাজারে পোশাক রপ্তানির যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সে তুলনায় খুবই সামান্য। এ বছরের এপ্রিল-মে, এই দুই মাসেই ইইউ বাজারে বাংলাদেশের এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৫০ কোটি ডলার অর্থাৎ ৫৫১ কোটি টাকার বেশি।
ফ্যাশন সাপ্লাই চেনগুলোর কাছে জবাবদিহিতাটাও বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারক দেশগুলোর জন্য একটা চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে দাতা দেশ, উন্নয়ন সংস্থা এবং ভোক্তা দেশগুলোর বৃহত্তর সুশীল সমাজের উচিত সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক পোশাক ব্রান্ডগুলোর উপর নজরদারি বজায় রাখা। সেই সঙ্গে এদের সবার একত্রে বসে ক্রয় ও উৎপাদন মূল্য যাচাই করে পোশাক শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ধার্য করা উচিত। এটা যদি করা যায়, কেবল তখনই ব্র্যান্ড তহবিলে পরিচালিত সিএসআর-কর্মসূচি, যেমন শ্রমিকদেরকে পুষ্টি বিষয়ক শিক্ষা দানের মতো উদ্যোগগুলো বাস্তব ভিত্তিক হবে। কারণ শ্রমিকদের যথাযথ পুষ্টিকর খাবার কেনা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতে পারলেই কেবলমাত্র তাদের পুষ্টি নিয়ে জ্ঞান অর্জন করা সাজে।
এছাড়া মানসম্মত মজুরির পাশাপাশি দেশে পোশাক শ্রমিকদের গ্রেপ্তার বা গরমপানি নিক্ষেপের আতঙ্ক ছাড়াই নাগরিক হিসেবে নিজ অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রামের সুযোগ থাকা উচিত। এই অধিকারের অভাবেই বকেয়া বেতন আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে এ বছরের জানুয়ারিতে পোশাক শ্রমিক আনোয়ার ও তার সহশ্রমিকেরা দমন-পীড়নের শিকার হন। ঢাকার ইপিজেড অঞ্চলের পোশাক শ্রমিক আনোয়ার ও তার সহশ্রমিকেরা গত ১০ মাস ধরে বকেয়া পাওনা বেতনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।
তবে একথাও সত্য যে পোশাক শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে কেবল উদ্বেগ প্রকাশ করলেই যে অবস্থা বদলাবে, তা না। কিন্তু এই উদ্বেগটা পুরো পোশাক শিল্পখাতের শ্রম ব্যবস্থাকে মর্যাদাজনক একটি অবস্থায় নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকের জীবন বরাবরই দুস্থ। কোভিড-১৯ আসলে দুস্থ এই পোশাক শ্রমিকদের জীবনে বাড়তি কষ্টের মাত্রা যোগ করেছে শুধু। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে চলা মজুরি শোষণ বন্ধে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে আর কত সময় লাগবে? কিংবা আশু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা। দরিদ্র এই মানুষগুলোর হয়ত “ব্যতিক্রমী ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা” থাকতে পারে। কিন্তু দিনশেষে আগামীকাল কী খাবে, তা নিয়েই এখনো তাদের ভাবতে হয়।●
আদিবা আফরোজ, গবেষক ও পরামর্শক।
* ইংরেজি থেকে অনুবাদিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত।
🔗 Netra News: Badrul Ahsan – Unadulterated Cruelty
🔗 CPD – “Study on “Livelihood Challenges of Garment Workers” (2018)”
🔗 GAIN – “Improving Nutritional Status of Garment Workers” (2017)
🔗 BRAC et al – “Impact of Covid-19 on the lives of garment workers” (Sept 2020)
🔗 New Age – “Terminated workers to receive monthly Tk 3,000 for 3 month” (Oct 2020)
🔗 Centre for Global Workers Rights – “Unpaid Billions” (Oct 2020)
🔗 SIDA – “Female factory workers get health education – and pass it on” (2014)
🔗 New Age – “1,100 workers of A One Garment hold demonstration in Dhaka” (Sept, 2020)
🔗 Daily Star – “Corona is only as cruel as capitalism’s weakest link” (April 2020)