১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সমর্থক সংগঠনে ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দাগিরি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা লন্ডন ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক একটি সংগঠনে ঢুকে নজরদারি করেছিলেন। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে মানবিক সাহায্য দেয়ার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল ওই সংগঠনটি। ব্রিটিশ পুলিশের সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা সম্প্রতি একটি পাবলিক ইনকোয়্যারিতে (জনস্বার্থে গঠিত উন্মুক্ত তদন্ত) এই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বৈঠকেও গুপ্তচর হিসেবে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানান।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের উদ্দেশ্যে রজার মুডি ও ডেভিড কনেট নামক দুই ব্যক্তি ১৯৭১ সালে লন্ডনে “অপারেশন ওমেগা” নামের ওই সংগঠনটি গঠন করেন। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসে সংগঠনের সদস্যরা ভারত সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এক গাড়ি খাবার ও পোশাক নিয়ে এক দফা ঢুকতেও সমর্থ হয়েছিলেন।
“ইউকে পুলিশের গোয়েন্দা কার্যক্রমে ঐতিহাসিক ব্যর্থতা” নামে একটি স্বাধীন নিরীক্ষণ (ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিভিউ) থেকে এ তথ্য জানা যায়। পুলিশের ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে ২০১৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মের অধীনে এই গণতদন্ত কাজ শুরু হয়।
এ বছর নভেম্বরের গোড়ায় শুরু হওয়া এই নিরীক্ষণের শুনানি থেকে কীভাবে বিভিন্ন সংগঠনের ওপর ব্রিটিশ পুলিশ নজরদারি চালিয়েছে তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিরীক্ষণ থেকে জানা গেছে, ১৯৬৮ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ পুলিশের অন্তত ১৩৯ জন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এক হাজারের বেশি রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর গোয়েন্দাগিরি করেছেন।
এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯ নভেম্বর তৎকালে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করা ওই কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। “এইচএন৩৪৫” নামে অভিহিত এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা সেই সময় “পিটার ফ্রেডেরিকস” নামে অপারেশন ওমেগা সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেন। সে সময় তিনি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এ স্পেশাল অপারেশন সার্ভিসে (এসওএস) কর্মরত ছিলেন।
ফ্রেডেরিকস ট্রাইব্যুনালে বলেন, এই সংগঠনের বিষয়ে তিনি প্রথম জানতে পারেন লন্ডনে বাংলাদেশের সমর্থনে আয়োজিত একটি সমাবেশ থেকে। পরে স্পেশাল অপারেশন সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফ্রেডেরিকসকে সংগঠনটিতে অনুপ্রবেশ করতে চাপ দেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স — যাকে ফ্রেডেরিকস তার সাক্ষ্যে “বক্স” নামে অভিহিত করেছেন — সেখান থেকেও তাকে একই পরামর্শ দেওয়া হয়।
তদন্ত দলের চেয়ারম্যান, হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি স্যার জন মিটিং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সংগঠনটির বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে ফ্রেডেরিকস বলেন: “তারা শুধুমাত্র মানবিক সাহায্য প্রদান বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়েছে। এ কথা বললে ভুল হবে না যে যারা বৈঠকে এসেছিলেন, বেশিরভাগই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভোগান্তি নিরসনেই আগ্রহী ছিলেন। তাদের একটা কর্মসূচি ছিল। তারা সেখানে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) গিয়ে যুদ্বের কারণে উচ্ছেদ হওয়া সাধারণ মানুষকে ঘর বা কুঁড়ে ঘর বা এ ধরনের কিছু তৈরি করে দেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন।” তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে এসেছিল এমন কারও কথা তার মনে নেই। এমন কারও সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কোনো কথা হয়েছে কিংবা এমন কেউ আদৌ সেখানে ছিল কিনা, তাও তিনি মনে করতে পারছেন না। ফ্রেডেরিকস বলেন, সেই বৈঠকে আসলে মানবিক সাহায্যটাই প্রধান বিষয় ছিল।
প্রাক্তন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অপারেশন ওমেগার বৈঠকগুলোতে “সাধারণত ১০ থেকে ১২ জনের মতো অংশ নিত। কখনো কখনো আরও কম।” তিনি বলেন: “বৈঠকগুলোতে সমস্যার সমাধান নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হতো না। বৈঠকে আমরা কাজ করতাম। যেমন, খাম জোগাড় করা, খামগুলো ভরা, বিতরণ করা ইত্যাদি… পরিচালনামূলক কাজই বেশি ছিল।”
তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান এই বর্ণনায় হতবাক হয়ে জানতে চান, এ ধরনের সংগঠনে গুপ্তচরবৃত্তির কী প্রয়োজন ছিল? তিনি ফ্রেডেরিকস কে বলেন, “আপনার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে অপারেশন ওমেগা মানবিক সাহায্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন ছিল। এটাও স্পষ্ট ছিল যে তারা কোনো অপরাধে জড়িত ছিল না। সর্বোচ্চ যে আইন তারা ভঙ্গ করেছে তা হলো, ‘ফ্লাইপোস্টিং’ (যত্রতত্র পোস্টার লাগানো) এবং তারা সুশৃঙ্খলভাবে, শান্তি বজায় রেখে প্রতিবাদ করেছে। অনেকেই ভাবতে পারেন, এসওএস কেন এমন একটি সংগঠনে গোয়েন্দা নজরদারির প্রয়োজনবোধ করেছিল এবং এ থেকে কীভাবে তারা লাভবান হতো। এ বিষয়টা দয়া করে ব্যাখ্যা করুন।”
উত্তরে ফ্রেডেরিকস বলেন: “আমিও তখন এ বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। আমাকে যখন অপারেশন ওমেগায় যোগ দিতে নির্দেশ দেয়া হয়, তখন আমি ভেবেছিলাম এখান থেকে খুব চমকপ্রদ কিছু হয়ত জানতে পারব। কিছু সময় পার হবার পর বুঝলাম যে এখানে তেমন কিছুই নেই। কিন্তু আমি জানি যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন অনেক কিছু হয় যেসব বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। তাই সে সময় আমি আসলে শুধু আমাকে দেয়া নির্দেশই পালন করে গিয়েছি।”
তিনি আরও যোগ করেন: “বিভিন্ন সংগঠনের ভেতর কিছু মানুষ থাকে যাদের অসহযোগিতামূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণ বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া দরকার হয়। আমাদের গোয়েন্দাগিরির পেছনেও এরকম একটা উদ্যোগ ছিল বলে আমার ধারণা। যে কোনো দলেই ভালো-খারাপ থাকে… বিষয়টা হলো, পরিস্থিতির উপর নজর রাখা। বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্যের যে লক্ষ্য ওই সংগঠনের ছিল, তা সফল হবে কিনা তা নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম। আমরা চাইনি এর মাধ্যমে কোনো নৃশংসতা ঘটুক বা ক্ষয়ক্ষতি হোক। রাস্তাঘাটে নৃশংসতা বা ক্ষয়ক্ষতি কিংবা কোনো নাগরিক, তা সে যে বর্ণ বা জাতীয়তাই হোক না কেন, কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা আমরা চাইনি।”
ফ্রেডেরিকসের সাক্ষ্যের অনুলিপি ইনকোয়্যারির ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত আছে। সঙ্গে এর আগে তার দেয়া আরও একটি সাক্ষ্যও রয়েছে।
ফ্রেডেরিকস তদন্ত কমিটিকে জানান, অন্য আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন অপারেশন ওমেগার বৈঠকে এসেছিল। এর মধ্যে ছিল “ইয়াং হাগানাহ” নামের একটি সংগঠনের কিছু সদস্য। ফ্রেডেরিকসের ভাষায় তারা ছিলেন “কয়েক দশক আগে ইসরাইলের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একদল মানুষ।”
এদের বিষয়ে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “যাদের কথা বলছি, তাদের বয়স ৫০ বা ৬০ এর ঘরে ছিল। আমি তাদের বিষয়ে আসলে বেশি কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু একটা বিষয় মনে হয়েছে, তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো ক্ষতি বা সমস্যা সৃষ্টি করতে আসেননি; তারা শুধুমাত্র নিপীড়িত মানুষদের সাহায্যের উদ্দেশ্যেই এসেছিলেন। আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে তাদের দেখে।”
দিনব্যাপী শুনানিতে এই কর্মকর্তা আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য দেন। ফ্রেডেরিকস জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের লন্ডন ভ্রমণকালে তার একটি বৈঠকেও এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা গোয়েন্দাগিরি করতে চেয়েছিলেন।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার নিম্নোক্ত আলাপ হয়:
বিচারপতি মিটিং: আপনার সাক্ষ্যে আপনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন — স্মৃতি থেকে বলা সেই ঘটনার বিবরণে আপনি বলেছেন, মার্বেলের মেঝে সম্বলিত বড় একটি বাড়িতে সংসদ সদস্য ব্রুস ডগলাস-ম্যান এবং জন স্টোনহাউজের মাঝে কোনো একটি আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে, আপনার বক্তব্য যদি আমি ঠিকঠাক বুঝে থাকি তো আপনাকে কায়দা করে সরিয়ে নেয়া হয়। ওই আলোচনায় পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তবে আপনি তার কাছে যেতে সমর্থ হননি। এই দুটো কী একই ঘটনা?
ফ্রেডেরিকস: ঘটনার স্থান ছিল এ্যালবার্ট মেমোরিয়ালের উল্টো পাশের একটি হোটেল। হোটেলটির নাম এখন মনে নেই। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তবে যে কক্ষে বৈঠক হচ্ছিল, সেখানে আমি ঢুকতে পারিনি। আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
বিচারপতি মিটিং: তাহলে আপনার ভাষ্য মতে, আপনি সংসদ সদস্যদের বিষয়ে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু আপনি শেখ মুজিবের কাছে যেতে চেয়েছিলেন? তাই তো?
ফ্রেডেরিকস: আমি সেটা চাচ্ছিলাম… কেন নয়? তার দেশে অন্য একদল নৃশংসতা চালিয়েছে, তিনি দেশটির নেতা। ফলে তার বিষয়ে জানাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদি এমন হয়ে যেত, এমন কখনো কখনো ঘটেও যায়… আপনি হয়ত নিতান্তই ভাগ্যক্রমে কোনো তথ্য পেয়ে গেছেন; কিন্তু পরে দেখা যায় সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য। তাই চোখ-কান খোলা রাখা, জায়গা মতো হাজির থাকাটা খুব জরুরী। পরে আপনি যখন তথ্য বা খবরগুলো সঠিক স্থানে পৌঁছে দেবেন, তখন আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই বলে দেবে কীভাবে সেই তথ্য কাজে লাগান যায়। আন্তর্জাতিক বিষয়াদি আমার চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন এমন ব্যক্তিরা আছেন। বিষয় এটাই।
ফ্রেডেরিকস যে বৈঠকের কথা বলছেন, তা ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে হয়ে থাকতে পারে। ওই সময় শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডন এসেছিলেন। অন্যথায়, ১৯৭২ এর জুলাইয়ে যখন শেখ মুজিব চিকিৎসার জন্য লন্ডনে এসেছিলেন, তখনও এ বৈঠক হয়ে থাকতে পারে। তবে শেখ মুজিবের এমন বৈঠকের কোনো পাবলিক রেকর্ড নেই। সুতরাং, এ বৈঠক হয় ব্যক্তিগত ছিল বা ফ্রেডেরিকস মুজিবের উপস্থিতি বিষয়ে ভুল করছেন।
ফ্রেডেরিকস বলেছেন, অপারেশন ওমেগার বৈঠক সংক্রান্ত সব কিছুর রিপোর্ট তিনি লিখিত জমা দিয়েছেন। কিন্তু বিচারপতি মিটিং এ বিষয়ে বলেন, “এসব বৈঠকের ওপর কোনো এসওএস রিপোর্টই পাওয়া যায়নি। আপনার নামে কিছু নেই, অন্য কারও নামে দেয়া কোনো রিপোর্টেও অপারেশন ওমেগার কোনো নথিতে উল্লেখ নেই।” কেন এমনটা হলো জানতে চাইলে ফ্রেডেরিকস বলেন, “আমি জানি না। তবে আমি যা বলেছি, তা সম্পূর্ণ সত্য বলছি।”●
ডেভিড বার্গম্যান — ব্রিটেনভিত্তিক সাংবাদিক — সম্পাদক, ইংরেজি সংস্করণ, নেত্র নিউজ।
🔗 Undercover Policing Inquiry – Transcript of Testimony of Peter Frederick, 19 Nov 2020
🔗 Undercover Policing Inquiry – Witness statement of ‘Peter Frederick’
🔗 Wikipedia – Operation Omega
🔗 BBC – What is the Undercover Policing Inquiry
🔗 Undercover Policing Inquiry – Website