পদ্মা সেতু দুর্নীতির ইতিহাস পুনর্লিখন
গত কয়েক বছর ধরে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার এবং এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম নানাভাবে রাষ্ট্রীয় রোষের শিকার হয়ে আসছিলেন। সেই সঙ্গে এ সময়টাতে ডেইলি স্টার যাতে সরকারের সমালোচনামূলক বা সরকার বিরোধী সাংবাদিকতা করা থেকে বিরত থাকে, সে জন্য প্রচুর শক্তিও ব্যয় করেছে সরকার। এই শক্তি ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য দুটি নজির হলো, ২০১৫ সালে সরকারি চাপে এই পত্রিকায় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দেয়া এবং ২০১৬ তে মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৬টি ফৌজদারি মামলা দায়ের।
সরকারি সেই চাপ এখনো আছে। শুধু ডেইলি স্টার নয়, দেশের যে কোনো স্বাধীনমনা সংবাদ মাধ্যমের উপরই সরকারের এ চাপ রয়েছে। কিন্তু ডেইলি স্টার বাস্তবিকভাবে যতটুকু সম্ভব, এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। মাহফুজ আনামের লিখিত বিভিন্ন কলামে এর প্রতিফলন পাওয়া যায়। তিনি মাঝে মাঝে নিজ লেখায় সতর্কতার সঙ্গে সরকারের সমালোচনাও করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি মাহফুজ আনাম তার পুরানো স্টাইলের বাইরে গিয়ে একটি কলাম লিখেছেন। পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান স্থাপন উপলক্ষে লেখা এ কলাম ছিল প্রধানমন্ত্রীকে নিবেদিত স্তুতি স্তবকে ভরা। তিনি লিখেছেন, এ সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর “একাগ্রচিত্ত সংকল্প”, “সাহস”’ এবং “লৌহ মনোরথের” ফলে।
মাহফুজ আনামের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা যেতে পারে, সাহসী সাংবাদিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে এ মূল্যটুকু দিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের মতো কর্তৃত্ববাদী সমাজ, যেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে চলেছে, সেখানে সংবাদপত্রকে মাঝেমাঝে এ ধরনের লেনদেন করতেই হয়। আবার মাহফুজ আনামের সমালোচকেরা বলতে পারেন, কলামটিতে তিনি নির্মাণ শ্রমিকদের প্রশংসায় একটি শব্দও খরচ করেননি; যে চীনা কোম্পানিগুলো নির্মাণ কাজ পরিচালনা করেছে, তাদের বিষয়েও কিছু বলেননি। আর সেনাবাহিনী কিসের ভিত্তিতে লোভনীয় সব ঠিকাদারি পেয়েছে, সে বিষয়ে এবং সেতুর নির্ধারিত নির্মাণ খরচ অতিক্রম করে যাওয়া বিষয়েও মাহফুজ আনাম নিশ্চুপ থেকেছেন।
আর এরমধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এই কলাম যে শুধু হাসিনার অতিপ্রশংসায় ভরপুর তাই না, বরং পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তার বিকৃতি ঘটান হয়েছে তার লেখায়। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ১.২ বিলিয়ন ডলারের (১২০ কোটি ডলার) ঋণ বাতিল করে। ফলে সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থ খরচে বাধ্য হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকই সরকারের প্রতি প্রশংসা নিবেদনে অংশ নিয়েছেন। তবুও মাহফুজ আনামের লেখাটা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ, তার সম্পাদিত পত্রিকা ডেইলি স্টার অতীতে বরাবরই জোরালোভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
মাহফুজ আনামের উল্লেখিত কলামের প্রাসঙ্গিক অংশে বলা হয়েছে: “বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জেআইসিএ এবং আইডিবি অবিবেচকের মতো এবং আয়নায় নিজেদের চেহারা না দেখে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করে। অথচ তাদের ‘দুর্নীতির অভিপ্রায়ে’ অভিযোগ পরে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। এরপর এ সেতু নির্মাণ একটি জাতীয় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সন্দেহ নেই, দাতাদের স্বেচ্ছাচার এবং দম্ভই এমন একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের মূল। কিন্তু এতে আমাদের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হলো। বাংলাদেশ সম্পর্কে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ কিংবা ‘ভিক্ষার ঝুলি’ নিয়ে বসে থাকার যে গৎবাঁধা চিত্র বিশ্ববাজারে ছিল, তাই দৃঢ়তর হলো।’’
বিভিন্ন কারণেই ডেইলি স্টারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় একটি পত্রিকা বলা যায়। নিজের পত্রিকার এই অবস্থান সত্ত্বেও মাহফুজ আনাম কলামটিতে লিখেছেন, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের তথ্য হাতে পেয়েও ঋণ বাতিল করাটা আসলে আন্তর্জাতিক দাতাদের “স্বেচ্ছাচার” ও “দম্ভ”, এবং তাদের এ সিদ্ধান্ত “অবিবেচকের মতো”, “আয়নায় নিজেদের চেহারা না দেখার” ফল।
বিশ্বব্যাংক কিন্তু ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণটি তড়িঘড়ি করে বাতিল করেনি। দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সংক্রান্ত প্রমাণাদি হাতে পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়নি এ আন্তর্জাতিক সংস্থা। বরং চেষ্টা করেছে “একটি বিকল্প, টার্নকি [শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ব্যাবসায়িক চুক্তি রক্ষা] পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের”, যেখানে শর্ত থাকবে যে সরকার প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে “উচ্চপর্যায়ে সংঘটিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে”।
সরকার যখন তদন্তের জন্য বিশ্বব্যাংকের দেয়া চারটি শর্তের মধ্যে দুটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তখনই কেবল বিশ্বব্যাংক চুক্তি স্থগিত করে। যে দুটি শর্ত সরকার মেনে নেয়নি, সে দুটি ছিল: ক. তদন্ত চলাকালীন নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের সরকারি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা এবং খ. বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্যানেলের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের অনুমোদন দেয়া।
এখানে কোন বিষয়গুলোকে মাহফুজ আনামের কাছে “স্বেচ্ছাচার”, “দম্ভ” বা “অবিবেচকের মতো” মনে হয়েছে তা অনুমান করা দুঃসাধ্য। বরং বলা যায়, বিশ্বব্যাংকের শর্ত প্রত্যাখ্যানের কারণে এ সব বিশেষণ শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য। যদি হাসিনা শর্তগুলো মেনে নিতেন, তাহলে এ সেতু অনেক আগেই নির্মাণ হয়ে যেত; খুব সম্ভবত বর্তমানের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম খরচে।
আনাম আরও লিখেছেন দুর্নীতির অভিযোগ পরবর্তীতে “ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়”। তার এই বক্তব্যও প্রকৃত ঘটনার একটি অসত্য উপস্থাপন। পদ্মা সেতু তত্ত্বাবধানের চুক্তি প্রত্যাশী ক্যানাডিয়ান কনসালটেন্সি কোম্পানি এসএনসি ল্যাভেলিনকে ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে নিষিদ্ধ করে বিশ্ব ব্যাংক। কোম্পানিটির সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছর কোনো কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অভ্যন্তরীণ সালিশের মাধ্যমে গৃহীত এ সিদ্ধান্ত কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নেয় এসএনসি ল্যাভেলিন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতির অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েই থাকে, তবে কেন নিজেদের ঘাড়ে দোষ নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেবে এই কোম্পানি? বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় এ চুক্তিতে এই কর্পোরেট গ্রূপের উপর এও শর্ত ছিল যে, প্রতিষ্ঠানটিকে এর কর্ম প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে কোনো দুর্নীতির সুযোগ তৈরি না হয়, সে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটির কর্ম প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন আনার শর্ত যুক্ত হয়।
দশ বছরের নিষেধাজ্ঞা কোনো হালকা বিষয় নয়। যদি কোম্পানিটি মনে করত যে বিশ্বব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই, তবে তারা কখনই এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিত না। উপরন্তু, বিশ্বব্যাংক ও এসএনসি ল্যাভেলিনের মধ্যকার সালিশি চুক্তিটিও হতো না। কারণ ওই সালিশি চুক্তিটি এমন শর্তেই হওয়ার কথা যেখানে ল্যাভেলিন বাংলাদেশের কর্মকর্তা/ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দুর্নীতির উদ্দেশ্যে একত্রে কাজ করার দায় স্বীকার করে নেবে।
সালিশি চুক্তি সম্পাদনের পর এসএনসি ল্যাভেলিনের সিইও একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। এতে বলা হয়: “এ মীমাংসায় আসার মাধ্যমে যে বিষয়টি আমরা স্পষ্ট করতে চেয়েছি তা হলো, আমরা ব্যবসা পরিচালনায় নীতিগত মান বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ সুশাসন অলঙ্ঘনীয় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”
এ কথা সত্য যে, দুজন এসএনসি ল্যাভেলিন কর্মকর্তা ও একজন বাংলাদেশী-ক্যানাডিয়ান ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ক্যানাডায় হওয়া ফৌজদারি মামলাটি খারিজ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা খালাস পেয়েছেন। কিন্তু তারমানে এই নয় যে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
মূলত যা ঘটেছে তা হলো মামলায় ক্যানাডিয়ান বিচারক রায় দেন যে, মামলার আগের শুনানিতে ওয়্যার-ট্যাপিং বা গোপনে ফোনালাপ রেকর্ডের অনুমোদন ছিল কিনা তা যথাযথভাবে প্রমাণিত হয়নি। ফলে মামলায় অভিযুক্ত তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তকারীরা ওয়্যার-ট্যাপিংয়ের মাধ্যমে যে প্রমাণাদি সংগ্রহ করেছিলেন, তাও গ্রহণযোগ্যতা হারায়। যেহেতু রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীরা মামলাটি সাজিয়েছিলেন ওয়্যার-ট্যাপে পাওয়া প্রমাণের উপর ভিত্তি করে, তাই মামলাটি আর চালানোর কোনো উপায় ছিল না। ফলে মামলাটি চালানোর কোনো বিকল্প পথ না থাকায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যান। ওয়্যার-ট্যাপে কী প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল তা অবশ্য এখনো জানা যায়নি।
ফলে এসব তথ্যের আলোকে নিশ্চয়ই এমন দাবি করা যায় না যে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এমন দাবির ভিত্তিতেই মাহফুজ আনাম লিখেছেন, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের ফলে “…আমাদের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হলো এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ বা চিরন্তন ‘ভিক্ষার ঝুলি’ নিয়ে বাংলাদেশের বসে থাকার যে গৎবাঁধা চিত্র ছিল তাই দৃঢ়তর হলো।’’
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার দায় যদি কারো থাকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করা ব্যক্তিদের উপর বর্তায়; যারা দুর্নীতির তদন্ত করতে চেয়েছেন, তাদের উপর না। মাহফুজ আনাম কী এখন বলবেন, ডেইলি স্টারও দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে? নিশ্চয়ই না। মাহফুজ আনাম কী তবে বিশ্বাস করেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, যেখানে তিনি নিজেই বোর্ড কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আছেন, সেই সংগঠনও “দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ” হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয়কে চিরস্থায়ী করার চেষ্টায় নিয়জিত? নিঃসন্দেহে তিনি তা বিশ্বাস করেন না। আর তা যদি না হয়, তবে এখন তিনি কেন বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ তুলছেন?
তাদের প্রতি মাহফুজ আনামের এই উষ্মা এক ধরনের ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী বোধ থেকে উদ্ভুত বলেই মনে হচ্ছে। খুব উঁচুমানের সম্পাদকেরাও সম্ভবত কখনো কখনো এ ধরনের ভাষার আকর্ষণ এড়াতে পারেন না। মাহফুজ আনামও তাই করেছেন। হয়ত এর মাধ্যমে তিনি সরকারের চাপ থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পাবার আশা করেছেন। অথবা তিনি একটা তাৎক্ষণিক বাহবা পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তথাকথিত “দেশপ্রেমিক” গোষ্ঠীর কাছ থেকে। এই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে তার কতখানি অর্জিত হয়েছে তা বলা মুশকিল; তবে মাহফুজ আনামের নিজের পত্রিকার নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে তার এই অবস্থান যে সাংঘর্ষিক তা স্পষ্ট।●
ডেভিড বার্গম্যান, ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।