নেত্র নিউজের প্রথম বছর: নির্বাচিত প্রতিবেদন
২০১৯-২০২০: সম্পাদকদের বাছাই করা ছয়টি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
২০১৯ সালের নভেম্বরে স্বাধীন জনস্বার্থবিষয়ক সংবাদমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নেত্র নিউজ। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ “জনগণের জন্য সাংবাদিকতা” শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয় নেত্র নিউজের যাত্রা। এই সম্পাদকীয়তে কোনো প্রতিবেদন বা নিবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে নেত্র নিউজ তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে: জনস্বার্থ, সুবিবেচনা ও নির্ভুলতা। এই তিন মানদণ্ডকে বজায় রেখে নেত্র নিউজ এই এক বছরে অনেকগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে নেত্র নিউজের সম্পাদকদের বাছাই করা ছয়টি প্রতিবেদন এখানে উপস্থাপন করা হলো।
১. মন্ত্রী কাদেরের ঘড়ির গোলমাল
শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন উপলক্ষেই অসংখ্য ছবি আপলোড করেন তার ফেসবুক প্রোফাইলে। এসব ছবিতে তার ঘড়ি-প্রীতি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। ওবায়দুল কাদেরের মন্ত্রণালয় (সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়) থেকে বিভিন্ন দরপত্র বা কাজের চুক্তি পেতে আগ্রহী ঠিকাদাররাও বিষয়টি জানেন। অভিযোগ আছে যে, এদের অনেকেই কাদেরকে তুষ্ট করতে উপহার দেন নামিদামি বিভিন্ন বিলাসবহুল ঘড়ি।
নেত্র নিউজের এই প্রতিবেদনের সূচনা হয়েছিল একজন হুইসেলব্লোয়ারের দেওয়া এমন তথ্যের ভিত্তিতে। এরপর কাদেরের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপলোড করা ছবি থেকেই তার পরা ঘড়িগুলোর মডেল ও দাম নির্ণয়ের কাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রেডিটের ঘড়ি বিষয়ক গ্রুপের সদস্যরা। লন্ডনের হ্যাটন গার্ডেনের কয়েকজন ঘড়িবিক্রেতাও এক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন।
এই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হই যে, ওবায়দুল কাদের নিজের নির্বাচনী হলফনামায় নিজের আয়ের যেই বিবরণী দিয়েছেন ও মন্ত্রী-এমপি হিসেবে তার যেই আয়, তার সঙ্গে এত দামি ঘড়ি কিনতে পারার বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পরবর্তীতে কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন যে, তিনি উপটৌকন হিসেবে এসব ঘড়ি পেয়েছেন। বাংলাদেশের সরকারি বিধি অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা (নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও) দামি উপটৌকন গ্রহণ করতে পারেন না।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর নেত্র নিউজের ওয়েবসাইট বাংলাদেশে ব্লক করে দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে, বিভিন্ন বৈশ্বিক সংবাদ মাধ্যমও এই ইস্যুতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দুর্নীত-বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই বিষয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে তদন্তের আহ্বান জানায়।
২. প্রভাবের কারবার: নগদ দুর্নীতি
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস। ব্যাংকিং খাতের মতোই এই খাতের তত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রত্যেক গ্রাহক লেনদেন করতে পারেন। দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে যুক্ত থাকায় এসব সার্ভিস তত্বাবধানও করা যায় সহজে।
এরপর এলো “নগদ”। ডাক বিভাগের মাধ্যমে অর্থ আদানপ্রদানকে ডিজিটাইজ করার নামে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেরই নামান্তর এই নগদ। কিন্তু এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্বাবধানে নেই। ফলে অর্থ পাচার সহ বিভিন্ন আর্থিক অপরাধ সংঘটনও এখানে অপেক্ষাকৃত সহজ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেধে দেওয়া বিভিন্ন বিধিনিষেধও তাদের মানতে হয় না। এ কারণে অন্যান্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে নগদ।
নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (বিডা) বিভিন্ন সংস্থার আপত্তি পাশ কাটিয়ে চলছে নগদের কার্যক্রম। এই কোম্পানি সরকারি ডাক বিভাগের হলেও, এর অপারেশন ও কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অনভিজ্ঞ থার্ড ওয়েভ নামে একটি বেসরকারি কোম্পানি (যারা নগদের ৪৯% শেয়ারের মালিক)। আর এই থার্ড ওয়েভে মালিকানা রয়েছেন সরকার দলীয় দুই জন এমপি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী উপ প্রেস সচিবের স্ত্রী।
আমরা দেখিয়েছি যে, ডাক বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওই দুই এমপি উপস্থিত ছিলেন। তারা যদিও ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে সেসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করছেন, তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে তারা সংসদ সদস্য ও শাসক দলের নেতা হিসেবে মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের অংশ হিসেবেই ছিলেন। ফলে প্রশ্ন উঠে তারা সেখানে প্রভাব বিস্তার করেছেন কিনা। সবচেয়ে বড় কথা, এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই এমপি ও প্রধানমন্ত্রীর সহকারি প্রভাব খাটিয়ে এই চুক্তি বাগিয়েছেন।
৩. বিজিবির মহাপরিচালক “ক্যাসিনো জেনারেল”
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর প্রধান মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে সংস্থাটিরই কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ একটি চিঠি পাঠান প্রধানমন্ত্রী বরাবর। ওই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা ও সীমান্ত চোরাচালানীর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক সেলিম প্রধানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হলেন জেনারেল সাফিনুল। আরেকজন পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রীর ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুর রহমান মারুফ।
এই অভিযোগের স্পক্ষে সেলিম প্রধানের সঙ্গে বিজিবি প্রধানের ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি, ভিডিও ক্লিপ ও কথোপকথনের স্ক্রিনশটও উদ্ধার করতে সক্ষম হয় নেত্র নিউজ। এছাড়া বিজিবির একজন কর্মকর্তাও শর্তে নেত্র নিউজকে জানান, বিজিবি প্রধানকে আড়ালে আবডালে “ক্যাসিনো জেনারেল” বলেও সম্বোধন করেন অধস্থনরা।
৪. মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড: ডিজিএফআইর গোপন প্রতিবেদন
কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খাঁন স্থানীয় পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সারাদেশে যখন তোলপাড় চলছিল, তখনই এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে নেত্র নিউজ। প্রতিবেদনটি মূলত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের একটি প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে করা। সেখানেই স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে “ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করে” সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করে হাসপাতালে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। পাশাপাশি বলা হয়, টেকনাফ পুলিশের মধ্যে মাদক নির্মূলের নামে “হত্যার প্রতিযোগিতা” বিরাজমান।
বাংলাদেশে পুলিশ সহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও সরকার থেকে বারবারই এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে ডিজিএফআইয়ের ওই প্রতিবেদনটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এই ধরণের প্রবণতা বিদ্যমান থাকারই এক ধরণের দলিল বা স্বীকারোক্তি। ডিজিএফআইয়ের মূল প্রতিবেদনে আশঙ্কা ব্যাক্ত করে বলা হয়, ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্থানীয় পুলিশ আটককৃত স্বাক্ষীদের হত্যা করতে পারে।
পরবর্তীতে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাস ও আরেক কর্মকর্তা লিয়াকত আলি তদন্তকারী সংস্থা র্যাবের হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও নেত্র নিউজ প্রকাশ করেছিল।
[সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খাঁন হত্যাকান্ড বিষয়ে নেত্র নিউজের প্রতিবেদন]
[র্যাবের হেফাজতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্যাতন বিষয়ে নেত্র নিউজের প্রতিবেদন]
৫. মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট: “পঙ্গু অবস্থায়” খালেদা জিয়া
বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যখন কারান্তরীন ছিলেন, তখন তার আইনজীবীরা তার স্বাস্থ্যগত দিক তুলে ধরে বিদেশে চিকিৎসার জন্য তার জামিন চান। তবে রাজনৈতিকভাবে সরকার ও শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
এই প্রতিবেদনে আমরা প্রকাশ করি যে, সরকারের তৈরি করা মেডিক্যাল বোর্ডই আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার সন্ধিবাতের অবস্থা গুরুতর রূপ নিচ্ছে। তার অবস্থা অনেকটা “পঙ্গু”। সেখানে এও স্বীকার করে বলা হয়, এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশে রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন বাংলাদেশের বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একে মাহবুবুল হক। অথচ, তিনিই প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সন্তোষজনক।
মেডিকেল বোর্ডের ওই প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে নির্দেশ অনুযায়ী পাঠানো হয়। কিন্তু তারপরও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই প্রতিবেদন আমলে নেননি। তাকে জামিনও দেননি।
৬. সরকারি হ্যাকিং: “আমরা ফেসবুক হ্যাক করি”
বেশ কয়েকজন হুইসেলব্লোয়ার নেত্র নিউজকে বিভিন্ন নথিপত্র ও প্রমাণ দিয়েছেন যে বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) হয়ে বেসামরিক ঠিকাদাররা হ্যাকার ও অনলাইন ট্রল দল পরিচালনা করেন। বেসরকারি চুক্তিভিত্তিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামরিক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক, রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বী, বিরোধী গোষ্ঠী ও ছাত্র সংগঠকদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন সাইবার অপরাধ পরিচালনা করে। আমরা এটিও দেখিয়েছি যে, হ্যাকাররা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকেই কাজ করেন। এই প্রতিবেদনের প্রকাশের পর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বাংলাদেশের দুইটি হ্যাকার গ্রুপকে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করেছে।