তিন আহমেদ ভাইয়ের বিচার
সারাংশ: সেনাপ্রধানের তিন ভাইয়ের খুনের দায়ে সাজা হয়েছিল যে মামলায়।
বাংলাদেশের বর্তমান সেনাপ্রধানের তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে খুনের মামলা নিয়ে দেশে নতুন করে চ্যাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টারস মেন” (ওরা প্রধানমন্ত্রীর লোক) প্রচারের পর নতুন করে এই চ্যাঞ্চল্য তৈরি হয়। মামলাটিতে খুনের দায়ে সাজা পাওয়া জোসেফ, হারিস এবং আনিস বর্তমান সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের আপন তিন ভাই।
১৯৯৬ সালের ৭ মে গুলিবিদ্ধ হন মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা নামের এক ব্যবসায়ী। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ভর্তি করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ)-তে রাখা হয়। সেখানে তিনি কথা বলার মতো সুস্থ হয়ে উঠলে একটি জবানবন্দি দেন। ম্যাজিস্ট্রেট মরতুজা আহমেদের কাছে দেয়া এই জবানবন্দিতে তিনি বলেন:
“আমার নাম মোস্তাফিজুর রহমান। আমাকে জোসেফ, হারিছ, আনিছ, মাছুম, এরা মারছে। এদের সাথে আছিম ও কাবিল ছিল আরো ৫/৭ [জন] ছিল দেখলে চিনতে পারব। আমার বড় ভাই শাহজাহানের বাসার সামনে ঘটনা। দিনে ২ ১/২ [২:৩০] টার দিকে ঘটনা। হারিছ লাইসেন্স করা রিভলভার দিয়ে গুলি করে। মাছুম ৫ ষ্টার পিস্তল দিয়ে পায়ে গুলি করে। আমি পড়ে গেলাম। যোসেফ আমার কোমড় হতে পিস্তল নিয়ে যায় এবং ইহা দিয়ে আমার পেটে গুলি করে। অন্যান্য দের হাতে পিস্তল ছিল তারা এলোপাথারি গুলি করে। স্বাধীন এবং বাহার আমার সাথে ছিল। তাদেরকেও গুলি করে। স্বাধীনের গুলি লাগে, বাহারের লাগে না। ৪/৮, বক [ব্লক] এ লালমাটিয়া এর পুর্ব পার্শ্বে প্রেস এর মধ্যে ঘটনা। মোট ৯ টা গুলি লাগছে আমার গায়ে।” [লেখা ও বানান মূল জবানবন্দির হুবহু]
এর দুই সপ্তাহ পর ২০ মে মোস্তফা মারা যান। মোস্তফার স্ত্রী ঘটনার পরদিনই পুলিশের কাছে ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট দাখিল করেন। সেখানে তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে জোসেফ, হারিস, আনিস — এই তিন ভাইসহ আরও বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেন। পুলিশের তদন্ত শেষে ওই বছর ৮ অক্টোবর আদালতে জোসেফ, হারিস ও আনিস সহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে চার্জশিটে আরও একজনের নাম যুক্ত করা হয়। ফলে মোট অভিযুক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়। জোসেফ ও আনিস দ্রুতই গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু হারিস পালিয়ে যান ও ফেরারি আসামি হন।
বিচার শুরু হয় অষ্টম এ্যাডিশনাল সেশন্স জজের আদালতে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয় জুলাই ১৯৯৭ তে। বিচার কাজ চলার এক পর্যায়ে আনিস আদালতে জামিন পান।
রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগের পক্ষে ২২ জন সাক্ষী জোগাড় করে। এই সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন হত্যাকাণ্ড ঘটার সময় উপস্থিত দুই ব্যক্তি। এর একজন স্বাধীন কুমার মজুমদার, যিনি গুলি হওয়ার সময় মোস্তফার সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, তিনি লালমাটিয়া ব্লক এ-তে ছিলেন। এ সময় পথে তার সঙ্গে মোস্তফা এবং মোস্তফার এক বন্ধু রফিকুল ইসলাম ওরফে বাহারের দেখা হয়। তারা দুজন একটি বেবিটেক্সিতে করে যাচ্ছিলেন। তিনি তাদের দেখে হাত নাড়েন এবং তার তখন ওই বেবিটেক্সি থামিয়ে কথা বলার জন্য বেরিয়ে আসেন। তারা গল্প করার সময় এক দল লোক তাদের ঘিরে ফেলে গুলি করতে শুরু করে। স্বাধীন আক্রমণকারী হিসেবে তিন ভাই জোসেফ, হারিস ও আনিসসহ অন্য অভিযুক্তদের নাম বলেন।
আরেকজন উপস্থিত সাক্ষীর মধ্যে ছিলেন বাহার। তিনি সেই ব্যক্তি যে মোস্তফার সঙ্গে বেবিট্যাক্সিতে করে ওই এলাকায় আসছিলেন। তিনিও ঘটনার একই বর্ণনা দিয়ে বলেন, তাদেরকে ঘিরে ফেলে গুলি করা হয়। বাহার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেন। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন হাবিবুর রহমান মিজান; তিনি নিহত মোস্তফার ভাই। তিনি বলেন, তিনি তার ভাইকে গুলি করার ঘটনা শোনেন বাহারের কাছে এবং পরদিন তিনি স্বাধীনের সঙ্গে দেখা করেও ওই ঘটনা শোনেন। স্বাধীন তাকে জানান কী ঘটেছিল এবং তাতে তিন ভাইয়ের জড়িত থাকার কথাও উল্লেখ করেন।
মামলার শুনানিতে জোসেফ ও আনিস নিজেদের পক্ষে বলেন: নিহত মোস্তফা ফ্রিডম পার্টির একজন ঢাকাস্থ কর্মী ছিলেন এবং সেই সঙ্গে তার গ্রামের বাড়ি এলাকায় সর্বহারা পার্টির সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল। ঘটনার দিন মোস্তফা, স্বাধীন ও অন্যান্যদের মধ্যে চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে গণ্ডগোল বাধে। এর ফলে তাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়ে ওই দুজন গুলিবিদ্ধ হন। আসামিরা আরও বলেন, মোস্তফার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকায় তাকে প্রথমে গোপনে বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়ার শেষ পর্যন্ত তাকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়।
জোসেফ ও আনিস আরও দাবি করেন, রাজনৈতিক বিরোধিতার জেরে তাদের এই মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। আনিস ইতিপূর্বে মকবুল হোসেনের সঙ্গে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আসামিরা বলেন, মকবুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো হাবিবুর রহমান মিজান, যিনি খুন হওয়া মোস্তফার বড় ভাই। এছাড়া মিজান (ওই সময়ে) আওয়ামী লীগের একজন ওয়ার্ড কমিশনারও। মকবুলের প্ররোচনাতেই মিজান এখন আনিস ও তার ভাইদের মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।
এদিকে নিহত মোস্তফার ভাই হাবিবুর রহমান মিজান ও স্ত্রী রাশিদা পারভিন ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে মোস্তফার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন। তাদের ও আনিসদের এই দুই পরিবারের মাঝে কোনো শত্রুতা নেই বলে জানান মিজান। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, আনিস যে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা চেয়েছিলেন তা তিনি জানতেন না। তবে তিনি স্বীকার করেন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগে তার ভাই মোস্তফা আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
২০০৪ সালের ২৫ মে বিচারিক আদালত মোস্তফা হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করেন। জোসেফকে মৃত্যুদণ্ড এবং আনিস ও হারিসকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
পরবর্তীতে জোসেফ ও আনিস উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিলের সঙ্গে জোসেফ বিচারকদের সমীপে একটি চিঠি পেশ করেন। তাতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালতকে তা বিবেচনার আবেদন জানান। তিনি সেখানে লেখেন:
“আমি একজন সামাজিক ও আইন মান্যকারী ব্যক্তি। বাহিরে আমি ঢাকা আইডিয়াল কলেজের ২য় বর্ষের বি,কম ছাত্র ছিলাম। সুত্রস্থ মামলা সমন্ধে আমি কিছুই জানি না। একদিন রাত আনুমানিক ১০/১১ (দশ/এগার) টার সময় ধানমন্ডি থেকে প্রাইভেট কারে গাজীপুর যাচ্ছিলাম পথিমধ্যে ধানমন্ডি থানার ও,সি আমার গাড়ীর পিছে পিছে অনুসরন করে এবং টংগী ব্রিজের পূর্বে আমাকে গাড়ীসহ গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে উদ্দেশ্য মূলক ভাবে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে উত্তরা থানায় অস্ত্র মামলায় জড়িত করে এবং পরে ডিবি পুলিশ, ডিবি অফিসে আনিয়া আমাকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রচণ্ড নির্যাতন করে এবং আমার নিকট ৩(তিন) লক্ষ টাকা দাবী করে। ডিবি পুলিশের চাহিদা মত টাকা দিতে না পারিলে মিরপুর থানার ফ্রিডম পার্টির কো অডিনেটর এবং কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও বহু সন্ত্রাসী মামলা এবং অনেক হত্যা মামলার কুখ্যাত আসামী মোস্তফা হত্যা মামলায় জড়িত করিয়া দেয়। যাহা মোঃপুর থানার মামলা নং ১৮(৫)৯৬ তারিখ ৮/৫/৯৬ ইং। যেহেতু আমি মোঃপুর থানার ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলাম তাই আমাকে রাজনৈতিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য পুলিশ সুপরিকল্পিত ভাবে ষড়যন্ত্র করিয়া আমাকে সুপ্রস্থ মামলায় জড়িত করিয়াছেন আর মাননীয় দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল- ৩, ঘটনা স্থলের নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষীদের জবানবন্দি এবং জেরা ও ডি ডব্লিউ সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরা যথাযথ ভাবে পর্যালোচনা না করে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকের স্বাক্ষী গ্রহন না করে বিচারের রায় প্রদান করেন।” [লেখা ও বানান মূল আবেদনপত্রের হুবহু]
সমস্ত প্রমাণ বিবেচনার পর সেপ্টেম্বর ২০০৭-এ বিচারক একেএম ফজলুর রহমান এবং কামরুল ইসলাম সিদ্দিক আপিল আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন ও বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন।
এ পর্যায়ে আনিস আহমেদ আদালতে নিজেকে সমর্পণ না করে পলায়ন করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জোসেফ এরপর এ্যাপেলেট ডিভিশনে আপিল করেন। ২০১৫ তে দেয়া রায়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহা জোসেফের মৃত্যুদণ্ড লাঘব করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এর যথার্থতা ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে যদিও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে জোসেফ ছিলেন “হত্যাকাণ্ডের মূল নকশাকারী”, তথাপি গুলির আঘাত নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর “প্রধান” কারণ ছিল না।
২০১৮ সালের মে মাসে জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন। দণ্ডিত আসামিকে সব বিচারকাজ সমাপ্ত হবার পর এভাবে ক্ষমা করার ক্ষমতা সংবিধান বলে শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির হাতে রয়েছে।
পুলিশ হারিসের নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিশ তালিকায় যুক্ত করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি তা সরিয়ে নেয়া হয়। হারিসের নাম এখনো বাংলাদেশ পুলিশের দাগি আসামির তালিকায় আছে। হারিস ও আনিস দুজনই এখনো ফেরারি আসামি।●