ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে আমি বড় হয়েছি। পণ্যের চোরাচালান যে স্থানীয় অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে, এই তথ্য আমার কাছে আলাদা কোনো গুরুত্ব বহন করত না। বড় হতে হতে আমার কাছে বরং যে বিষয়টি অস্পষ্ট লাগছিল, তা হচ্ছে চোরাচালানের বিষয়টি যেখানে সবাই জানে এবং স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও যখন এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তখন সেখানে শুধু চালান বহনকারী দরিদ্র মানুষেরাই কেন গুলিবিদ্ধ হয়! ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে অসচেতন আমি প্রশ্ন করতাম, ভিকটিমরা কেন সবসময় বাংলাদেশিই হয়?
এই ডকুমেন্টারি প্রকল্পে যখন আমি কাজ শুরু করি, তখন খোদ সীমান্তের ধারণাটিই আমার অনুসন্ধানের মূল বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। যারা সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস করেন, কাঁটাতারের বেড়াগুলিকে তারা সীমানাপ্রাচীর বলে মনে করে না; এই কাঁটাতারের বেড়াগুলিকে স্থানীয়রা বরং দুই দেশের মাটির মিলন ও যোগাযোগের স্থান হিসেবেই বিবেচনা করেন। সীমান্তের এই দ্বৈত সত্তাই ছিল আমার আগ্রহের মূল জায়গা।
গত চার বছর ধরে আমি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের মনস্তত্ব বোঝার চেষ্টা করেছি। দেখেছি, এই ভুক্তভোগী মানুষগুলো প্রায়শই দুই রাষ্ট্রের কাছেই অপরাধী হিসেবে বিবেচিত। অথচ সীমান্ত নিয়ে আপনার/আমার কিংবা প্রশাসনিক/রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আর এই ভুক্তভোগীদের বোঝাপড়া ও ধারনা খুবই আলাদা। এমনকি তারা যখন জানতে পারেন, সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার অর্থ বুক পেতে বুলেটবিদ্ধ হবার ক্ষেত্র তৈরি করা, তখনও কাঁটাতারের ওপাশের মাটিকে তাদের অন্য দেশ বা অন্য জাতির মাটি বলে মনে হয় না। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এই তিন ভূখণ্ডের মানুষের মাঝে থাকা আত্মীয়তার বন্ধনটাও যে টুটে গিয়েছে, ভুক্তভোগী মানুষগুলো এখনো তা বোধ করেন না।
কাজ করতে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, জাতীয় সীমান্ত ধারণাটির ভেতর বহু ফাঁক-ফোকর রয়েছে। দুর্গম এই প্রাচীর কেবলমাত্র সীমান্তবাদীদের কল্পনাতেই বিদ্যমান। একজন শিল্পী হিসেবে আমি এই সীমান্তবাদী প্রাচীরের অলীক ধারনা এবং সেই অলীক ধারনা কীভাবে সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়, তা খোঁজার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর হিসাবে, ২০০০-২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে ১ হাজার ১৩৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আমি আমার এই কাজটি সীমান্তে হত্যার শিকার হওয়া মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং সীমান্ত সম্পর্কে এমন একটি ধারনা তৈরির পক্ষে ব্যবহার করতে চাই, যেখানে সীমান্ত বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং মিলনস্থল হিসেবে বিবেচিত হবে।