সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে দরিদ্র বাংলাদেশিদের লাশ

ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে যেমন মরছেন দরিদ্র বাংলাদেশিরা, তেমনি খুন হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী মানুষের আত্মার বন্ধন।

সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে দরিদ্র বাংলাদেশিদের লাশ
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বিএসএফের ছোড়া রাবার বুলেটে বাংলাদেশি যুবক মিলন হোসেন (৩৩) আহত হন। গুলিতে মিলনের দুই চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসেন। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে আমি বড় হয়েছি। পণ্যের চোরাচালান যে স্থানীয় অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে, এই তথ্য আমার কাছে আলাদা কোনো গুরুত্ব বহন করত না। বড় হতে হতে আমার কাছে বরং যে বিষয়টি অস্পষ্ট লাগছিল, তা হচ্ছে চোরাচালানের বিষয়টি যেখানে সবাই জানে এবং স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও যখন এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তখন সেখানে শুধু চালান বহনকারী দরিদ্র মানুষেরাই কেন গুলিবিদ্ধ হয়! ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে অসচেতন আমি প্রশ্ন করতাম, ভিকটিমরা কেন সবসময় বাংলাদেশিই হয়?

এই ডকুমেন্টারি প্রকল্পে যখন আমি কাজ শুরু করি, তখন খোদ সীমান্তের ধারণাটিই আমার অনুসন্ধানের মূল বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। যারা সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস করেন, কাঁটাতারের বেড়াগুলিকে তারা সীমানাপ্রাচীর বলে মনে করে না; এই কাঁটাতারের বেড়াগুলিকে স্থানীয়রা বরং দুই দেশের মাটির মিলন ও যোগাযোগের স্থান হিসেবেই বিবেচনা করেন। সীমান্তের এই দ্বৈত সত্তাই ছিল আমার আগ্রহের মূল জায়গা।

গত চার বছর ধরে আমি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের মনস্তত্ব বোঝার চেষ্টা করেছি। দেখেছি, এই ভুক্তভোগী মানুষগুলো প্রায়শই দুই রাষ্ট্রের কাছেই অপরাধী হিসেবে বিবেচিত। অথচ সীমান্ত নিয়ে আপনার/আমার কিংবা প্রশাসনিক/রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আর এই ভুক্তভোগীদের বোঝাপড়া ও ধারনা খুবই আলাদা। এমনকি তারা যখন জানতে পারেন, সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার অর্থ বুক পেতে বুলেটবিদ্ধ হবার ক্ষেত্র তৈরি করা, তখনও কাঁটাতারের ওপাশের মাটিকে তাদের অন্য দেশ বা অন্য জাতির মাটি বলে মনে হয় না। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এই তিন ভূখণ্ডের মানুষের মাঝে থাকা আত্মীয়তার বন্ধনটাও যে টুটে গিয়েছে, ভুক্তভোগী মানুষগুলো এখনো তা বোধ করেন না।

কাজ করতে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, জাতীয় সীমান্ত ধারণাটির ভেতর বহু ফাঁক-ফোকর রয়েছে। দুর্গম এই প্রাচীর কেবলমাত্র সীমান্তবাদীদের কল্পনাতেই বিদ্যমান। একজন শিল্পী হিসেবে আমি এই সীমান্তবাদী প্রাচীরের অলীক ধারনা এবং সেই অলীক ধারনা কীভাবে সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়, তা খোঁজার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর হিসাবে, ২০০০-২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে ১ হাজার ১৩৬ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আমি আমার এই কাজটি সীমান্তে হত্যার শিকার হওয়া মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং সীমান্ত সম্পর্কে এমন একটি ধারনা তৈরির পক্ষে ব্যবহার করতে চাই, যেখানে সীমান্ত বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং মিলনস্থল হিসেবে বিবেচিত হবে।

সীমান্তবর্তী এলাকা নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার চকসুবল গ্রামের মেয়ে তাসমিনা আক্তার। স্থানীয়ভাবে সে ঘোড়সওয়ার হিসেবে পরিচিত। সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামের এই মেয়েটি ঘোড়সওয়ার প্রতিযোগিতাগুলোতে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দেয়। ছিনিয়ে নেয় বিজয়ীর মুকুট। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় বালাপাড়া সীমান্ত। এখানকার পশ্চিম ছাতনাই ৭৯১ এর ৬ এস পিলার দিয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)র গুলিতে স্থানীয় যুবক খলিল (৩৫) নিহত হন। ভোররাতে বালাপাড়া সীমান্ত পথে খলিলসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। এ সময় ভারতের কোচবিহার ব্যাটালিয়নের ভুজারীপাড়া বিএসএফের সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে গুলি ছোড়েন। এ সময় অন্যরা পালিয়ে আসতে পারলেও খলিল গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন। পরদিন সকাল ৯ টার দিকে লাশটি উদ্ধার হয়। এরপর বিএসএফ সদস্যরা লাশটি তাদের জিম্মায় নেন। রাত পৌনে ৯ টার দিকে সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)র সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের পতাকা বৈঠক করে বিজিবির কাছে লাশটি ফেরত দেন। এর পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি নিহতের আত্মীয়-স্বজনদের ফেরত দেয়া হয়। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় বালাপাড়া সীমান্ত। এখানকার পশ্চিম ছাতনাই ৭৯১ এর ৬ এস পিলার দিয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)র গুলিতে স্থানীয় যুবক খলিল (৩৫) নিহত হন। ভোররাতে বালাপাড়া সীমান্ত পথে খলিলসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। এ সময় ভারতের কোচবিহার ব্যাটালিয়নের ভুজারীপাড়া বিএসএফের সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে গুলি ছোড়েন। এ সময় অন্যরা পালিয়ে আসতে পারলেও খলিল গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন। পরদিন সকাল ৯ টার দিকে লাশটি উদ্ধার হয়। এরপর বিএসএফ সদস্যরা লাশটি তাদের জিম্মায় নেন। রাত পৌনে ৯ টার দিকে সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)র সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের পতাকা বৈঠক করে বিজিবির কাছে লাশটি ফেরত দেন। এর পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি নিহতের আত্মীয়-স্বজনদের ফেরত দেয়া হয়। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি — ঠাকুরগাওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার শাহানাবাদ গ্রামের ছেলে রাজু (২২) ধর্মঘর সীমান্ত দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করলে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। এখানেই শেষ নয়। হত্যার পর লাশটিও ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে বিএসএফ। স্থানীয় সাধারণ মানুষ রাজুর লাশ ফেরত পাবার আশায় সারাদিন বসে থাকেন সীমান্তে। বাংলাদেশ থেকে বিজিবি যোগাযোগ করে বিএসএফের সঙ্গে। অবশেষে ১৯ জানুয়ারি রাত ৮টার পর বিএসএফ লাশটি হস্তান্তর করে। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
ঘরে ঝুলিয়ে রাখা মৃত স্বামী মহুবার রহমানের শার্টের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সুফিয়া বেগম (৩৫)। মহুবার রহমান একটি দলের সঙ্গে ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গড়ল ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত থেকে গরুর একটি চালান আনতে গিয়েছিলেন। সীমান্তপথে আসা গরুর চালানটি নিয়ে আসার সময় বিএসএফের গুলিতে নিহত হন তিনি। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
কুড়িগ্রাম, ৩ অক্টোবর ২০১৬ — সম্প্রতি বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়াড় ছড়ার বাসিন্দা কয়ছর আলী তার ছিটমহলের পরিচয়পত্র দেখাচ্ছেন। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দুখু মিয়া ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। তিনি উপজেলার বেহুলার চড় আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার এলাকা থেকে চোরাইপথে ভারত থেকে আসা গরু আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন স্থানীয় মাদ্রাসার মাঠে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তার লাশের গোসল সম্পন্ন হয়। ছবিটি ২০১৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তোলা। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান হয়ে আসা একটি গরু পাহাড়ি পথে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে সেটিকে টেনেহিঁচড়ে এপারে আনা হয়। ছবিটি সিলেটের বিছনাকান্দি সীমান্ত থেকে ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তোলা। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দুখু মিয়া ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। তিনি উপজেলার বেহুলার চড় আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার এলাকা থেকে চোরাইপথে ভারত থেকে আসা গরু আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন স্থানীয় মাদ্রাসার মাঠে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তার লাশের গোসল সম্পন্ন হয়। ছবিটি ২০১৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তোলা। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দুখু মিয়া ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। তিনি উপজেলার বেহুলার চড় আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার এলাকা থেকে চোরাইপথে ভারত থেকে আসা গরু আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন স্থানীয় মাদ্রাসার মাঠে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তার লাশের গোসল সম্পন্ন হয়। ছবিটি ২০১৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তোলা। ফটো: পারভেজ আহমেদ রনি/দৃক

পারভেজ আহমদ রনি, আলোকচিত্র সাংবাদিক, দৃক।