ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার: সেনাসদরের দাবি প্রত্যাখ্যান জাতিসংঘের, দুর্নীতির তদন্তের আহ্বান
বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি নিয়ে আল জাজিরার তথ্যচিত্র “ওরা প্রধানমন্ত্রীর লোক”-এ যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচির একজন মুখপাত্র। পাশাপাশি, বাংলাদেশ ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার কিনেছে বলে তথ্যচিত্রের দাবির বিষয়ে সেনাসদরের ব্যাখ্যাকেও অস্বীকার করেছে সংস্থাটি।
নেত্র নিউজকে শান্তিরক্ষা মিশনের ওই মুখপাত্র বলেন, “বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে এবং বিপরীতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যেই বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়ে আমরা অবগত আছি। দুর্নীতির অভিযোগসমূহ অত্যন্ত গুরুতর বিষয়, যা তদন্ত করে দেখা উচিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।”
তবে মুখপাত্র যোগ করেন যে, অনুসন্ধানী প্রামান্যচিত্রের মূল চরিত্র অর্থাৎ সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সাথে শান্তিরক্ষা কর্মসূচি বা পিস অপারেশন্স বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে লাখোয়া ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার পূর্বনির্ধারনী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরও জানান, ওই বৈঠক বাংলাদেশের অনুরোধেই আয়োজন করা হচ্ছে।
এছাড়া বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নজরদারির সরঞ্জাম ক্রয়ের অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) দাবিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘ। আইএসপিআর-এর মাধ্যমে সেনা সদরদপ্তর দাবি করেছিল, ওই নজরদারির যন্ত্র জাতিসংঘের একটি শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছিল।
তবে শান্তিরক্ষা মিশনের ওই মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে শান্তিরক্ষা কর্মসূচি বিষয়ক জাতিসংঘের চুক্তিতে “আল জাজিরার প্রতিবেদনে বর্ণিত ওই ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা জাতিসংঘ চিহ্নিত করেনি। এই ধরণের যন্ত্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে বাংলাদেশি কোনো কন্টিনজেন্টে ব্যবহার বা মোতায়েন করা হয়নি।”
যেই ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তা হলো “আইএমএসআই ক্যাচার”। একসঙ্গে কয়েক শত মানুষের মোবাইল ফোন নজরদারির কাজে এই যন্ত্র ব্যবহার করা যায়।
জাতিসংঘ মুখপাত্র বলেন, নির্দিষ্ট কিছু যোগাযোগে আড়ি পাততে কেবল একটি ক্ষেত্রেই এই ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করে জাতিসংঘ। বিশেষ নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে “জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে” এই ধরণের সরঞ্জাম একবার ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, এই ধরণের যন্ত্র শুধুমাত্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রমের নীতিমালা অনুযায়ী ও সরাসরি বাহিনী প্রধানের অধীনে ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচির অভ্যন্তরীন কাঠামো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সংস্থাটির একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক নেত্র নিউজকে বলেন, “আইএমএসআই ক্যাচারের মতো সরঞ্জাম শান্তিরক্ষা কর্মসূচির কোনো বিশেষ কন্টিনজেন্ট ব্যবহার করবে, এমনটা সত্যিই খুব অস্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে এই ধরনের যন্ত্র ব্যবহারের নির্দিষ্ট নির্দেশনা বাংলাদেশের থাকতে হবে — যেটি ছিল বলে আমার মনে হয় না। এমনটা আমি কখনই শুনিনি।”
ওই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক আরও বলেন, “‘স্টেটমেন্ট অব ইউনিট’ বা এসইউআর নথিতে একটি কন্টিনজেন্ট বা বহরের কী কী সরঞ্জাম প্রয়োজন, তার বিস্তারিত বিবরণী থাকে। পাশাপাশি, সরঞ্জামগুলো মোতায়েনের পূর্বে কী কী করণীয়, তারও বর্ণনা থাকে। মাঝেমাঝে এসইউআর নথিতে বর্ণিত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু বিষয় কন্টিজেন্টগুলো নিজ খরচায় বহন করে। কিন্তু আমি কল্পনাই করতে পারি না যে এই ধরণের অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি সরঞ্জাম কোনো কন্টিনজেন্টকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, “সেক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে আগে থেকেই জাতিসংঘের সম্মতি থাকতে হবে। কিন্তু আমি কখনও শুনিনি যে জাতিসংঘ কখনও এই ধরণের সম্মতি দিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণত গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে না, কখনই করে না।”
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে যা বলা হয়েছে
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ইসরায়েলি একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি আইএমএসআই ক্যাচার ক্রয় করেছে। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না। দেশটির সঙ্গে যেকোনো ধরণের বাণিজ্যই অবৈধ। তথ্যচিত্রে দেখানো হয়, ওই যন্ত্রের উৎপাদক দেশ হিসেবে হাঙ্গেরি উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ইসরায়েলের পিকসিক্স নামে একটি কোম্পানির তৈরি।
এই সরঞ্জাম ক্রয়ে মধ্যস্থতা করেছেন আয়ারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা। ওই মধ্যস্থতাকারী আল জাজিরার গোপন ক্যামেরায় বলেন, “এই প্রযুক্তি খুবই আক্রমণাত্মক ও অনধিকারপ্রবেশমূলক। আপনি চাইবেন না যে জনগণ জানুক এই যন্ত্র আপনারা ব্যবহার করছেন।”
ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান থেকে সরঞ্জামটি ক্রয়ের বিভিন্ন নথিপত্র প্রদর্শন করা ছাড়াও, তথ্যচিত্রে ওই আইরিশ ব্যক্তির গোপনে ধারণকৃত বক্তব্যও প্রচার করা হয়। পাশাপাশি, এই যন্ত্র ক্রয়ের শর্ত হিসেবে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানটির সাথে একটি “নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট” বা তথ্য প্রকাশ না করার একটি চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী।
পাশাপাশি, তথ্যচিত্রে আরও দেখানো হয় যে, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানটির দুই গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর দুই সদস্যকে যন্ত্রটি পরিচালনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী যা বলেছে
তথ্যচিত্রের এই নির্দিষ্ট দাবির বিষয়ে সেনাসদর থেকে “তীব্র প্রতিবাদ” জানানোর কথা বলা হয় আইএসপিআর-এর বিবৃতিতে। বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানী থেকে ক্রয়কৃত সিগন্যাল সরঞ্জামাদিকে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।”
এই দাবির প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের সাথে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করে। এরপর সংস্থাটির একজন মুখপাত্র বলেন, “এই ধরণের যন্ত্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে বাংলাদেশি কোনো কন্টিনজেন্টে ব্যবহার বা মোতায়েন করা হয়নি।”
কেন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কাছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সংবেদনশীল। এই কর্মসূচিতে সৈন্য বা সদস্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। ২০১৬ সালে সরকারি নথির বরাতে বার্তাসংস্থা এএফপি জানায়, মিশনে অংশগ্রহণকারী দশ সহস্রাধিক বাংলাদেশি বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ৭৫০০ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়ে থাকেন।
এই বিষয়টি সামরিক বাহিনীর কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ২০০৭ সালে সামরিক হস্তক্ষেপের অন্যতম কারণ হিসেবে শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়াকে দায়ী করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের স্বপক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে দৃশ্যত অবৈধ ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার ক্রয়ের সাথে শান্তিরক্ষা মিশনকে জড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেনি সেনাসদর।●