সেনাপ্রধান ও তার পরিবারের দুর্নীতি আমি কেন ফাঁস করেছি
ডিসেম্বরের কোনো এক সন্ধ্যার একটি আড্ডা যে আমার জীবনকে এমন উলটপালট করে দেবে, আমি জানতাম না। আমি শুধু জানতাম, বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি’র প্রধানের সাথে আমি দেখা করতে যাচ্ছি। জেনারেলের সাথে সাক্ষাৎ নিয়ে আমি বরং বেশ কৌতুহলী ও কিছুটা উত্তেজিত ছিলাম। তাকে প্রথম দেখায় মনে হলো বেশ চুপচাপ ভদ্রোচিত একজন মানুষ।
তবে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে বুদাপেস্টগামী ট্রেনে চড়ে দু’টো লাগেজ সমেত জেনারেল আজিজ যখন নামলেন, আমার মাথায় কিছুটা চিন্তার উদ্রেক হলো। মাত্র ৯০ মিনিটের ফ্লাইটের বদলে এত দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা কেন বেছে নিলেন তিনি?
তিনি নিজেই আমার কৌতুহল মিটিয়ে দিলেন। বললেন, নিজের সাথে কিছু সময় কাটাতেই এত দীর্ঘ যাত্রা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। এই লম্বা ট্রেন ভ্রমণে মধ্য-পূর্ব ইউরোপের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে সময় কেটে গেছে অনায়াসে।
তবে তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হলো। আমরা দ্রুতই একটি ট্যাক্সি ডাকলাম। আমি নিজেই এরপর তখনকার মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদকে তার হোটেলে নামিয়ে দিয়ে আসলাম। তিনি তখন ইউরোপোলের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপ এসেছেন। আমরা পরস্পরের ফোন নম্বর আদানপ্রদান করলাম।
জেনারেলের আচরণ ছিল খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। আমি যখন তাকে হোটেলে নামিয়ে দিলাম, তিনি বললেন একসাথে সেলফি তুলতে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো মেজর জেনারেল এমন খোলামেলা আচরণ করতে পারেন, আমি ভাবতেই পারিনি। আমি ভাবলাম, বাহ! ইনি জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা হতে পারেন, কিন্তু একেবারেই নিরহংকার মাটির মানুষ। বাংলাদেশে সেনা কর্মকর্তারা ক্যারিয়ারজুড়েই শিখেন যে উচ্চ নৈতিকতা ও মর্যাদা ধরে রাখতে হবে। আর এ বিষয়টি আমার চেয়ে ভালো কেই বা জানেন? ১৯৮৩ সালে আমার পিতা একজন তরুণ ক্যাপ্টেন হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন নিয়োজিত ছিলেন, তখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আমার জন্ম। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতা আমার জন্মলগ্ন থেকেই।
এদিকে সেদিনই আমি জেনারেল আজিজের কাছ থেকে একটি বার্তা পাই। তিনি আমাকে বিকেলে দেখা করতে বললেন। এরপর সন্ধ্যায় আমাদের সাক্ষাৎ হয়। আমাকে তখন তিনি চমকে দিয়ে বললেন, আমি তাকে কিছু পানশালায় ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পারবো কিনা। আমি জানতামই না যে জেনারেলের আবার বুদাপেস্টের ঝকমকে রাতের জীবন নিয়ে আগ্রহ আছে। রাতটা বেশ ভালোভাবেই উদযাপন করলাম আমরা। এতটাই যে, কোনো কোনো মুহূর্তে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না, বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর জেনারেলদের একজনকে সঙ্গ দিচ্ছি আমি। আর তারপর তিনি আমার সাথে এতটাই বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করছেন! আমি ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না যে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের এত তথ্য কেন আমাকে দিচ্ছেন। আমি তখন বিস্ময়ে আভিভূত।
জেনারেল আজিজ আমাকে পরেরদিনও দেখা করতে বললেন। পাশাপাশি জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কি ভিয়েনায় ছোট্ট এক সফরে যেতে পারি কিনা। আমি সানন্দে রাজি হলাম। পরদিন আনুমানিক দুপুর ১.৩০-এর দিকে আমরা বুদাপেস্ট থেকে রওনা হলাম। ভিয়েনা যেতে যেতে তিনি আমাকে বুদাপেস্ট নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলেন, হাঙ্গেরির জীবনমান নিয়ে প্রশ্ন করলেন।
বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও হাঙ্গেরি সবসময়ই আমার সবচেয়ে প্রিয় দেশ ছিল। থাকার জন্য বেশ অসাধারণ একটি দেশ। আমি তাকেও এমনটিই জানালাম। জবাবে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হাঙ্গেরিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ কেমন। আমি আবারও জবাব দিলাম যে, অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভালো, দ্রুতবর্ধনশীল। বিশেষ করে পর্যটন খাতে হাঙ্গেরি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
জেনারেল এরপর আমাকে তার ভাইয়ের গল্প বললেন। বললেন, তার ভাই “মি. হাসান” এখন ভারতে আছে। কিন্তু সেখানে তার অবস্থা ভালো নয়। তিনি চান তার ভাইকে ইউরোপ পাঠিয়ে দিতে। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি তার ভাইকে হাঙ্গেরিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করতে পারবো কিনা। এই কথায় সন্দিগ্ধ হয়ে উঠার কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া আমার মনে হলো, আজিজ যখনই তার ভাইকে নিয়ে কথা বলতেন তখনই তিনি আবেগময় হয়ে উঠতেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “আমার এই ভাইয়ের সাথে একই বিছানায় একসাথে ঘুমিয়েছি। তুমি যদি তাকে হাঙ্গেরিতে ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করতে পারো, তাহলে আমি সবসময়ই তোমার প্রতি ঋণি থাকবো।”
আমি বেশ বিস্মিত হলাম ভেবে যে এরকম একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, যার সাথে আমার পরিচয় বড়জোর ৩০ ঘণ্টার, তিনিই আমাকে তার ভাইকে সাহায্য করতে বলছেন। আমি ভাবলাম, তিনি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। দুই দিন পর জেনারেল আজিজ বাংলাদেশে ফিরে গেলেন। আমরা পরস্পরের তথ্যাদি আদানপ্রদান করে নিলাম। তিনি আমাকে শুভকামনা জানালেন। পাশাপাশি, বাংলাদেশে ফিরে যোগাযোগ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। মাত্র তিন দিনের মাথায় জেনারেলের ইমেইল পেলাম আমি। তিনি জানতে চাইলেন হাঙ্গেরিতে ব্যবসা শুরু করা যায় কীভাবে, প্রক্রিয়া কী। হাঙ্গেরিতে বিদেশীদের ব্যবসা স্থাপনে সহায়তা করেন এমন এক আইনজীবীর সাথে কথা বলে আমি তাকে জবাব দিলাম।
চার মাসের মধ্যে বে অব বেঙ্গল — জেনারেল আজিজের ভাই হারিস আহমেদের কোম্পানি — গঠন হলো। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আমি সব নথিপত্র পেলাম।
২০১৫ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে বুদাপেস্টে আসলেন হারিস আহমেদ, যাকে আমি মোহাম্মদ হাসান নামে চিনি। তাকে দেখে খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হলো না আমার। তিনি বুদাপেস্ট এসেছেন তার এক বন্ধুকে নিয়ে। আর তাদের কথাবার্তা ছিল সব বাংলাদেশের রাজনীতি-কেন্দ্রিক।
পৌঁছানোর কয়েক সপ্তাহ পর আমি হারিস আহমেদ ওরফে মোহাম্মদ হাসানকে তার হোটেল ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করতে শুরু করলাম। তিনি একটি খালি রেস্তোরাঁ ভাড়া নিলেন। আমি নিজেই যেহেতু ব্যবসায়ি, ফলে আমি তার ব্যবসায়িক কার্যকলাপে সাহায্য করতে পারিনি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম যে, তিনি হাঙ্গেরিয়ান ভাষা দূরে থাক, বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষাতেই কথা বলতে পারেন না। অগত্যা, আমিই তাকে স্থানীয় কিছু কর্মী খুঁজে দিলাম। কিন্তু হারিসের অসংলগ্ন ও অযৌক্তিক আচরণে দ্রুতই তার কর্মীরা অতিষ্ট হয়ে উঠলো। আমি নিয়মিতই তাদের কাছ থেকে হারিসের অব্যবস্থাপনা নিয়ে ফোন পেতে লাগলাম। জানলাম যে, তাদেরকে বেতনও দেওয়া হচ্ছে না সময় মতো। এরপর থেকে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করলাম।
ওদিকে জেনারেল আজিজ নিয়মিতই আমার সাথে যোগাযোগ করছিলেন। হারিস ও তার ব্যবসার খোঁজখবর রাখছিলেন। আমার মনে হলো, আজিজই বাংলাদেশ থেকে হারিসের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে বেসরকারি ব্যবসায় তার মনোযোগী হওয়ার কথা নয়। বিজিবি’র মহাপরিচালক হিসেবে তো তার নিজের দায়িত্ব পালনেই ব্যতিব্যস্ত থাকার কথা।
এদিকে বেঙ্গল হোস্টেল নামে হারিসের মালিকানাধীন হোস্টেলে উচ্চশব্দের পার্টি হতো। প্রতিবেশী ও এলাকার কমিটির ফোন বাড়তেই থাকলো। হারিসের পার্টি করার প্রবণতা ছিল অদ্ভুত। তিনি হোস্টেলের সকল বাসিন্দার জন্যই মদ কিনতেন। স্থানীয় বাসিন্দারাও ফ্রিতে মদ পেত। অনেক সময় হোস্টেলে কাউকে পছন্দ হলে তার থেকে টাকাও নিতেন না, বিশেষ করে মেয়ে অতিথিদের কাছ থেকে। কিন্তু ৫০ বছর বয়সী এক ধন্যাঢ্য ব্যক্তি মেয়ে অতিথিদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চান — এই বিষয়টি আমার কাছে রুচির পরিপন্থী মনে হলো। পাশাপাশি, এটিই ছিল আমার জন্য সন্দিগ্ধ হয়ে উঠার প্রথম কারণ।
একজন ব্যবসায়ী তার ব্যবসা এভাবে পরিচালনা করেন না। আমার মনে আছে, জেনারেল আজিজ আমাকে বলেছিলেন যে তার ভাই ভারতে ১৪ বছর ধরে আমদানি-রপ্তানি ও পর্যটন খাতের ব্যবসায় সম্পৃক্ত। কিন্তু বুদাপেস্টে আমি যেই ব্যক্তিকে দেখতে পাচ্ছি, তাকে দেখে মনে হলো তিনি সবে কোনো বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হয়েছেন! ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল আবারও হাঙ্গেরি সফরে আসলেন। ভাইকে দেখে গেলেন। জেনারেলের সাথে তার স্ত্রী ও আরেক সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন।
নিজের ভাইকে ধীরে ধীরে ব্যবসায় নিয়োজিত হতে দেখে তিনি খুব খুশি ছিলেন। হোস্টেল দেখতে গিয়ে আরও কিছু বিছানা ও হলরুমের রঙ পরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন। অপরদিকে রেস্তোরাঁ ছিল খালি। ফলে তিনি এই রেস্তোরাঁ ফেরত দিয়ে মালিকের কাছ থেকে অগ্রীম পরিশোধ করা টাকা বুঝে নিতে বললেন। কিন্তু হাঙ্গেরিতে আপনি যদি কোনো চুক্তি অকস্মাৎ বাতিল করতে চান, তাহলে আপনি অগ্রীম টাকা ফেরত পাবেন না। কিন্তু জেনারেল এ নিয়ে খুশি ছিলেন না। তিনি আমাকে বললেন মালিককে চাপ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তেমনটা শেষ অবদি ঘটেনি।
এদিকে হারিস ক্রমেই আমার কাছে তার আসল চেহারা উন্মোচন করতে লাগলেন। তার চারটি ফোন। সবসময় এসব ফোনে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। এ থেকে আমি ইঙ্গিত পেলাম যে তিনি আসলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি।
একদিন ভীষণ বিস্ময়ে আমি তাকে খোদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলতে দেখলাম। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি “আপা” হিসেবে সম্বোধন করছেন। আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম! আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে ফোন দিতো। আর হারিস তাদেরকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিতেন! আমি শিগগিরই বুঝলাম যে আমি কোনো সাধারণ মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি না। এই লোকের নিশ্চয়ই এমন কোনো বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আমি জানি না।
একদিন হারিস এক ব্যক্তিকে ফোন দিলো। আমি তার পাশে বসা ছিলাম। ভিডিও কলে তাকে “পিচ্চি” হিসেবে সম্বোধন করে হারিস আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি ছিলেন জোসেফ, তার ছোট ভাই। আমাকে তখন খুব বেশি কিছু তিনি বলেননি। শুধু জানালেন যে, ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি ভর্তি (ওই সময় জোসেফ কারাগারে ছিলেন; কিন্তু অসুস্থ দেখিয়ে তাকে হাসপাতালে রাখা হতো)।
তাদের কথোপকথন শুনে আমার মনে হলো জোসেফ ৩-৪ লাখ টাকায় বিজিবি জওয়ান নিয়োগের কাজ করছেন। আর হারিস অর্থ লেনদেন সাপেক্ষে আগ্রহীদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে সরাসরি পাঠিয়ে দিতেন জেনারেল আজিজকে। আমি নিজের চোখে এসব দেখেছি। ভাইয়ের সহায়তায় অন্তত ৮০০-১২০০ ব্যক্তিকে এভাবে বিজিবিতে ঢুকিয়েছেন হারিস। আর এসবের কাজ করতে গিয়ে খাবারদাবার ঘুম ভুলে লেগে থাকতেন তিনি।
আমি এর আগে এই পর্যায়ের দুর্নীতি কখনও দেখিনি। আমি আরও বিস্মিত হলাম যখন হারিস আমাকে বলতে লাগলেন “অপেক্ষা করেন, ফারুখ ভাই সেনাপ্রধান হবে।” ফারুখ হলো জেনারেল আজিজ আহমেদের ডাকনাম। আমি তখন হারিসকে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমি ভুল প্রমাণিত হলাম। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরেই হারিস যা আমাকে জানিয়েছিলেন, তাই পরে জেনারেল আজিজকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ তম প্রধান হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হলো। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে হারিসের পরিচয় আমার কাছে স্পষ্ট হলো। সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত আমার বন্ধুরা আমাকে হারিস ও জোসেফ সম্পর্কে বিভিন্ন খবরাখবর ও সংবাদের লিঙ্ক পাঠালো। আমাকে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পরামর্শ দিলো।
জেনারেল আজিজের প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু আমার বন্ধুদের পাঠানো সংবাদ যখন আমি পড়লাম, তখন নিজেকে প্রতারিত মনে হলো। মনে হলো খুব অনৈতিক কায়দায় আমি ব্যবহৃত হয়েছি। আমি জানতে পারলাম যে, হারিস আহমেদ এমন একজন দাগী আসামী যার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্ট জারি রয়েছে। আমি আরও জানলাম যে, জোসেফ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের একজন শীর্ষ গুণ্ডা।
আমি যখন হারিসকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি আমাকে খুব শান্তভাবে এসব অগ্রাহ্য করতে বললেন। তার মতে, এগুলো তার বিরুদ্ধে “অপপ্রচার”। তার ভাষ্য, তিনি ১২ জন মানুষকে খুন করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা মাত্র একটি। অর্থাৎ, তিনি বুঝাতে চাইলেন যে, এই মামলার মাধ্যমে আসলে তাকে ছোটখাটো গুণ্ডা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন শীর্ষ ডন।
তিনি আমাকে এও জানালেন যে, তিনি ভারতে দেশটির বহিঃগোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র’) প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু তাকে ভারত ছেড়ে আসতে হয়েছিল কারণ র’ তাকে জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছিল। আজিজ বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি ভবিষ্যতে আরও ভালো পদে গেলে র’ হারিসকে ব্যবহার করে তাকে চাপে ফেলতে পারে। আর সেই কারণেই আজিজ তাকে ভারত থেকে বের করে আনেন। আর আজিজ তখন তার প্রকৃত পরিচয় আমাকে দেননি, কারণ সেক্ষেত্রে আমি হয়তো রাজি হতাম না। আমি যখন আজিজকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনিও আমাকে একই বর্ণনা দিলেন।
আমি তখন কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অত্যন্ত আতঙ্কিত ছিলাম, নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। আমি ভাবলাম, হাঙ্গেরিয়ান পুলিশকে হারিসের বিষয়ে অবহিত করি। কিন্তু তার আগে আমি জেনারেল আজিজকে বললাম, আপনার ভাইকে এই দেশ থেকে নিয়ে যান। অন্যথায়, আমি স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে জানাবো।
জবাবে তিনি আমাকে ফোন করে হুমকি দেন। আমাকে তিনি একাধিক ইমেইলেও হুমকি দিয়ে বলেন, আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি হবে, যদি তার ভাইকে হাঙ্গেরি ছাড়তে হয়। এই অসহনীয় গ্যাঁড়াকলে আটকে থাকা অবস্থায় জেনারেল আজিজ ও হারিস সম্পর্কে আমার মনে ভীষণ বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। আমি হারিসকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করি। মাঝেমাঝে তিনি সারাদিন ফোন দিতেন দেখা করার জন্য। জেনারেল আজিজ এমনকি আমার শ্বশুরের সাথে যোগাযোগ করে আমাকে বোঝানোর জন্য বলেন।
ততদিনে হারিসের অবস্থা বেশ ভালো। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ হারিস বিজিবি’র বেশিরভাগ চুক্তি দেখভাল করতে শুরু করেন। পাশাপাশি, নিয়োগ দুর্নীতি তো আছেই।
আমার সাথে হারিসের যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমে গেল। আজিজ ততদিনে হাঙ্গেরির একটি সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশে এই কোম্পানি একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী ছিল। ওই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। কিন্তু হাঙ্গেরির ওই কোম্পানিটির অন্যতম মালিকের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন আজিজ। আর সেই ব্যক্তিই এরপর থেকে হারিসকে সহায়তা করতে থাকেন।
আজিজ যখন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদন্নোতি পেলেন, হারিস আমাকে ফোন দিলেন। হারিস বললেন, “ফারুখ ভাই পদন্নোতি পেয়েছেন। তিনি বলেছেন তার নতুন নম্বরে তাকে ফোন দিতে।” আমি এবার আর অবাক হলাম না। ২০১৭ সাল থেকে আমি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শুনছিলাম যে হারিস ব্যবসায় ভালো করছেন না। আজিজ তাই আবারও আমার সাহায্য চাইলেন। তিনি আমাকে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিলেন। তার পদ ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। বিনিময়ে হারিসকে আমার সহায়তা করতে হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আমার সবসময়ই শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু এই ব্যক্তি, জেনারেল আজিজ, যখন তার পদ ব্যাবহারের প্রস্তাব আমাকে দিলেন, আমার সমস্ত শ্রদ্ধা যেন মিইয়ে গেল। আমার মাথায় ঢুকলো না যে একজন তিন তারকা জেনারেল কীভাবে একজন পলাতক আসামীর জন্য এভাবে তদবির করতে পারেন।
এরপর ২০১৮ সালে আজিজ যখন সেনাপ্রধান হলেন, আমি আর বিস্মিত হইনি। কারণ, ২০১৫ সালেই হারিস আমাকে বলে রেখেছিল যে তার ভাইকে সেনাপ্রধান পদ উপহার দেওয়া হবে। আমি একে “উপহার” বলছি, কারণ হারিসের নিজের ভাষ্যমতেই, তিনি নিজে ও তার অপর দুই ভাই আনিস ও জোসেফ আওয়ামী লীগের জন্য অনেক কিছু করেছেন। দলের দুঃসময়ে তারা শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত ছিলেন। আর সেই কারণেই তাদের এক ভাই টিপুকে খুন হতে হয়েছিল।
আমাকে হারিস ঠিক এভাবেই বলতেন যে, “তার (শেখ হাসিনা) জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি। এখন তার আমাদেরকে দেওয়ার পালা।” আর আজিজকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে হাসিনা কেবল আনুগত্যের পুরষ্কারই দেননি; তিনি তৃতীয় মেয়াদে নিজের ক্ষমতা নিশ্চিত করলেন।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অনেক দেশে শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য আনতে সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চরম দুর্নীতি বিরাজ করে। ফলে সশস্ত্র বাহিনী এমন এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় যার উপর সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন জেনারেল আজিজ আহমেদকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেন, সরকার তখন আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র বাহিনীতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক যোগসূত্র ও দুর্বৃত্তায়নকে প্রতিষ্ঠা করলো।
আমার মনে হলো, নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো এই রাষ্ট্র-সমর্থিত অপরাধচক্রের নোংরা কার্যকলাপ জনসম্মুখে প্রকাশ করা। আমি বুঝি যে এই কারণে আমার ও আমার কাছের মানুষদের জীবন ও নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। কিন্তু যদি আমার এই ছোট একটি পদক্ষেপ আমার স্বদেশবাসীকে ন্যায়ের পক্ষে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করতে পারে, জাতি হিসেবে আমরা ইতিবাচক ও মৌলিক কিছু পরিবর্তন সামনে দেখতে পাবো।●
হুইসেলব্লোয়ার সামি (ছদ্মনাম) বর্তমানে আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের সাথে কাজ করছেন।