স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দণ্ডিত খুনি
ছবিগুলো জানান দেয় যে বাংলাদেশে এখন অপরাধী, পুলিশ এবং রাজনীতিবিদেরা একে অপরের সহযোগী।
সেপ্টেম্বর ২০২০-এ নেত্র নিউজ একটি ছবি প্রকাশ করে। ওই ছবিতে বাংলাদেশের সর্বজ্যেষ্ঠ বা সবচেয়ে সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ এবং সন্ত্রাসী জোসেফ আহমেদকে একত্রে দেখা যায়। ২০১৮ সালে জোসেফের ভাই সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত হবার ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় মুক্তি পান এই সন্ত্রাসী। এ ছবিটি আল জাজিরার অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রেও দেখানো হয়েছে।
ছবির সঙ্গে প্রকাশিত নেত্র নিউজের ওই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল, বেনজির আহমেদ ও জোসেফের মধ্যকার উষ্ণ সম্পর্কের কারণেই হয়ত জোসেফ নির্বিঘ্নে তাঁর পরিচয়পত্র এবং এ সংক্রান্ত কাগজপত্র জাল করতে পেরেছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি অসংখ্য আইন ভঙ্গ করেছেন। এসব অপকর্মের মাধ্যমে তানভীর আহমেদ তানজিল নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করে নেন জোসেফ। একটি ইউটিউব ভিডিওতে নেত্র নিউজ এসব তথ্য তুলে ধরেছিল।
বেনজীরের সঙ্গে জোসেফের ছবিটি আল জাজিরায় প্রচারিত অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রের আলোকে আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে। ১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান” নামে প্রচারিত অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রে জোসেফের ভাই হারিস আহমেদকে বলতে শোনা যায়, পুলিশ ও র্যাবকে তাঁর পরিবার কীভাবে নিজেদের “গুণ্ডা” হিসেবে ব্যবহার করে। বেনজীর আহমেদ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল পদে উন্নীত হন এপ্রিল ২০২০ এ। এর আগে ২০১৫ থেকে তিনি র্যাবের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে গোপনে ধারন করা ভিডিওতে হারিসকে বলতে শোনা যায়:
“বেনজীর আছে, র্যাব আছে, সব আছে। ওগো দিয়াই তো কাম করাইতেছি। অহন আমার গুণ্ডা অইলো র্যাব। আমার আর গুণ্ডা লাগে না তো, আমার তো এইডিই [র্যাব] গুণ্ডা। কাউরে উডাই লইয়া আও, কাউরে ধরো…ওরাও খায়, আমিও খাই। ডাইরেক্ট কথা!”
পুলিশ বিষয়ে তিনি বলেন:
“পুলিশই তো আমগো এহন গুণ্ডা। গুণ্ডা তো আর লাগে না। যার পুলিশ লাইন আছে, যার প্রশাসন আছে, সেই এহন গুণ্ডা।”
নেত্র নিউজের হাতে জোসেফের আরও একটি ছবি রয়েছে। জোসেফের এই ছবিটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে। ছবিটি তোলা হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় ২০১৮ এর শেষের দিকে, রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমায় জোসেফ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাস পর। তখনো জোসেফ নিজের মাথা মুড়াননি।
সংবিধান অনুযায়ি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছিল। ফলে বিষয়টার সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। তবে সেই ক্ষমা যদি হতো নতুন প্রমাণাদির ভিত্তিতে, যেখানে দেখা গিয়েছে যে জোসেফ নির্দোষ বা তাকে সাজা দিলে ভুল বিচার হতে পারে, সেক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার দেখা করাটা হয়ত খটকা লাগার মতো কিছু হতো না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘটনা একদমই এমন না। তৎকালিন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, যিনি জোসেফের শাস্তি লাঘব করে যাবজ্জীবন দিয়েছিলেন, তার রায়ে লিখেছিলেন যে জোসেফ “হত্যার মূল নকশাকারী”। আল জাজিরার তথ্যচিত্রের প্রমাণাদিও নির্দেশ করে, জোসেফ ক্ষমা পেয়েছিলেন শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর উদ্দেশ্য ছিল, সেনাপ্রধান হিসেবে জোসেফের ভাই আজিজ আহমেদের নিয়োগ পাবার পথ নিষ্কণ্টক করা। জোসেফ ক্ষমা পাবার এক মাস পরই সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ট হন তার ভাই আজিজ আহমেদ।
দেশের পুলিশবাহিনী যার অধীনে, তিনি হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশবাহিনীর আওতায় পড়ে র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবও। সে হিসেবে, আল জাজিরার তথ্যচিত্রে হারিস যা বলেছেন, তা বিবেচনায় নিলে বেনজীরের সঙ্গে জোসেফের ছবি যতোখানি গুরুত্ববহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তারচেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্ববহন করে না।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রটিতে হারিসকে সুনির্দিষ্টভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কথা উল্লেখ করতে শোনা যায়। ঘুষের আদান-প্রদান ও ভাগ বাটোয়ারার প্রসঙ্গ থেকে উঠে আসে তাদের কথা। পুলিশের বদলিতে কেমন টাকার আদান প্রদান হয় জিজ্ঞেস করলে হারিস উত্তর দেন:
“এয়ারপোর্ট থানার ওসি মিনিমাম পাঁচ থেকে দশ কোটি টাকা। ট্রান্সফারের টাকাটা খায় হইলো হোম মিনিস্টার, আইজি, পুলিশ কমিশনার। এই তিনজন। মনে করেন পাঁচ কোটি টাকার কনট্রাক্ট করলেন, তিন কোটি দিয়া দুই কোটি টাকা আমার। এটাই কমন। বুঝছেন? এই হইলো কাহিনী।”
এখানে আইজি বলতে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বোঝানো হয়েছে, যে পদে আছেন বেনজীর আহমেদ। শফিকুল ইসলাম আছেন পুলিশ কমিশনারের পদে।
এই ছবিগুলো একটি রূঢ় বাস্তবতা প্রকাশ করে। তা হলো বাংলাদেশে এখন ভয়ংকর অপরাধী, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতারা একে অপরের সহযোগী।
উল্লেখিত প্রত্যেকের কাছেই ঘুষের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়েছিল নেত্র নিউজ। কিন্তু কেউ জবাব দেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশের কাছে বিশেষভাবে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে তারা কেন তোফায়েল আহমেদ জোসেফের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তারা এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব দেননি।●
ডেভিড বার্গম্যান, ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।