ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার: সেনাবাহিনীর দাবি আবারও প্রত্যাখ্যান জাতিসংঘের
নজরদারির যন্ত্রপাতি কিনতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তি থাকার কথা দ্বিতীয়বারের মতো অস্বীকার করেছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচি বিভাগ।

ইসরায়েলের তৈরি নজরদারির যন্ত্র ক্রয় নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দাবিকে আবারও প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচি বিভাগের (ডিপিও) একজন মুখপাত্র নেত্র নিউজকে বলেছেন, এই সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মাধ্যমে সেনাসদরের জারি করার বিবৃতির প্রেক্ষিতে নেত্র নিউজকে এই কথা জানান তিনি।
১ ফেব্রুয়ারি প্রচারিত আল জাজিরার তথ্যচিত্র “অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন”-এ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ইসরায়েলি নজরদারির যন্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি উঠে আসে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পরদিনই দাবি করা হয়, জাতিসংঘের একটি শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে ব্যবহারের জন্য ওই যন্ত্র ক্রয় করা হয়েছিল। তবে ৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র নেত্র নিউজের প্রশ্নের জবাবে ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান, “আল জাজিরার প্রতিবেদনে বর্ণিত ওই ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে বাংলাদেশি কোনো কন্টিনজেন্টে ব্যবহার বা মোতায়েন করা হয়নি।”
কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্বিতীয় একটি বিবৃতি জারি করে। সেখানে দাবি করা হয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কর্মসূচি কর্তৃপক্ষের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ওই সরঞ্জাম কিনেছিল। তবে পরে ওই সরঞ্জাম আর ব্যবহৃত হয়নি।
কিন্তু নেত্র নিউজকে দেওয়া সর্বশেষ বিবৃতিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচির একজন মুখপাত্র এই দাবিও অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, কঙ্গোতে জাতিসংঘের স্থিতিশীলতা মিশনের (মনুসকো) একটি সিগন্যাল ইউনিটকে সিগন্যাল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটে পরিণত করার সক্ষমতা জানাতে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ সহ ২৮টি শীর্ষ অংশগ্রহণকারী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল।”
তিনি বলেন, “২০১৭ সালের জানুয়ারিতেই বাংলাদেশ জাতিসংঘকে জানিয়ে দেয় যে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রাংশ বা সরঞ্জাম বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো চুক্তিরও চেষ্টা করা হয়নি। ২০১৭ সালের ২০ জুলাই আরেকটি শীর্ষ অংশগ্রহণকারী দেশ তানজানিয়াকে ওই যন্ত্রাংশ মোতায়েনের জন্য বাছাই করা হয়।”
ইসরায়েলের তৈরি ইলেকট্রনিক সরঞ্জামটি মূলত “আইএমএসআই ক্যাচার”। একসঙ্গে কয়েক শত মানুষের মোবাইল ফোন নজরদারির কাজে এই যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। আল জাজিরার তথ্যচিত্রে দাবি করা হয়েছিল যে, সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক আইরিশ একজন মধ্যস্থতাকারীর সহায়তায় হাঙ্গেরির কিছু ফ্রন্ট কোম্পানির মাধ্যমে ইসরায়েলি কোম্পানি পিকসিক্সের তৈরী ওই গণ-নজরদারির প্রযুক্তি ক্রয় করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী।
নেত্র নিউজ এই বিষয়ে জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি বলেন, জাতিসংঘের বক্তব্য হলো, “এই সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য বাংলাদেশকে বাছাই করা হয়নি। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের বিবৃতিতে তেমনটিই ইঙ্গিত দিয়েছিল।”
তিনি যোগ করেন যে, বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালের জানুয়ারিতেই জাতিসংঘকে নিজেদের অপরাগতার কথা জানিয়ে দেয়। আর ছয় মাস পর জাতিসংঘ তানজানিয়ার সরকারের সাথে ওই সরঞ্জামের বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়। তার ভাষ্য, “[তানজানিয়ার সাথে জাতিসংঘের চুক্তি হয়ে যাওয়ারও] দুই বছর পর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওই সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়টি দুর্বোধ্য।”
এছাড়াও “সিগন্যাল ইউনিট”কে “সিগন্যাল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট”-এ রূপান্তরিত করতে জাতিসংঘ যে ধরণের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন বলে জানিয়েছিল, তা হলো জ্যামারসহ গাড়ি। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো, আইইডির (বিস্ফোরক) ইলেকট্রনিক সিগনেচার যেন ধরা পড়ে। এছাড়া গাড়িবহরের আশেপাশে থাকা বিভিন্ন ফোনে যেন আড়িপাতা যায়।
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার ক্রয়ে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিটি গোপনে ধারণকৃত ভিডিওতে বলেন, “এই প্রযুক্তি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ও অনধিকারপ্রবেশমূলক। আপনি চাইবেন না যে, জনগণ জানুক আপনারা এই ধরণের সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন।”
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে কাজ করা প্রখ্যাত সংগঠন প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনালের এলিয়ট বেন্ডিনেলি আল জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলি এই যন্ত্র দিয়ে একইসাথে “২০০-৩০০ ফোনে” আড়ি পাতা যায়। তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট এই মডেলটি মানুষের যোগাযোগে বিকৃতি ঘটাতেও সক্ষম। অর্থাৎ, আপনি চাইলে টেক্সটবার্তার (এসএমএস) বিষয়বস্তু পালটে দিতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি অন্য কারও পরিচয় ধারণ করতে পারবেন।”
এর আগে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত মিলে যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতালম্বীদের ওপর নজর রাখতে এই ধরণের প্রযুক্তি বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা — যেমন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআই — ব্যবহার করে থাকে।●