নারী ও নারীবাদ: বাস্তবতা আর বিচ্ছিন্নতার বয়ান

প্রেক্ষাপট ১: এই তো সেদিন। আনুশকা নামের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া মিষ্টি মেয়েটি মারা গেল। এ ঘটনায় দায়ী করা হলো ওরই সমবয়সী বন্ধু বা প্রেমিক দিহানকে। এই মৃত্যু ছিল অন্য মৃত্যুর চেয়ে ভিন্ন। কারণ এই মৃত্যুতে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণি তাদের কিশোরী মেয়ের নিরাপত্তা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা যেন স্পষ্ট দেখতে পেল। এই মৃত্যু ছিল অন্য মৃত্যুর চেয়ে ভিন্ন। কারণ এখানে মৃত্যুর বেদনাকে ছাপিয়ে উঠে এসেছিল সমাজের ভয়ঙ্কর কদর্যতা। এমনকি এই মৃত্যুর প্রতিবাদ জানানোর যে ভাষা আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, তাও ছিল ভয়াবহ। আনুশকার মৃত্যুর প্রতিবাদ জানানো এসব মানুষের কাছেও যে আনুশকারা নিরাপদ নয়, তা স্পষ্ট ছিল ধর্ষকাম মানসিকতা পোষণকারা প্রতিবাদের ভাষাতেও।

প্রেক্ষাপট ২: ভয়াবহ মাত্রায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে গত বছরের শেষের দিকে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন। সেই ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন যখন দেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলতে শুরু করে, তখনই আন্দোলনে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হতে থাকে নারীর পোশাক বিতর্ক, ধর্মীয় অবস্থান, সামাজিক রীতিনীতির প্রশ্ন। এসব বহুমুখী প্রশ্নের পরিবেশে সরকার ধর্ষণের শাস্তি জোরদার করে। ধর্ষণের শাস্তি এখন দেশে মৃত্যুদণ্ড।

তারপরও কিছুই বদলায়নি। প্রচার আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চোখ রাখলেই বোঝা যায় দেশে নারীর অবস্থা, আরও নাজুক হয়েছে তাদের নিরাপত্তা। কিছুই যে বদলায়নি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যায়। সংবাদ মাধ্যমে আসা খবরের উপর ভিত্তি করে সংস্থাটির ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের প্রথম নয় মাস অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৭৫টি। আর অক্টোবর, নভেম্বরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭১টি। এই সময়েই দেশে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন চলমান ছিল এবং উল্লেখিত ধর্ষণের সংখ্যা সেটাই যা খবরে এসেছে। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি।

এই দু’টি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে সরল যে প্রশ্নগুলো যে কোনো নারীর মনে উদয় হবে তা হলো, তাহলে এই ২০২১ সালে এসে আমরা বাংলাদেশের নারীরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? আমাদের বেঁচে থাকার, স্বাধীন জীবনযাপনের, মর্যাদার, শিক্ষার, স্বাস্থ্যের, উপার্জনের অধিকারগুলো কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? নারীবাদী আন্দোলনের অর্জনই বা কতটুকু?

বাংলাদেশে ধর্ষকাম মানসিকতা ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে যে দেশের নিয়ন্ত্রণবাদী রাজনৈতিক কাঠামো সবচেয়ে বড় কারণ, তা আজ তত্ত্ব না জেনেও বলা যায়। রাজনৈতিক ব্যর্থতার আলোচনায় আজ না গিয়ে ফিরে দেখি, কেন বাংলাদেশে নারীর অবস্থান বদলাতে পারছে না নারীবাদী সংগঠনগুলোও।


বাংলাদেশে নারীবাদের পথিকৃৎ হিসেবে আজ যতই বেগম রোকেয়ার নাম উচ্চারিত হোক, তাঁর সেই আমলে কিন্তু তিনি নারীবাদী হিসেবে আলোচিত হননি। তিনি সমাজের ঘেরাটোপ মেনেই নিজের তাগিদে লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি সমাজ সংস্কারের কথা বলেছিলেন এবং সে কথা বলতে গিয়ে নারীর অধিকারের কথা বলেছেন, সমাজে নারীর ভোগান্তির কথা তুলে ধরেছেন।

এরপর সবচেয়ে বেশি আসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বা কল্পনা দত্তের নাম। কিন্তু তারাও যে তাগিদ থেকে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আজকের নারীবাদী ধারনার সঙ্গে তাদের সেই স্পৃহার যোগ খোঁজাটাও প্রমাণ করে না যে তারা নারীবাদী ছিলেন।

একই কথা খাটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নেওয়া নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বেলায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক শোষণ থেকে মানুষের মুক্তি বা দেশের মুক্তিই ছিল তাদের চেতনার ধারক। নারী হিসেবে নিজের পৃথক সত্ত্বা নিয়ে এসব সাহসী নারীরা যুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছিলেন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে পুরুষের থেকে পৃথক হয়ে, পৃথক সত্ত্বা হিসেবে নারীদের মধ্যে কিংবা সমাজে নারীবাদের চর্চা আলাদা করে চোখে পড়ে ৭০/৮০-র দশকে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তখন এনজিওগুলোর প্রসার ঘটছে। এসব এনজিওর হাত ধরে Women in Development (WID) প্রজেক্টের মাধ্যমে পশ্চিমা দাতা দেশগুলো সদ্য স্বাধীন একটি দেশে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে। ঢুকাতে থাকে “নারীবাদ”, “জেন্ডার ইস্যু” বা “জেন্ডার ইকুয়ালিটি”র মতো শব্দ।

এনজিওগুলোর নারীকেন্দ্রিক এই তৎপরতা সমাজে দু’মুখী ছুরির মতো কাজ করে: একদিকে এটি নারীর অধিকারের জায়গাগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে; আরেকদিকে প্রজেক্ট বাস্তবায়নই চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়ায় নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলো বিকশিত হতে না পেরে দিকভ্রান্তিতে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। গ্রামীণ নারীদের মধ্যে এইসব এনজিও কাজ করছিল। তারপরও নিজেদের স্বার্থেই তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক দল নারীকে নারীনেত্রী হিসেবে তুলে ধরে। ফলে এসব নারীনেত্রীদের নারী অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ দেখা গেলেও গ্রামীণ বা শ্রমজীবী নারীদের পাওয়া যায় না।

এছাড়া বাংলাদেশে নারীবাদের বিকাশে আরেকটি প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলতে হবে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তখন বামপন্থী দলগুলো খুবই তৎপর ছিল। ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী নারীরাও এ সময় নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতার কথা বলতেন। কিন্তু তারা যেহেতু পশ্চিমা বাম আন্দোলনেরই ধারক-বাহক, ফলে পশ্চিমা নারী স্বাধীনতার ধারনাই ছিল তাদের কাছে নারী অধিকারের ধারনা। বাম ঘরানার নারী সংগঠনগুলোর মধ্যে এ সময় উল্লেখযোগ্য সংগঠন ছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এই সংগঠনটির সভাপতি আয়শা খানমসহ অন্যান্য নারীনেত্রীরা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কর্মী। তাদের চিন্তাভাবনা এমন ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়নে বামপন্থী বিপ্লব হয়েছে মানেই যেন সেখানে নারীর সব অধিকার আদায় হয়ে গেছে। ফলে তারা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ওই আদলেই নারীর মুক্তি বা নারীর স্বাধীনতার ধারনা প্রচারে তৎপর ছিলেন।

একদিকে দাতা দেশগুলোর ফান্ডে চলা এনজিও তৎপরতা, আরেকদিকে কমিউনিস্টদের নারী মুক্তির ধারনার কবলে বাংলাদেশে তখন নারীর অধিকার, নারীর স্বাধীনতার বয়ানগুলো পুরোপুরি পশ্চিমা আদলে গড়ে উঠতে থাকে।

এ সময়ই অর্থাৎ ৮০’র দশকে আলোচনায় উঠে আসতে থেকে আরেকটি নাম: তসলিমা নাসরিন। তিনি কবিতা লিখতেন। ওই সময়টায় কবিতা লেখাও ছিল আলোচিত-সমালোচিত হওয়ার একটি মাধ্যম। তাই যেমন আমরা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দেখেছিলাম ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেও কবিতার কাঁধে ভর করতে। যাই হোক, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তসলিমার কবিতা ছাপা হতে থাকে। সেই সূত্রে লেখক, কবি বন্ধু-বান্ধবের সুবাদে পত্রপত্রিকায় যোগাযোগ বাড়ছিল তার। তিনি কলাম লিখতে শুরু করেন। বিষয়, পশ্চিমা আদলে নারীবাদ ও ইসলাম বিদ্বেষ। তসলিমা একসময় “লজ্জা” নামক একটি উপন্যাস লিখেন, যেখানে তিনি প্রতিশোধ পরায়ণ এক ধর্মীয়বোধকে উস্কে দেন। পরবর্তীতে মৌলবাদী ইসলামপন্থীদের হুমকিতে তসলিমা যখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন দাবি করেন, তিনি নারীর অধিকারের কথা বলায় তাকে ইসলামপন্থীরা দেশ ছাড়া করেছে। তসলিমা স্পষ্টত বাংলাদেশের নারী আন্দোলন ও ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। পশ্চিমা দুনিয়া তাকে লুফে নেয়। তসলিমা বাংলাদেশের নারীদের অধিকার আদায়ের কোনো আন্দোলনে না থেকেও, নারীবাদ বা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে কোনো নতুন কথা না লিখেও পেয়ে যান বাংলাদেশের নারীবাদী চিন্তকের তকমা। তাকে অনুসরণ করে গড়ে উঠতে থাকে একটি নারীবাদী ঘরানা।

এরপর বাংলাদেশে নারীরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে পথে থাকলেও শুধুমাত্র নারীর অধিকার কেন্দ্রিক আন্দোলন বলতে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনগুলোই সবচে জোরালো রূপ পায়। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন, ২০২০ সালে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের কথা বলা যায়।


বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলন ও নারীর অধিকার সম্পর্কিত আলোচনার দীর্ঘ অতীত থাকলেও নারীর নিরাপত্তাহীনতা দিন-দিন বেড়েই চলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। এছাড়া ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন ৪৩ জন এবং ১২ জন আত্মহত্যা করেছেন। একইসঙ্গে এই নয় মাসে ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেছেন নয়জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন নারী ও নয়জন পুরুষ।

আসক জানায়, এই সময় অর্থাৎ ওই নয় মাসে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ জন নারী। এর মধ্যে খুন হয়েছেন ২৭৯ এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ জন। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৬৮ নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। এছাড়া স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ১২ নারী।

এ সময়ের মধ্যে ১১ জন গৃহকর্মী খুন হয়েছেন এবং বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩২ জন। আর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চারজন এবং আত্মহত্যা করেছেন দুইজন গৃহকর্মী। এদিকে এই নয়মাসে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ২১ জন নারী।


বাংলাদেশে নারীবাদী তৎপরতা বরাবরই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, নারী অধিকার কর্মী বা মধ্যবিত্ত-উচ্চ-মধ্যবিত্ত কেন্দ্রিক আলোচনা ও আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। তাই ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন, তখন যেমন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী ইপিজেড এলাকার নারী পোশাক শ্রমিকেরা তাতে যোগ দেননি; তেমনই ২০২০ সালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন করেন, তখনও শ্রমজীবী মানুষদের এই আন্দোলনে দেখা যায়নি।

বিষয়টি এমন নয় যে এই সব গার্মেন্টস শ্রমিকেরা ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার হন না। বরং তাদের আরও অনেক বেশি যৌন হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাহলে কেন তারা এসব নারী আন্দোলনে আসেন না? এই মানুষগুলো কী তবে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন? আমাদের নারীবাদীরা বা এসব আন্দোলনে সোচ্চার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত শহুরে লোকজন হয়ত তাই বলবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসব আন্দোলনে ওসব শ্রমজীবী নারীদের কিছুই যায় আসে না। কারণ, তাদের রয়েছে আরও বড় সংকট — তাদের সংকট জীবন বাঁচানোর।

যে নারী শ্রমিক ইট ভেঙে খান, পিঠ উদাম করে প্রকাশ্যে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় তার একবারও নিজের পোশাকের স্বাধীনতার কথা মাথায় আসে না। তার তখন মাথায় থাকে কেবল নিজের পেটের জ্বালা আর সন্তানের ক্ষুধা। তাই পশ্চিমা আদলে যখন আমাদের নারীবাদী আন্দোলনগুলো নারীর যৌন অধিকারের প্রশ্নে বা পোশাকের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঘুরপাক খায়, তখন সেই আন্দোলনে ওই ইট-ভাঙা শ্রমিক যোগ দেন না।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যত শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমান তার অর্ধেকই নারী। সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে শুধুমাত্র সৌদি আরবেই গিয়েছেন প্রায় ৫০,০০০ নারী শ্রমিক। ওই বছরই এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, “সৌদি আরবে কাজের জন্য গেছে ২ লক্ষ ৭০ হাজার নারী। এরমধ্যে ৫৩ জনের লাশ এসেছে। ৮ হাজারের মতো নারী কাজ থেকে ফিরে এসেছে। বাকি ৯৯ শতাংশই ওখানে ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছে। তারা দেশে টাকাও পাঠাচ্ছে।”

আর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব শ্রমিকদের মধ্যে পুরুষেরা তাদের আয়ের ৫০% দেশে পাঠালেও নারীরা তাদের আয়ের ৯০% টাকাই দেশে পাঠান। তারপরও এসব নারীদের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে যেমন কোনো তৎপরতা নেই; একই আচরণ নারী অধিকার সংঠনগুলোরও। যারা মারা যাচ্ছেন, তারা বাদেও যারা শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন, তাদের আর জায়গা হচ্ছে না পরিবারেও। এই বিরাট সংখ্যক অভিবাসী নারী দেশের অর্থনীতিতে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা যোগ করলেও তাদের জীবন শুধুই যেন সংখ্যা। এসব জায়গায় নারীবাদীদের কোনো আন্দোলন দাঁড় করাতে দেখা যায় না। জীবনের ঝুঁকি জেনেও এই নারীরা কেন এভাবে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন, তার কারণ জানতে নারীবাদীদের উৎসাহী হতে দেখা যায় না।


বাংলাদেশের নারীরা এখন আগের চেয়ে অনেক শিক্ষিত, সাবলম্বী। তারা এখন অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন। ইন্টারনেটের এই যুগে পৃথিবীর আরেক প্রান্তের খবর এখন তাদের হাতের মুঠোয়, ফলে নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এখন অনেক বেশি শক্তিশালী।

পশ্চিমা নারীবাদের উত্থান ঘটেছিল সেই সময়ে যখন পুঁজিবাদ বিকশিত হচ্ছিল। পুঁজিবাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছিল ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ; পুঁজি ভেঙে দিচ্ছিল পারিবারিক বন্ধন, মজুরি নির্ধারণের নামে শ্রমিককে ব্যাখ্যা করছিল একক সত্ত্বা হিসেবে, নারীকে করে তুলছিল পণ্য। সেই প্রেক্ষাপটে চালু হওয়া পশ্চিমা নারীবাদী বয়ান দিয়ে এখন পশ্চিমও ভালো নেই। ধর্ষণের উচ্চহারের দেশগুলোর মধ্যে উপরের দিকে রয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেনের মতো দেশগুলো। এসব দেশে ভেঙে যাচ্ছে পরিবার। বাড়ছে বিচ্ছিনতাবোধ, হতাশা, আত্মহত্যা।

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন এখনো খুবই মজবুত। বাংলাদেশের নারীরা নিজেরও আগে ভাবেন আপনজনদের কথা। তাই আজও বাংলাদেশের নারীরা পরিবারের মানুষগুলোর মুখ চেয়ে সৌদি আরবের মতো দেশে গিয়ে জীবন বাজি রাখেন। আজও বাংলাদেশের নারীরা পরিবারের মান-সম্মানের কথা ভেবে, সন্তানের মুখ চেয়ে মুখ বুঁজে অনেক নির্যাতন সহ্য করেন।

বাংলাদেশের সাধারণ নারীরা জানেন প্রতিশোধ পরায়ণতা কোনো সমাধান নয়। নিজের জীবন বাজি রেখেই তারা পুরুষতন্ত্রকে খারিজ করার দুঃসাহস দেখান। তারা তাত্ত্বিকভাবে না জানলেও জীবন দিয়ে জানেন, পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ এক নয়। তারা জানেন যে, নারী-পুরুষ মিলেই গড়ে তুলতে পারে নারীর জন্য নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ সমাজ-রাষ্ট্র। সেই জায়াগাতেই আমাদের নারীবাদ কথা বলুক। নারী আন্দোলন কাজ করুক।●

ইসরাত জাহান, নেত্র নিউজের বাংলা বিভাগের সম্পাদক।

তথ্য সূত্র:

প্রথম আলো, তাঁরা শুধুই একেকটি সংখ্যা
বাংলা ট্রিবিউন, ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসী কর্মীর জন্য লেবার উইং মাত্র ২৯টি
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর, নির্যাতনের ভয়ঙ্কর বিবরণ দিলেন সৌদি ফেরত তরুণী
Firdous Azim, Feminist struggles in Bangladesh