৫০ বছরে বাংলাদেশ: দেশের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে ২০২১ সালে। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জিত হলেও ২৬ মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭১ সালের এদিনে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। এদিনেই পাকিস্তানি সেনার হাতে বন্দি হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
স্বাভাবিক কারণেই দিবসটি উপলক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশটির যাত্রা কেমন ছিল, তা নিয়ে সাংবাদিক ও বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার বিশেষভাবে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে সুনির্দিষ্ট একটি চিত্রকে দেশের অবস্থার মূল পরিচায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও এর সহযোগীদের হাতে। যুদ্ধের ফলে দেশ হয় বিপর্যস্ত। সেসময় এক মার্কিন কূটনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেন, বাংলাদেশ খুব সম্ভবত একটি “আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলিতে” পরিণত হতে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের শেষ পর্যায়ে যখন যুদ্ধে পর্যুদস্ত দেশে দুর্ভিক্ষ আসন্ন বলে প্রতীয়মান হচ্ছিলো, এমন পরিস্থিতিতে এ মন্তব্য খুবই স্বাভাবিক শুনিয়েছিল। উত্তরে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, “কিন্তু এই ঝুলির দায়িত্ব যে আমাদের উপরেই আসবে, তা বলা যায় না”। যদি এই অতি অপমানকর উক্তির আলোকেই বাংলাদেশকে এর ৫০তম স্বাধীনতা দিবসে বিচার করতে হয়, তবে বলা যায় যে বাংলাদেশ তার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অসম্ভব কোনো কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এই অর্ধশতকে বৈদেশিক অনুদানের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এখন বেশিরভাগ দাতাই সাহায্য দেয় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য। করোনা মহামারীর প্রকোপ চেপে বসার আগ পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত হারে বাড়ছিল। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬% থেকে ৮% পর্যন্ত। যদিও এই সংখ্যা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। গত বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের জিডিপির চেয়ে বেশি। এই অর্জন অস্থায়ী হবার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু তারপরও এটি সত্যিকার সাফল্য। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, এবং ২০২৬ সালের পর জাতিসংঘ বাংলাদেশকে আর স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে রাখবে না।
দারিদ্র এখনো বিদ্যমান থাকলেও তা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যানুসারে, আন্তর্জাতিক দারিদ্র সীমারেখার নিচে বাস করছে এমন মানুষের সংখ্যা ১৯৯১ সালে ছিল ৪৩.৮%। এ হার ক্রমশ কমে ২০১৬ সালে ১৪.৮% নেমে এসেছে। গড় আয়ু, শিক্ষার হার এবং মাথা পিছু খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তাই বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাস বলতে গিয়ে “বুমিং বাংলাদেশ” হিসেবে চিত্রিত করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দল আওয়ামী লীগ চায় এটাই বাংলাদেশের একমাত্র চিত্র হয়ে থাকুক — সেই সঙ্গে ক্ষমতাশীল দলের আরও দাবি, এ পর্যন্ত দেশটির যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তার একক কৃতিত্ব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। দলটির মতে, এই অগ্রগতির জন্য অতীতের কোনো সরকার কোনো কৃতিত্ব পাবে না; বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
অর্থনৈতিক ও অন্যান্য উন্নয়নের কিছু অংশের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের নিঃসন্দেহে। যেমন, আগের প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ সংকট দলটি যেভাবে মোকাবেলা করেছে তা উল্লেখযোগ্য অর্জন; যদিও বলা প্রয়োজন যে এই সেক্টরে প্রকিওরমেন্টে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন দৈনিক কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকাটা ছিল প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় চুক্তি সম্পন্ন করতে বিএনপি সরকারের ব্যর্থতার কারণেই এই সংকট চলছিল। বর্তমানে বিদ্যুৎ না থাকার সমস্যা কমে এসেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু একথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই অর্থনীতি ও অন্যান্য উন্নয়নের সূচকে উন্নতি ঘটেছে, তা নয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি শেষ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বিদ্যুৎ সংকট সত্ত্বেও অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। বিএনপির শাসনামলের পাঁচ বছরে জিডিপি ৩.৮% থেকে ৭%-এ পৌঁছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র নির্মাণে অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের খতিয়ান গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর কৃতিত্ব আওয়ামী লীগকে এককভাবে দেওয়া যায় না।
অর্থনীতি ও উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু ৫০ বছরে বাংলাদেশের যাত্রা কেমন ছিল, তার হিসেব কেবল এর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল কারণ ছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি। সে হিসেবে বরং গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ হেঁটেছে উল্টো দিকে।
এই দিক দিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে, বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনার সময় ২০০৯ সালের আগের সময় নিয়ে কোনো অসত্য ধারনা লালন করা ঠিক হবে না। ভোটে কারচুপির অভিযোগ, দুর্নীতি এবং মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেনি এমন কোনো সময় বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে এই কথাও স্বীকার করতে হবে, গত ৩০ বছরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন পরিস্থিতির এত অবনতি কখনো ঘটেনি, যেমনটি বর্তমানে হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন সূচকের নির্দেশক যেভাবে উর্ধ্বমূখী, একই গতিতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের নির্দেশক নিচের দিকে ধাবমান।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে। যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়, তা পরিচালনা করেছিল একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সেসময় দেশে ছিল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে নেয়, নিজেদের সুবিধাজনক কমিশনার নিয়োগ দেয় এবং সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের আবশ্যিকতা বাতিল করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে বিরোধী দল এবং আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিলেও নির্বাচনে সিস্টেম্যাটিক কারচুপি ঘটে। আওয়ামী লীগ ৯৬% আসন জেতে। এই পরিস্থিতির আলোকে বলা যায়, আওয়ামী লীগ কখনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেবে, তা অকল্পনীয়।
সেই সঙ্গে বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চূড়ান্তরকম সীমাবদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিরোধী পক্ষের টিভি স্টেশনগুলো বন্ধ বা দখল করে নেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র গত বছরই সাংবাদিক, সম্পাদক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশকারী শত শত ব্যক্তিকে সরকারের সমালোচনা করায় ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংবাদপত্রগুলোকে সরকারের মন জুগিয়ে সতর্কতার সঙ্গে খবর প্রকাশ করতে হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে আল জাজিরার অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রে বাংলাদেশ সরকারের ভেতরের দুর্নীতি উন্মোচিত হওয়ার পরও সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়ে কোনো খবর ছাপার সাহস করেনি। সাধারণ নাগরিকেরা মন্তব্য করতে আতঙ্কিত বোধ করেছেন। সাধারণত স্পষ্টবাদী এমন একজন ধারাভাষ্যকার, যাকে অনেকের তুলনায় বেশি সাহসী বলা চলে, তিনি পর্যন্ত এই লেখককে আল জাজিরার তথ্যচিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, “আমার পরিবারকে কে বাঁচাবে?”।
শাসন ব্যবস্থার অবনতি ঘটেছে আরও বেশি। দেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যা আওয়ামী লীগের প্রভাব বলয়ের বাইরে। পুলিশ এবং আইনরক্ষা বাহিনীগুলো ক্ষমতাসীন দল ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের হুকুমে চলে। আইনের শাসন প্রকৃতপক্ষে প্রায় বিলুপ্ত বলা যায়। নিম্ন আদালতগুলো সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। উচ্চ আদালতের অবস্থা কিছুটা ভালো। তবে তাও কেবল নিম্ন আদালতের তুলনায়।
দেশের যেকোনো পরিপূর্ণ চিত্র তৈরি ও উপস্থাপন করতে হলে উল্লেখিত বিষয়গুলো উপস্থিত থাকতেই হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থার অবনতি, এই দুটোই বাস্তব। বিবিসির সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধে যথার্থই বলা হয়েছে: “অনেকেই বাংলাদেশকে উন্নয়নের আদর্শ চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, দেশটি স্বাধীনতার ৫০ বছর পাড়ি দেবার প্রাক্কালে একটি এক দলীয় রাষ্ট্র হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে রয়েছে। এখানে বিপক্ষ মত সহ্য করা হয় না। ফলে যে গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে দেশটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তা আজ হুমকির সম্মুখীন।”
সরকার অবশ্য দেশের এই চিত্রটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। আর সরকার সমর্থক বক্তাদের মাঝে যারা শাসন ব্যবস্থার অবনতির কথা স্বীকার করেন, তারা এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে টেকসই ও প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতির জন্য এই মূল্য দেয়াটা জরুরি। বলা বাহুল্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া এই মূল্য দেশের জনগণ দিতে প্রস্তুত কিনা তা জানার উপায় নেই। কেউ হয়ত যুক্তি দিতে পারেন, সরকার বিরোধী বড় কোনো আন্দোলনের অস্তিত্ব না থাকাই প্রমাণ করে যে দেশের নাগরিকরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির খাতিরে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। অবশ্য নাগরিকদের প্রতিরোধের অভাবের আরেকটি কারণ হতে পারে জনমনে রাষ্ট্রের নির্যাতন নিয়ে ভীতি।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার কমিয়ে আনতে হবে, এই অবস্থানের কোনো যুক্তি নেই। বরং বলা যায়, গণতন্ত্রের অভাবে যতই সরকার এবং আওয়ামী লীগ এক হয়ে পড়ছে, একদলীয় রাষ্ট্র পাকাপোক্ত করছে এবং ফলস্বরূপ দুর্নীতির মহামারী দেখা দিচ্ছে, ততই দেশের উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।
মিডিয়া ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশের কোন পরিচয় তুলে ধরা হবে সেই দ্বন্দ্ব চলমান। অদূর ভবিষ্যতে দেশের যাত্রাপথ যে পরিবর্তিত হবে, তারও কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।●
ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।