মোদির সফর ও বাংলাদেশের প্রাপ্তি
আন্দোলনকারীদের মৃত্যু, রক্ষণশীল ইসলামী গোষ্ঠীর পুনরুত্থান, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ক্রোধান্বিত করে তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তীব্র সহিংসতা পূর্ণ প্রতিবাদ এবং অন্তত ১৬ জন প্রতিবাদকারীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটে গেল। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হোক, তা কিন্তু দুই রাষ্ট্রের কেউই চায়নি।
নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মোদির এই সফর ছিল বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনই নয়, এরচেয়েও গুরুতর কারণ হলো, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী উৎসবের সমাপ্তিও ঘটে এ সময়। কাজেই ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাই যে এতে হাজির থাকবেন, তেমনটাই প্রত্যাশা ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য ভারতের নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থনের প্রেক্ষাপটে সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের জোরালো উপস্থিতি না থাকলে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্নের জন্ম নিত।
কিন্তু যে সফর হতে পারত সৌহার্দপূর্ণ, সেই সফরই এখন মনে রাখা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কয়েকটি কারণে। তার মাঝে অন্যতম প্রধান কারণ নির্দেশ করেছেন সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত বিষয়ক ভারতীয় অধ্যাপক অশোক সোয়াইন। তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের ৭৪ বছরের ইতিহাসে এর আগে কখনো কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরে, সফরের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সফরকৃত রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক নিহত হয়নি। আরেকজন খ্যাতিমান ভারতীয় বিশ্লেষক ভারত ভূষণ বলেন, “দুই দেশের সরকারের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক এবং বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব পরিষ্কার হয়ে ওঠে এই প্রতিবাদে।’’
মোদির এই সফরকে রাষ্ট্রীয় সীমার বাইরে নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবেও দেখা হয়েছে। ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে নিজের দলের অবস্থান শক্তিশালী করতে মোদি এই সফরকে ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষের কাছে মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন।
মমতা ব্যানার্জির অভিযোগের মূল কারণ, বাংলাদেশে এসে একটি বিশেষ মন্দিরে মোদির পূজা দেওয়া। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি নামক গ্রামে অবস্থিত এই মন্দিরটি নিন্মবর্ণ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মতুয়া সম্প্রদায়ের। নিম্নবর্ণ হিসেবে বিবেচিত মতুয়াদের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাত কোটি। অভিযোগের কারণ, পশ্চিমবঙ্গের মতুয়াদের মন জয় করতেই মোদি এই পূজা নিবেদন করেছেন বলে ধারনা করা হচ্ছে। জনমত জরিপকারীদের বিশ্বাস, মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট বিধান সভার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ফলাফল বদলে দিতে পারে। মতুয়া নেতা পরলোকগত হরিচাঁদ ঠাকুরের গ্রাম এবং মন্দির দেখতে যাওয়াটা ছিল নির্বাচনের আগে মোদির জন্য এই সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অর্জনের শেষ সুযোগ। কারণ সিটিজেনশিপ এ্যামেন্ডমেন্ড এ্যাক্ট (সিএএ) আইনটি বাস্তবায়ন না করায় এরইমধ্যে মতুয়া জনগোষ্ঠীর ধারনা হয়েছে, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসী মতুয়া সম্প্রদায়ের হিন্দুদের নাগরিকত্ব প্রদানের অঙ্গীকার করেছিল। এই মানুষগুলো গত পাঁচ দশক কিংবা তারও আগে দেশান্তরিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ গিয়েছিলেন। তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়ার অঙ্গীকারের ভিত্তিতে বিজেপি ২০১৯ এর সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পায়।
মোদির ওড়াকান্দি পরিদর্শন উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়েছে। এরমধ্যে ছিল হেলিপ্যাড ও সড়ক নির্মাণ, পরিদর্শনকৃত মন্দির এবং তৎসংলগ্ন এলাকার সৌন্দর্যবর্ধন। এছাড়া মোদির এই পরিদর্শন ইচ্ছা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ রাজনৈতিক ঝুঁকিও নিতে হয়েছে। মোদির মতুয়া মন্দির পরিদর্শন নিয়ে মমতা ব্যানার্জির ক্ষোভ থেকে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে দ্বিপাক্ষিক পানি বণ্টন নিয়েও তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। উপরন্তু, মোদির বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক আসন বিজয়ে সমর্থ হয়, তবে বাংলাদেশের ক্ষতির সম্ভাবনা আরও বাড়বে।
বিজেপির সবচে বিতর্কিত ও বিভেদ সৃষ্টিকারী দুটি উদ্যোগ হলো সিএএ এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এনআরসি)। এগুলোর মূল লক্ষ্যই হলো বাংলাভাষী মুসলমানদের চিহ্নিত করা। বিজেপির এ ধরনের উদ্যোগের ফলে ইতিমধ্যেই আসামে ১৯ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছেন। দলে মোদির ঘনিষ্টতম সহচর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ্ ইতিমধ্যেই কোনো অস্পষ্টতা না রেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আসামে যা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গেও তা করা হবে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজতে বা ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে, মৌলিক অধিকার হারিয়ে বাস করতে বাধ্য হবে।
মোদির সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে সহিংসতা ঘটেছে, এরইমধ্যে সেই সহিংসতা পরবর্তী প্রতিক্রিয়াও চোখে পড়তে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে মোদির সফরের বিরোধিতা করে ইসলামপন্থীরা প্রতিবাদ করেছে, বিশেষত হেফাজতে ইসলাম। অথচ সরকার এখন তাদের বদলে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) দমনে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয় হলো, মোদি বিরোধী প্রতিবাদ শুধুমাত্র হেফাজত করেনি। বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনও প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে। অথচ এই বামপন্থী সংগঠনগুলো কিন্তু সেভাবে ভারত বিরোধী হিসেবে পরিচিত নয়। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহ-সভাপতি নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সংগঠন প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। পুলিশ এসব সংগঠনের অনেক সদস্যকেই শান্তি ভঙ্গের অভিযোগে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করেছে। এদের ভূমিকা আমলে নিয়ে বিশ্লেষক ভারত ভূষণ বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অফ ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত তার কলামে লিখেছেন, “বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের জন্য রক্ষণশীল ইসলামিক গোষ্ঠীকে দায়ী করা উচিৎ হবেনা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের’’। তিনি আরও বলেন, “বিজেপি সরকারের অধীনে [ভারত বিষয়ে] বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন কিছু বিষয় প্রভাব ফেলেছে। [বিজেপির] সংখ্যালঘু বিদ্বেষী হিসেবে পরিচয় এবং ভোটের জন্য ধর্মকে ব্যবহার বাংলাদেশিদের উদ্বিগ্ন করে’’।
বাংলাদেশ এবং ভারতের সরকার বর্তমানে নিজেদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে খুব উৎফুল্ল। তারা নিজেদের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ককে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় মজবুত বলছে দাবি করছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি অবিশ্বাস এবং অবদমিত ক্ষোভও সম্ভবত অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। এই বিস্তৃত অসন্তোষ ও ক্ষোভের প্রধান কারণ হলো, আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন। দলটি শেষ দুটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে সৃষ্ট জনরোষ এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
এছাড়াও দুই দেশের মাঝে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধরন অন্যায্য বলেও বাংলাদেশে জনমত রয়েছে। এর মাঝে রয়েছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব, সীমান্তে নিরবচ্ছিন্ন বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারত ট্রানজিট নেবার সুবিধা ভোগ করলেও নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট স্থাপনের সুযোগ না দেয়া এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক চুক্তির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ও ভারতের অসম অবস্থান। মোদির এই সফরকে অত্যন্ত উদার ও বন্ধুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখাবার উদ্দেশ্যে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ১০০টি এ্যাম্বুলেন্স, ১২ লক্ষ ডোজ টিকা উপহার দেয়া এবং পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষোভ সৃষ্টিকারী কোনো একটি সমস্যারও সমাধান করা হয়নি।
দেশের মানুষের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বাস্তবায়ন করাটা আওয়ামী লীগের গায়ে চিরকাল যে দাগ হয়ে লেগে থাকবে, সে বিষয়ে তেমন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশিরা এখন ভারতের দিল্লি ও অন্যান্য বিজেপি অধ্যুষিত রাজ্যে বিজেপির লোকজনের হাতে মুসলমানদের নির্যাতিত হওয়ার দৃশ্যের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হাতে বাংলাদেশের প্রতিবাদী নাগরিকদের নির্যাতিত হওয়ার তুলনা করছেন। এই সফর কেন্দ্রিক প্রতিবাদের ফলে অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে হেফাজতের এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। যদি সরকার বিএনপিকে দমিয়ে রাখে এবং রাজনীতিতে স্থান না দেয়, তবে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হেফাজতের উত্থান এখন খুবই সম্ভবপর একটি বিষয়।
নিজের সফর উপলক্ষে ডেইলি স্টার পত্রিকার জন্য লেখা একটি নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লিখেছেন, “কল্পনা করুন, আমাদের দেশগুলোর মানুষেরা এই উপমহাদেশের সবখানে নির্বিঘ্নে শিক্ষা গ্রহণ, চাকরি এবং ব্যবসা বাণিজ্য করছে — এই উপমহাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে বিশ্বের সবচে বৃহৎ তারুণ্যের শক্তি হয়ে সম্পদ, গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে। এই একতাই আমাদের সমাজের গোঁড়ামি, সহিংস উগ্রবাদ এবং বিদ্বেষ বিষের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে পারে।’’
কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, বাস্তবে মোদি সরকারই উগ্র এবং বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসিয়েছে। ইউরোপে যেমন সীমান্ত দিয়ে দুদেশের মানুষের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ থাকে, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়ায় তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। সেই সঙ্গে বাস্তবতা হচ্ছে, মোদির দল বিজেপিই বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াবার দায়ে অভিযুক্ত। এর ফল স্বরূপ এখন সমগ্র অঞ্চলই উত্তপ্তই হয়ে উঠেছে।●
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।