সাংবাদিকতাই যখন অপরাধ

বাংলাদেশের সচিবালয়ে ঢুকতে সাংবাদিকদের প্রবেশপত্র দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়, আর তথ্য সংগ্রহ করাই সাংবাদিকের কাজ — তার মানে যে কাজের জন্য রোজিনা ইসলামের স্বীকৃতি পাবার কথা, সে কাজের জন্যই তিনি এখন আসামি।

সাংবাদিকতাই যখন অপরাধ
দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ১৮ মে আদালতে শুনানি শেষে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। তাকে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ও অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট ১৯২৩ এর অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফটো: হারুন-অর-রশিদ/জুমা ওয়্যার/আলামি লাইভ নিউজ

সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন সাংবাদিক প্রতিদিন বাংলাদেশের সচিবালয়ে যান। সব মন্ত্রণালয়ের দৈনিক কার্যক্রম সম্পাদিত হয় এই সচিবালয়ের সীমানার ভেতর অবস্থিত বিভিন্ন ভবনে। এই ভবনগুলোতে প্রবেশের জন্য সাংবাদিকদের একটি বিশেষ প্রবেশপত্র বা পাস দেয়া হয়। যেসব সাংবাদিকেরা সেখানে যান, তাদের কেউ সচিবালয় বিটে কাজ করেন; কেউ অন্য বিট, যেমন স্বাস্থ্য বা অপরাধ ইত্যাদি বিষয়ের কাজেও সচিবালয়ের পাস নিয়ে নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করেন।

সংবাদ সংগ্রহের জন্য এই সাংবাদিকেরা সচিবালয় ভবনগুলোতে ঢুঁ মারেন, বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে মন্ত্রীসহ সব স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কাজ হলো, কর্মকর্তাদের থেকে পাওয়া বিভিন্ন কাগজ-নথি, তথ্য নিয়ে দিন শেষে নিজ অফিসে ফেরা। “চোথা” নামে পরিচিত এসব নথিপত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাংবাদিকেরা বিভিন্ন জটিল নীতি নির্ধারণী বিষয়ে খবর প্রকাশ করতে পারেন। এর মাঝে কখনো কখনো এমন তথ্য থাকে যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে নতুন ও বিস্তৃত অনুসন্ধানের সুযোগ ঘটে। অবশ্য এসব খবর শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হবে কিনা, তা নির্ভর করে সংবাদমাধ্যমগুলোর রাজনৈতিক আনুগত্য এবং সম্পাদকেরা কতখানি ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক তার উপর।

সচিবালয়ে কাজ করা এমনই একজন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ১৭ মে সচিবালয় থেকে গ্রেপ্তার হন। সচিবালয়ের একটি কক্ষে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখার পর অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট ১৯২৩ ও দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর অধীনে রোজিনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রকৃতপক্ষে রোজিনা যা করেছেন, তা সাংবাদিকদের স্বাভাবিক কাজ হিসেবেই দেখা হয়। সচিবালয়ে কর্মরত আরও ডজন ডজন সাংবাদিক যা প্রতিদিনই করেন। তারা বিভিন্ন সচিব ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের কাছ থেকে নথি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সরকার সব আমলেই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সচিবালয়ের প্রবেশপত্রও ইস্যু করা হয় তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে, যার ফলে সাংবাদিকেরা সচিবালয়ে ঘুরে কাজ করার সুযোগ পান ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে পারেন।

এ কারণেই সাংবাদিক রোজিনাকে আটকে রাখা এবং পরবর্তীতে গ্রেপ্তারকে স্বেচ্ছাচারি আচরণ বলেই প্রতিয়মান হয়। সচিবালয়ের নথিপত্র নেয়ার জন্য যদি পুলিশ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে, তাহলে সচিবালয় প্রবেশপত্র প্রাপ্ত সব সাংবাদিক ও তাদের যারা নথিপত্র দেন, সেসব সরকারি কর্মকর্তাদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করছে, রোজিনা নথি “চুরি” করেছেন। কিন্তু এমনটা ঘটা অস্বাভাবিক। বরং বাস্তবতা হলো, রোজিনার গ্রেপ্তারকে বৈধতা দিতে জড়িত কর্মকর্তাদের একথা বলা ছাড়া উপায় নেই। কারণ, তা না হলে যেসব কর্মকর্তা তাকে নথি দিয়েছেন, তাদেরও গ্রেপ্তার হতে হবে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, কিন্তু বিশেষভাবে রোজিনার বিরুদ্ধেই এই পদক্ষেপ কেন?

এর কারণ খুব সম্ভবত রোজিনার করা সাম্প্রতিক কিছু প্রতিবেদন। রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করেন ২০২০ সালের জুনে। কোভিড মহামারি শুরুর পর প্রথমে তিনি “স্বাস্থ্যমন্ত্রী অফিস করেন না” শিরোনামের একটি প্রতিবেদন করেন। এর প্রায় এক বছর পর, গত ১২ এপ্রিলে প্রথম আলো রোজিনার লেখা আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিশাল দুর্নীতির কথা প্রকাশ পায়। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো একটি চিঠির উপর ভিত্তি করে করা এ প্রতিবেদনে জানা যায়, লিখিত পরীক্ষায় নিশ্চিত পাশের জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে ঘুষ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও, নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য দাবি করেন (রোজিনার প্রতিবেদন অনুযায়ী) যে একজন উপসচিব তাকে এক কোটি টাকা ঘুষ সেধেছিলেন। এর বিনিময়ে লিখিত পরীক্ষায় পাশের জন্য যারা ঘুষ দিয়েছে, সেসব প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেবে নিয়োগ কমিটি।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক পরের দিন রোজিনার আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার মাধ্যমে জানা যায়, অক্সিজেনের তীব্র ও জরুরি প্রয়োজনের থাকলেও দশ মাস ধরে ঢাকার বিমানবন্দরে পড়ে রয়েছে অক্সিজেন ভরা সিলিন্ডার। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনার ফলে ৩০০ ভেন্টিলেটর সেন্ট্রাল ফার্মেসিতে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে ছিল। এই সরঞ্জামগুলো ওয়ার্ল্ড ব্যাংক/এডিপির অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রকল্পের।

গত ২০ এপ্রিল রোজিনা ইসলামের আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটায় ৩৫০ কোটি টাকার অনিয়মের কথা জানা যায়। এই প্রতিবেদনের উৎস ছিল মন্ত্রীদের কাছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার বা সেন্ট্রাল মেডিকাল স্টোরস্ ডিপোর (সিএমএসডি) পরিচালকের লেখা একটি চিঠি।

এর মাসখানেক পর ১৮ মে, প্রথম আলো রোজিনার আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে প্রকাশ হয় যে বাংলাদেশ সরকার এখনো রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে করোনাভাইরাস টিকা উৎপাদনের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেনি। অথচ কিছুদিন আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ চুক্তি হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন।

এসব প্রতিবেদন সুষ্ঠুভাবে খোঁজখবর নিয়ে করা। এগুলোর উৎস ছিল বিভিন্ন আমলার কাছ থেকে পাওয়া বা ফাঁস করা গোপন তথ্য। প্রতিবেদনের সত্যতার কারণেই এগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য ছিল অত্যন্ত বিব্রতকর। এবং প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, রোজিনার গ্রেপ্তারের মূল কারণ এসব প্রতিবেদন। তার এই গ্রেপ্তার দেশের সংবাদমাধ্যমের ক্ষয়িষ্ণু স্বাধীনতার একটি প্রতিফলন।

প্রত্যেক দেশেই সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব চর্চা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সাংবাদিকেরা মন্ত্রণালয়ে ঘুরে বেড়াবে এবং আমলাদের কক্ষে যেকোনো সময় প্রবেশ করবে, এই চর্চা পৃথিবীর অনেক দেশের সাংবাদিকদের কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা দীর্ঘদিন যাবত চলমান একটি প্রক্রিয়া। এবং এর ফলে দেশের গুটিকয় যেসব স্বতন্ত্র সংবাদমাধ্যম রয়েছে, তারা দুর্নীতির খবর জনসমক্ষে প্রকাশের সুযোগ পায় এবং সরকারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে পারে। ক্রমশই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা এই দেশের শাসকগোষ্ঠীর জন্য এ প্রক্রিয়া জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম ছিল।

সচিবালয়ের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। সরকার এই সচিবালয়ে ঢোকার প্রবেশপত্র দেওয়ার মধ্যদিয়ে এর আনুষ্ঠানিক অনুমোদনও দিয়ে থাকে। তাহলে এই পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের জন্য কেন একজন সাংবাদিককে আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে? বরং রোজিনা ইসলাম তার কাজের জন্য প্রশংসার দাবিদার, বিচার না।●

ডেভিড বার্গম্যান, (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।