বাংলাদেশে ডানপন্থার উত্থান ও বুদ্ধিজীবিতার সংকট
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতি ডানপন্থী মতবাদের উত্থান ঘটেছে। অবশ্য বাংলাদেশের ৫০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে ডানপন্থী দল ও মতবাদের প্রভাব নতুন নয়। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ডানপন্থা যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা এর আগে কখনোই এতো স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় রয়েছে এবং তারা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে জাতিকে একতাবদ্ধ রেখে দেশ পরিচালনাও করছে।
কিন্তু বাংলাদেশে যে ডানপন্থার উত্থান দেখা দিয়েছে, তা দেশকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে, অসহিষ্ণুতা বাড়িয়েছে, সমাজে ঘৃণার চাষ করেছে। এই অতি ডানপন্থী মতবাদ কীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে উঠল এবং চালিকাশক্তিতে পরিণত হলো, সে বিষয়ে আলোচনা জরুরি। তবে তার আগে কোন চিন্তা বা মতকে বামপন্থী ও ডানপন্থী বলা হয় এবং কেন বলা হয়, তার ইতিহাসটি জেনে নেয়া যেতে পারে।
১৭৮৯ সাল, ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়েছে। বিদ্রোহীরা বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটিয়েছেন। এই উত্তাল সময়ে ফ্রান্সের জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন বিপ্লবী সরকারের সংবিধান তৈরি করা। এই সংসদে বিতর্কের একটি অন্যতম বিষয় ছিল কতটুকু ক্ষমতা রাজার কাছে থাকবে সেটা সংবিধানে লিখিতভাবে নির্ধারণ করা। রাজা কোনো সিদ্ধান্তে ভেটো দিতে পারবেন কিনা, সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া। আলোচনায় যারা রক্ষণশীল বা রাজার হাতে ক্ষমতা রাখার পক্ষে ছিলেন, তারা সবাই একজোট হয়ে বসেন সংসদের ডান পাশে; আর যারা এর বিপক্ষে ছিলেন, তারা বসেন বাম পাশে। এই সংসদের পরবর্তী সব আলোচনাতেই আইনপ্রণেতারা এভাবেই বসেছিলেন। শুধু ফ্রান্স নয়, পুরো পৃথিবীর চোখ ছিল তখন চলমান এই বিপ্লবের উপর। ফরাসি সংবাদপত্রগুলোর দেখাদেখি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবাদপত্রগুলোও সংসদের এই বিরোধী দুই পক্ষকে ডানপন্থী এবং বামপন্থী বলা শুরু করে। এভাবেই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পরিচয়ের বহুল প্রচলিত এই দুটি ধারার নামকরণ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
ফরাসি বিপ্লবের পর গত দুই শতকে বিশ্ব রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন আসলেও রাজনৈতিক পরিচয় নির্ধারণের এই সহজ সরল মাপকাঠিটি টিকে গেছে। বর্তমান পৃথিবীতে বাম মতবাদ মানে প্রগতিশীল এবং এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট (প্রথাগত চিন্তা বিরোধী) এবং ডান মতবাদ হচ্ছে রক্ষণশীল এবং প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট (প্রথা-রক্ষাকারী)। বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত নিজেদের উগ্র ডানপন্থী বা বামপন্থী হিসেবে পরিচয় দেয় না; বরং একে অপরকে অভিযুক্ত করতেই এ ধরনের তকমা ব্যবহার করে। বিশেষ করে পশ্চিমাবিশ্বে, অভিবাসী এবং অভিবাসন বিরোধী ঘৃণা ছড়ানো রাজনীতিকে অতি ডানপন্থার অন্যতম লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউরোপে ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ফার-রাইট বা অতি ডানপন্থী গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের উত্থানকে এখন বিশ্ব রাজনীতির নতুন ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন গবেষকেরা।
এই অতি ডানপন্থীরা মূলত তীব্র জাতীয়তাবাদী। এরা মনে করে, তাদের জাতিই শ্রেষ্ঠ; অভিবাসীরা তাদের গায়ের রং এবং আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান সংস্কৃতিকে কলুষিত করছে; তাদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। মূলত এসব বয়ানকে সামনে রেখেই এই অতি ডানপন্থীরা সংগঠিত হয়। অতি ডানপন্থীরা একই সঙ্গে ইহুদি এবং মুসলিম বিরোধী। তবে এখন যেহেতু ইউরোপ-আমেরিকায় অভিবাসীদের একটি বড় অংশই মুসলিম, ফলে এই ডানপন্থীদের ঘৃণা ও আক্রমনের লক্ষ্য এখন ইসলাম ধর্ম পালনকারীরা।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার একটা বড় সংকট হচ্ছে, অতি ডানপন্থা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিরোধিতা করা তো দূরের কথা, উল্টো অতি রক্ষণশীলতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা। বাংলাদেশে অতি ডানপন্থী দল ও মতবাদ হিসেবে বুদ্ধিজীবিরা শুধু রক্ষণশীল ধর্ম-কেন্দ্রিকতাকেই উল্লেখ করেন। অতি জাতীয়তাবাদী বয়ানকে যখন পুরো পৃথিবী জুড়েই অতি-ডানপন্থা হিসেবে বিবেচিত করা হয়, তখন বাংলাদেশে এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মতবাদকে ডানপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অতি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উদযাপন করতে দেখা যায়। এখানে উদাহরণ হিসেবে শাহবাগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক অতি-জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি গণমানুষের যুদ্ধ, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-রাজনৈতিক মতবাদের মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন, যুদ্ধ করেছিলেন বৈষম্য, অত্যাচার ও গণহত্যার বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী বাংলাদেশীদের বিচার একটি যৌক্তিক দাবি। কিন্তু গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধের যে নানা দিক, নানা বর্ণ, তা উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের কাছে এসে শুধুই সাদা-কালো বাইনারি ন্যারেটিভ হয়ে যায়। এই সাদা-কালো বিভাজনের কারণে মুক্তিযুদ্ধকে “স্বর্গীয় ঘটনা”, মুক্তিযোদ্ধাদের “স্বর্গীয় দূত”, এবং মুক্তি সংগ্রামের প্রধান নেতাকে প্রশ্নাতীত ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
শুধু সমালোচনা নয়, উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে যে সুনির্দিষ্ট বয়ান (যাকে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বলা যেতে পারে), সেই বয়ানের বিন্দুমাত্র বাইরে যায়, এমন কোনো মতবাদকে তীব্রভাবে আক্রমণ করা হয়। তাই এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী মতবাদ সুনির্দিষ্টভাবে আদালতের রায় কী হবে, ইতিহাসের বই কীভাবে লিখতে হবে, আর ইতিহাসের কোন অংশ বিশ্বাস আর কোন অংশ অবিশ্বাস করতে হবে তা ঠিক করে দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অনেকেই উগ্র-ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিরোধ করার অস্ত্র হিসেবে এই অতি জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে বেছে নেন, যা একই সঙ্গে অকার্যকর ও সমাজের জন্য হানিকর।
এ কথার মানে এটা নয় যে, হেফাজতে ইসলাম বা জামায়াতে ইসলামের মতো রক্ষণশীল ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সমর্থন যোগানো উচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থানের জন্য শুধু জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নয়, দলেরও বিচার হওয়া উচিত। বর্তমান সময়ে হেফাজত ইসলামের যে উত্থান, সংগঠিত গোষ্ঠী হিসেবে তাদের রক্ষণশীল দাবি-দাওয়ার পক্ষে যে শক্তি প্রদর্শন, তা আসলে সামাজিক প্রবণতা ডানপন্থার দিকেই ঝুঁকে যাবার লক্ষণ।
কিন্তু এসব ধর্মভিত্তিক দল বা গোষ্ঠী মতবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আবার অতি ডানপন্থী জাতীয়তাবাদকে বৈধতা দেয়া হলে তা দিন শেষে ধর্মভিত্তিক রক্ষণশীলতার হাতকেই শক্তিশালী করে। বিরোধিতার রাজনীতিকে সহজ-সরল মনে হলেও আদতে তা জটিল সংকট তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জনযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” বলে একটি নির্দিষ্ট মহান বয়ান (গ্রান্ড ন্যারেটিভ) তৈরি করা এবং এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে একটি অলঙ্ঘনীয় ধর্মের মতো মতবাদে পরিণত করা, একটি নির্দিষ্ট দলকে মুক্তিযুদ্ধের হেফাজতকারী হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করা, সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো নাগরিক অধিকারকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করাটা স্পষ্টভাবেই অতি-জাতীয়তাবাদী ডানপন্থার বৈশিষ্ট্য।
দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর একটি প্রিয় কাজ হচ্ছে নিজেদের পছন্দমাফিক জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বিনির্মাণ করা এবং নিজেদের স্বার্থরক্ষাকারী এই বিকৃত ইতিহাসকে আইনের মাধ্যমে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা। এই প্রক্রিয়ায় জনভিত্তিহীন সরকারগুলো ধর্ম বা জাতীয়তাবাদের মতো ডানপন্থার উপর ভর করে নিজেদের দীর্ঘমেয়াদ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, সরকারের জবাবদিহিতা না থাকা ও শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে হেফাজত ইসলামের মতো ধর্মভিত্তিক অতি ডান গোষ্ঠী আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হেফাজতকে ব্যবহার করা হয়েছে, যা আসলে দিনশেষে এই অতি-ডান গোষ্ঠীটিকে শক্তিশালী করেছে। তাই হেফাজতের প্রতিবাদ করার ন্যায্য অধিকার হরণ ও আন্দোলনে মানুষের মৃত্যু যেমন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কষ্ট দেয় না, তেমনি হেফাজতের নেতৃবৃন্দও জনভিত্তিহীন একটি সরকারকে মেনে নিতে যে তাদের কোনো সমস্যা নেই, তা জানাতে দ্বিধা করেন না।
ফলে বাংলাদেশে অতি ডানপন্থী এই দুই শিবিরের উত্থান সমাজে অস্থিরতা, মেরুকরণ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়াচ্ছে। তীব্র জাতীয়তাবাদ ও গোঁড়া ধর্মভিত্তিক মতবাদের মধ্যে আসলে তেমন পার্থক্য নেই। তারা একে অপরের শত্রুতাকে নিজেদের শক্তিশালী করার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে। তাই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার মধ্যেও ধর্ম নামক জুজুর ভয় তৈরি করে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকে বৈধ করা যায়। এ অবস্থায় দেশে এই অতি ডানপন্থী গোষ্ঠী দুটিকে মোকাবেলা করার জন্য, গণতান্ত্রিক, উদার ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক চর্চা ফিরিয়ে আনার জন্য, যে কোনো একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতা নয়, বরং দুটি গোষ্ঠীকেই সঠিকভাবে চিহ্নিত করা দরকার।●
সাইমুম পারভেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।