গওহর রিজভী: শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং সবচেয়ে বড় বোঝা
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী কয়েক যুগের গবেষণা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন একজন অধ্যাপক। পেশাগত জীবনে তিনি ইতিহাস, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর অসংখ্য বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। যে রাজনৈতিক দলটিকে তিনি বরাবর সমর্থন করে এসেছেন, অর্থাৎ আওয়ামী লীগে তার সমকক্ষ আর কোনো প্রভাবশালী বিদ্বান নেই।
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৯১ সালে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে “Bangladesh: Towards civil society” শিরোনামে দ্য ওয়ার্ল্ড টুডে জার্নালে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এটি ছেপেছিল রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স। ওই নিবন্ধে তিনি জেনারেল এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজয়ের কারণ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী খালেদা জিয়া কোন কারিশমায় নিজ দলকে জিতিয়ে এনে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এর চুলচেরা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
৩০ বছর আগে যখন গওহর রিজভী আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়া সত্বেও নিজ দলের প্রতি অনেক কম পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন, তখন তিনি এই দুই রাজনৈতিক দল সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তা তার বর্তমান অবস্থায় বেশ কৌতূহল উদ্দীপক।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং সবচেয়ে বড় বোঝা
প্রবন্ধে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ হিসেবে অধ্যাপক রিজভী দায়ী করেছিলেন শেখ হাসিনাকে। তার মতে, “She is her party’s best asset as well as its greatest liability”, অর্থাৎ শেখ হাসিনা একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বড় সম্পদ এবং সবচেয়ে বড় বোঝা। এর ব্যাখায় তিনি বলেন, শেখ হাসিনা তার বাবার মতো জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে গ্রাম বাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করার প্রচার কৌশল জানলেও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে পারেন না। উপরন্তু শেখ হাসিনা দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করেন। ফলে তাকে নির্ভর করতে হয় দলের তরুণ নেতাদের উপর, যাদের উদ্যম থাকলেও জ্ঞান ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব আছে। এছাড়াও অধ্যাপক রিজভীর মতে, আওয়ামী লীগ ক্রমেই তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। এদের মধ্যে কেউ সরকারের সুবিধাভোগী হয়ে টিকে আছেন, কেউবা দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ফলে শহুরে বুদ্ধিজীবীদের কাছে দলটি নিজেদের ভাবমূর্তি খুইয়েছে এবং নিজেদেরকে এরশাদের সামরিক সরকারের বিকল্প হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের পরাজয়ের আরেকটি বড় কারণ হলো, এরশাদ ও জিয়াউর রহমানকে একই পাল্লায় মাপা এবং দুজনকেই দুর্নীতিবাজ ও গণতন্ত্র হরণকারী হিসেবে প্রচার করা। জিয়ার বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রচারণা গওহর রিজভীর মতে অধিকাংশ মানুষ “অপবাদ” হিসেবেই নিয়েছে।
৩০-এর নীচে বয়স এমন ভোটারদের অধিকাংশের কাছে মুজিব হচ্ছেন অতীতের এক মহান নেতা। অন্যদিকে তাদের স্মৃতিতে জিয়া হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ক্যারিশমেটিক নেতা ও গ্রামে গ্রামে চষে বেড়িয়ে বাঙালির শ্রেষ্ঠত্বের জয়গান গাওয়া ক্লান্তিহীন রাষ্ট্রপতি। পাশাপাশি মুজিব সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা পরবর্তী সরকারগুলোর সময় প্রচারমাধ্যমে যেভাবে উঠে এসেছে, সেনাবাহিনীতে জিয়ার অগুণতি সমর্থকদের না চটানোর জন্য জিয়ার সমালোচনা সেভাবে উঠে আসেনি।
এছাড়াও অধ্যাপক রিজভী বলেন, বিভিন্ন বক্তৃতায় শেখ হাসিনা যেভাবে জিয়াকে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার সঙ্গে জড়িত করার চেষ্টা করেছেন, সেটা সাধারণ মানুষ একদমই গ্রহণ করেনি। তাদের কাছে ১৯৯০-এর নির্বাচন ছিল সামনের দিকে তাকাবার সময়, অতীত নিয়ে অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটির নয়।
হাসিনার বর্তমান পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী সেই সময় আরও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছে কথিত ভারতপ্রীতি, যেটা সেই সময় উনি মনে করতেন একটি অসত্য অপবাদ। তবে উনি এটা লক্ষ্য করেছিলেন, ভোটারদের একটি বিরাট অংশ, এমনকি অনেক সুশিক্ষিত নাগরিকও আশঙ্কা করছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য ভোটারদের মনোভাব পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বলেছিলেন ক্ষমতায় আসলে তিনি এরশাদের আমলে করা অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করে দেশভাগের পর হতে রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়া সব হিন্দুদের সম্পত্তি ফেরত দেবেন। এর ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ভোটাররা মনে করেছিল, আবারো সেই ব্রিটিশ আমলের হিন্দু জমিদারী ফেরত আসবে আর মুসলমানেরা প্রজা হবে।
বিএনপির জয়ের নেপথ্যে খালেদার ভাবমূর্তি
বিএনপির জয়ের কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে গওহর রিজভী প্রথমেই মন্তব্য করেন, “বিএনপির অসাধারণ বিজয়কে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ দিয়ে ব্যাখা করাটা হবে ভুল।” যদিও তিনি নিজেই আশা করেননি বিএনপি জিতবে।
শেখ হাসিনার এই আন্তর্জাতিক উপদেষ্টার মতে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয়ের প্রধান নিয়ামক ছিল খালেদা জিয়ার ইমেজ। তার মতে, বিএনপিপন্থী গণমাধ্যমে খালেদা জিয়া উপস্থাপিত হয়েছেন একজন আপোসহীন নেত্রী এবং এরশাদ বিরোধী শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার রূপকার হিসেবে, যা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। অবশ্য খালেদা জিয়া সম্পর্কে এই মত পোষণ করা ছাড়া তার আর কোনো বিকল্পও ছিল না।
গওহর রিজভী তার ব্যাখায় বলেন, বাংলাদেশে সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করা, পাতানো নির্বাচনে অংশ না নেয়া, সরকারের সুবিধা প্রত্যাখান করা কিংবা প্রয়োজনে কারাগারে বন্দী হওয়া একজন রাজনীতিবিদের আত্মত্যাগের প্রমাণ হিসেবে খালেদা জিয়া জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয়। খালেদা বিএনপির নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর থেকেই এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং ১৯৮৬ সালের নির্বাচন প্রত্যাখান তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। গওহর রিজভী আরও যোগ করেন, এরশাদ আমলে হাসিনার রাজনৈতিক আচরণ ছিল খালেদা জিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত।
রিজভী মনে করেন, খালেদা জিয়ার আপোসহীন ভাবমূর্তি তাকে তরুণ ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। এই তরুণেরা আবার খালেদা জিয়ার এই ইমেজ ছড়িয়ে দিয়েছিল তৃণমূল পর্যায়ে। ১৯৮৯-৯০ সালের মধ্যে দেশের ৩২১টি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ২৭০টিতেই বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল বিজয়ী হয় যা ছাত্রদের মধ্যে বিএনপির জনপ্রিয়তাকে প্রমাণ করে। এই ছাত্রদের অধিকাংশই গ্রামের সন্তান যারা তাদের চিন্তাধারা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছিল। এই ছাত্ররা শুধু এরশাদকে ক্ষমতাচ্যূতই করেনি, জনগণকেও সংগঠিত করেছে।
এছাড়া, গওহর রিজভীর মতে, যদিও আওয়ামী লীগ তাদের অতীতের রাষ্ট্রীয়করণ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রত্যাবর্তনের নীতি বিসর্জন দিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবর্তক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরণের কৃতিত্বের দাবিদার বিএনপিই ব্যবসায়ীদের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছিল। এর ফলে তাদের ব্যয়বহুল নির্বাচনী প্রচারণার তহবিল সংগ্রহ সহজ হয়েছিল। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার বাস্তবমুখী নীতি ও নিরলস প্রচারণা ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করেছিল।
বিএনপির জয়ের পেছনের সর্বশেষ যুক্তি হিসেবে গওহর রিজভী উপস্থাপন করেন, ভোটারদের ঐতিহাসিক সতর্কতা ও বাস্তবমুখিতা। দুটি দলের প্রায় অভিন্ন নৈতিক অবস্থান এবং তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় ভোটারেরা সেই দলকেই নির্বাচিত করেছে, যারা স্থিতিশীলতা দিতে সক্ষম এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে বলে তাদের মনে হয়েছে।
৩০ বছর পর গওহর রিজভীর অবস্থান
নিবন্ধটি প্রকাশের প্রায় ২০ বছর পর গওহর রিজভী, তার ভাষায় “জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবজ্ঞাকারী” শেখ হাসিনার উপদেষ্টার পদ নেন এবং প্রায় এক যুগ ধরে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে এক সময় ভারতপ্রীতিকে দায়ী করলেও গওহর রিজভী নিজেই বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মূল সূত্রে পরিণত হয়েছেন। যদিও তিনি একসময় জিয়াউর রহমানকে তরুণ প্রজন্মের কাছে “মুক্তিযুদ্ধের ক্যারিশমেটিক নেতা ও ক্লান্তিহীন রাষ্ট্রপতি” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে সেই জিয়ার নামে আওয়ামী লীগের নেতারা কুৎসা রটনা করলেও গওহর রিজভীকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। একটা সময় তিনি আওয়ামী লীগের অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিকে নিরুৎসাহিত করা এবং এরশাদ ও জিয়াউর রহমানকে একই পাল্লায় মাপার চেষ্টাকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে “অপবাদ” দেয়ার শামিল হিসেবে উল্লেখ করলেও, উপদেষ্টা হিসেবে নিজের ১২ বছরে তাকে এ ব্যাপারে নিজের দলকে নিরুৎসাহিত করতে দেখা যায়নি।
সম্ভবত রিজভীর এই নিবন্ধটির সবচেয়ে মজার দিকটি হলো যে, এখন শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে যদি গওহর রিজভী সেই ত্রিশ বছর আগের মতো সমালোচনা করতেন, তাহলে তিনি হয়ত পালানোরও জায়গা পেতেন না। ওই লেখাতে শেখ মুজিবের নাম লেখার সময় তিনি একবারও “জাতির জনক” বা “বঙ্গবন্ধু” বিশেষণ ব্যবহার করেননি। এ কাজটি যদি তিনি এখন করতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ডজনখানেক মামলা হতো, আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে বিএনপি-জামায়াতের চর আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে রাজপথে মিছিল করত বা কোনো হাস্যকর সাজানো মামলায় তাকে জেলের ভাত খাওয়ান হতো। গওহর রিজভীর বিশ্লেষণের ভালো-মন্দ কে পাশ কাটিয়েও এটা খুব সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ গত ৩০ বছরে কতটা বদলে গেছে। ওই সময় তিনি এমন একটি লেখা লিখতে পারতেন, যেটি বর্তমান সময়ে তার পক্ষে কোনভাবেই লেখা সম্ভব নয়।●
একেএম ওয়াহিদুজ্জামান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক।