একাধিক চলক বলছে অর্থনীতি আগাচ্ছে

এবারের ছকে আমদানি, রাজস্ব আয়সহ কয়েকটি সূচক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক অগ্রগতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

একাধিক চলক বলছে অর্থনীতি আগাচ্ছে

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছকের মাধ্যমে তুলে ধরার ধারাবাহিক কাজের এটি দ্বিতীয় নিবন্ধ। প্রথম নিবন্ধ প্রকাশের পর এর সঙ্গে আরও তিন মাসের তথ্য যুক্ত হয়েছে।

এই সিরিজ প্রকাশের লক্ষ্য, ছকের তথ্য এবং চলকগুলোর তাৎপর্য বিষয়ে জানতে প্রথম প্রকাশিত নিবন্ধটি পড়ুন।

সম্প্রতি ঘোষিত ২০২১-২২ জাতীয় বাজেটে দেয়া তথ্য মতে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এর সঙ্গে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) প্রাক্কলন তুলনা করলে দেখা যায়, তাদের হিসাব অতি আশাবাদী। এডিপির হিসাব বলছে প্রবৃদ্ধি ঘটবে ৬ দশমিক ৮%। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাব আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলছে, এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ঘটবে ৩ দশমিক ৬%।

আমাদের তৈরি করা ছকে দেখা যাচ্ছে যেএতে অর্থনৈতিক উন্নতির বিভিন্ন নিদর্শন যেমন রয়েছে, তেমনি সতর্ক হবারও যথেষ্ট কারণ আছে। গত তিন মাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতিগুলো হলো:

— এ বছরের মার্চ পর্যন্ত আমদানি বেড়েছে ১১%;

— এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্ব আয় বেড়েছে প্রায় ৭%;

— রেমিটেন্সের পরিমাণ বেড়ে চলেছে এবং

— মার্চ-এপ্রিলে ৯০ হাজারের বেশি শ্রমিক বিদেশ গিয়েছেন। 

কিন্তু অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এখনো দূরতম, কারণ: 

— বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ এখনো নিম্ন;

— শিল্প উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি নগণ্য;

— রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে নগণ্য এবং

— বেসরকারি খাতে ক্রেডিট এখনো নিম্নমুখী। 

তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব চলকে এপ্রিল-মে মাসে মহামারী পরিস্থিতির অবনতি খুব একটা আমলে নেয়া হয়নি।

ছক ১: বিদ্যুৎ উৎপাদন

চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এ চলকে বৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র ১ দশমিক ৪%। করোনা মহামারী শুরুর আগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছিল ৯-১১% হারে।

ছক ২: শিল্প উৎপাদন

এ সূচকে জানুয়ারি পর্যন্ত খুব সামান্য বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে; এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪%।

ছক ৩: রফতানি

২০২০-২০২১ অর্থবছরে মার্চের শেষে দেশে রফতানি বেড়েছে দশমিক ৪% (০.৪%)। 

ছক ৪: আমদানি

এ বছরের মার্চ পর্যন্ত আমদানি বেড়েছে ১১%। ধারনা করা যেতে পারে, এই বৃদ্ধি হয়ত অর্থনীতিরপুনরুদ্ধারের একটা রূপ নির্দেশ করে।

ছক ৫: বেসরকারি খাতে ক্রেডিট

বেসরকারি খাতে ক্রেডিটের গতি ধীর হয়ে আসা চলমান রয়েছে। গত এপ্রিলেও এ গতি বটমড্‌ আউট (ঊর্ধ্বমুখী হবার আগে নিম্নমুখী গতির শেষ পর্যায়ে পৌঁছান) হয়েছে কিনা তা অস্পষ্ট ছিল।

ছক ৬: রাজস্ব আয়

এ বছরের এপ্রিল নাগাদ দেশে রাজস্ব আয় প্রায় ৭% বেড়েছে, যা অনেকটাই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে আগাচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেয়।

ছক ৭ ও ৮: উন্নয়ন খাত ও উন্নয়ন বহির্ভূত খাতে ব্যয়

লকডাউন চলাকালে দুটি চলকেই ধ্বস নাম। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমে আসা এ চলক দুটি সহসা ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে না বলেই মনে হয়। 

ছক ৯ ও ১০: রেমিটেন্স ও প্রবাসী শ্রমিক

এ খাতে এখনো রেমিটেন্স ঊর্ধ্বমুখী। গত মার্চ-এপ্রিলে ৯০ হাজার শ্রমিক বিদেশে পারি জমিয়েছেন। এ থেকে ধারনা করা যায়, অবস্থা ঘুরতে শুরু করেছে।

ছক ১১ ও ১২: মজুরি হার সূচক এবং মুদ্রাস্ফীতি

এ বছরের মে মাস পর্যন্ত মজুরি হার বেড়েছে ৬ দশমিক ৪% করে  যা মহামারী পূর্ববর্তী সময়ের গতির কাছাকাছি। অর্থবছরের শেষ মাস ২০২১ সালের মে-তে এসেও মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল ছিল বলে দেখা গেছে।

ছক ১৩ ও ১৪: চালের মূল্য ও ঢাকায় বাড়ি ভাড়া

২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে চালের দাম ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।  আর গত তিন মাসের উপাত্ত অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় বাড়ি ভাড়া সূচক কিছুটা ধীর হয়ে এসেছে।

ছক ১৫, ১৬, ১৭: সুদের হার, সরকারি খাতে ক্রেডিট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সঞ্চয় ডিপোজিট ও ঋণে সুদের হার – দুটোই গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল। তবে এ অবস্থা থেকে বোঝা যায় যে দেশে কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটছে। সরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ কমে এসেছে। ২০২১ সালের মার্চ নাগাদ মজুদের পরিমাণ (যা দিয়ে কত মাসের আমদানি সম্ভব, সেই হিসেবে প্রকাশ করা হয়) তিন মাসের বাফার সীমার (তিন মাসের আমদানির জন্য যত অর্থ প্রয়োজন তার) অনেক উপরে ছিল।

ছক ১৮: স্টক মার্কেট

চলতি বছরের মে মাস নাগাদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বৃদ্ধি চলমান ছিল। এর আগে ২০১৯ এর মাঝামাঝি থেকে স্টক এক্সচেঞ্জে নিম্নমুখী গতি চলমান ছিল এবং ২০২০ এর মাঝে এসে এই নিম্নমুখী গতি ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছিল। 

সামগ্রিক মূল্যায়ন

করোনা মহামারী দেখা দেওয়ার আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে মন্দা চলছিল, সেই দশা পরিবর্তনের এখনো কোনো দৃঢ় লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে কিছু কিছু সূচক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে ইঙ্গিত চোখে পড়ে। উৎপাদন এবং গৃহস্থালি চাহিদার নিম্নধাবমান পরিস্থিতি মার্চ-এপ্রিলে এসে ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে বলে মনে হয় (তবে তা গত লকডাউনের আগে)। শ্রম চাহিদা উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ২০২০ এর শেষদিকে এসে স্থিতিশীল হয়ে এসেছে বলে মনে হয়। অর্থনৈতিক খাতে গৃহীত নীতিগুলো দেশের অৰ্থনীতির জন্য সহায়ক। স্টক মার্কেটের অবস্থা আশাব্যঞ্জক।●

জ্যোতি রহমান, এ্যাপ্লাইড ম্যাক্রোইকনোমিস্ট।