বাংলাদেশের “প্রিডেটর” প্রধানমন্ত্রী
প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এবার বিশ্বের ৩৭ জন রাষ্ট্রপ্রধানকে “গণমাধ্যমের স্বাধীনতা লুণ্ঠনকারী (প্রিডেটর)” বলে আখ্যা দিয়েছে। গত ৫ জুলাই সংগঠনটি এই রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি তালিকা প্রকাশ করে। তালিকাটি সম্পর্কে সংগঠনটি বলে, এই রাষ্ট্রপ্রধানেরা “অত্যন্ত কঠোরভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনে লিপ্ত।” তালিকার ৩৭ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ যখন আরএসএফ এ তালিকা প্রকাশ করে, তখন তাতে হাসিনার নাম ছিল না। এবার তার নাম অন্তর্ভুক্ত হলো।
আরএসএফের এ তালিকাটির কথা বাংলাদেশের কোনো প্রচার মাধ্যমে ঠাঁই পায়নি। লজ্জাজনক তালিকাটিতে শেখ হাসিনার নাম আসার খবর দেশে প্রকাশ না হওয়ায় আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল, এখানে গণমাধ্যম কতটা নিয়ন্ত্রণের ভেতর থাকে।
শেখ হাসিনাসহ “গণমাধ্যমের স্বাধীনতা লুণ্ঠনকারী” ৩৭ রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে আরএসএফ বলেছে, এসব রাষ্ট্রপ্রধান “সেন্সরশিপের একটি পদ্ধতি তৈরি, ইচ্ছামাফিক সাংবাদিক গ্রেপ্তার বা তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের উস্কানি দেয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরছে…”।
আরএসএফ আরও বলে: “এই (গণমাধ্যমের স্বাধীনতা) লুণ্ঠনকারীদের প্রত্যেকের নিজস্ব স্টাইল রয়েছে। কেউ অযৌক্তিক এবং উন্মত্ততা প্রকাশ পায় এমন সব নির্দেশ দিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। কেউ আবার ঠাণ্ডা মাথায় দমন সহায়ক আইন ব্যবহার করে।”
শেখ হাসিনার স্টাইল কোনটা?
আরএসএফ লিখেছে, “তিনি [হাসিনা] গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন বলে দাবি করলেও তিনি আসলে কোনো ধরনের সমালোচনাই সহ্য করতে পারেন না। এই অসহিষ্ণুতাই তাকে ক্ষমতা দখল করে রাখতে ইন্ধন জুগিয়েছে। তার সরকার নিজের মতাদর্শ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট (ডিএসএ) জারি করেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্টতা রেখে জারি করা এ আইনটি সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করাতে একেবারে মোক্ষম অস্ত্র।”
প্রায় তিন বছর আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “যেসব সাংবাদিক মিথ্যা খবর প্রকাশ করে না, তাদের ডিএসএ নিয়ে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।” এ পরিপ্রেক্ষিতে আরএসএফ বলেছে, ডিএসএর দেয়া ক্ষমতা বলে সরকার কোন খবর “সত্য” আর কোন খবর “মিথ্যা”, তা নিজেরা নির্ধারণ করতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “যেসব সাংবাদিক এবং ব্লগারকে কর্তৃপক্ষ ঝামেলা মনে করে, তাদেরকে ডিএসএর মাধ্যমে হেনস্তা করাটা শেখ হাসিনার সরকার ও তাদের সমর্থকদের জন্য কোনো বিষয়ই না। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা এবং দলটির ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ মাঠে হাসিনার পক্ষে বলপ্রয়োগকারী হিসেবে কাজ করে। রাস্তায় কোনো প্রতিবাদ বা যেকোনো ধরনের বিক্ষোভের সময় যেন সাংবাদিকেরা খবর সংগ্রহ করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে এরা সাংবাদিকদের হেনস্তা ও আক্রমণ করে। বিশেষভাবে নির্বাচনের সময় অত্যন্ত তৎপর থাকে এরা। কখনো কখনো এরা দল বেধে খুন-খারাপিতেও লিপ্ত হয়। সাংবাদিকদের প্রায়ই আহত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের শেষ গন্তব্য হয় মর্গ।”
আরএসএফ তাদের প্রতিবেদনে হাসিনা সরকার যে বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ও সমালোচনাকারীদের নিয়ন্ত্রিত ওয়েবসাইট ব্লক বা তাদেরকে হুমকি দেয়, সে তথ্যও যোগ করতে পারত। এছাড়া হাসিনা সরকার যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশকারীদের ফেইসবুক পেইজ হ্যাক ও বিদেশ থেকে চালানো ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালায়, সে তথ্যও ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক ও কর্পোরেট মালিকানার মাধ্যমে কীভাবে দেশের টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলোর উপর সেন্সরশিপ আরোপ করে, তা সম্প্রতি নেত্র নিউজের কলামে প্রকাশিত হয়েছে।
দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর কার্যক্রম দেখে আর মনে হয় না যে স্বাধীনভাবে কাজ করার কোনো ইচ্ছা বা শক্তি তাদের মধ্যে টিকে আছে। যে গুটিকয় সংবাদপত্রকে এখনো খানিকটা স্বাধীনমনষ্ক বলে মনে হয়, সেসব পত্রিকা প্রায়ই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন থেকে সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এসব প্রতিবেদনে সরকার ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা থাকে। কাজেই আরএসএফের এই প্রতিবেদনটি নিয়ে কেন তারা কোনো সংবাদ প্রকাশ করল না, সে প্রশ্ন এসে যায় (অবশ্য কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম একটি প্রেস রিলিজ প্রকাশ করেছে। সরকারপন্থী একটি সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া প্রেস রিলিজে আরএসএফের নিন্দা জানানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু উল্লেখ করা হয়নি)।
একেবারেই কোনো সংবাদ প্রকাশ না হবার সবচে সম্ভাব্য কারণ, প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সরাসরি “প্রিডেটর” হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বিষয়টি অনেকটা ২০০১-২০০৬ এর বিএনপি আমলের মতো, যখন সংবাদপত্রগুলো কখনোই তারেক রহমানের সরাসরি কোনো সমালোচনা করত না; বরং বিএনপির কার্যালয় হাওয়া ভবনের কথা উল্লেখ করত।
আরএসএফের এই তালিকাটি সম্পর্কে গণমাধ্যমের এই নীরবতার পেছনে আরেকটি বিষয়ও কাজ করে থাকতে পারে। তা হলো, শেখ হাসিনার বাবা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন আওয়ামী লীগ সরকার ভক্তি-পূজার বিষয়ে পরিণত করেছে, এখন তার মেয়ে শেখ হাসিনাকেও তাই করতে চাচ্ছে। আর এ বিষয়টা সবাই নীরবে বুঝে নিয়েছে। তাই শেখ হাসিনার সমালোচনা করে, এমন কোনো কিছু প্রকাশের স্পর্ধা কারো নেই।
পরিস্থিতি এমন, দেখা যাবে কবে ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট সংশোধন করে শেখ হাসিনার সমালোচনা করাও বেআইনি করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। উল্লেখ্য, এই ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট অনুযায়ী ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা সম্পর্কে “নেগেটিভ প্রোপাগান্ডা” প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক এবং আর্থিক দুর্নীতি দূর করতে, স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার উত্থান রোধে এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরি। আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতায় টিকে থাকতে সংবাদমাধ্যমকে কোনোভাবেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না, তাই শেখ হাসিনাও আরও অনেকদিন “গণমাধ্যমের স্বাধীনতা লুণ্ঠনকারী” হিসেবেই থেকে যাবেন বলে মনে হচ্ছে।●
ডেভিড বার্গম্যান (@TheDavidBergman), ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।