ওরা প্রতিমন্ত্রীর লোক
মাতারবাড়ি এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্পে দুর্নীতি — “চক্রান্তমূলক কার্যে” লিপ্ত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী এই রাজনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আওয়ামী লীগের দলীয় থিঙ্ক ট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ ইনফরমেশন বা সিআরআইয়ের পৃষ্ঠপোষক তিনি। শেখ হাসিনার জীবনের উপর নির্মিত “হাসিনা: এ ডটার’স টেল” তথ্যচিত্রটির একজন প্রযোজকও নসরুল হামিদ বিপু — বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে কৃতিত্বের দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার ও নসরুল হামিদ বিপু। তবে সরকারের এই সাফল্য ম্লান হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে। খোদ নসরুল হামিদ বিপুর বিরুদ্ধে এমনই একটি অভিযোগ উঠে এসেছে নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে। আইন লঙ্ঘন করে স্বজনপ্রীতি ও সম্ভাব্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নিজেই।
গত ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় “$100 [company], disputed Vitol chosen for largest LPG terminal” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। সেখানে বলা হয়, জাপানের মারুবেনি কর্পোরেশন, ডাচ-সুইস জ্বালানি কোম্পানি ভিটল এবং পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানির একটি যৌথ ব্যবসায়িক জোট বা কনসোর্টিয়াম কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দেশের বৃহত্তম এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ পেতে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সাথে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে ৩০৫ মিলিয়ন ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণ করবে এই কনসোর্টিয়াম।
কিন্তু মাত্র ১০০ ডলার পরিশোধিত মূলধনের একটি কোম্পানি — পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল — কীভাবে ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের কাজ পাওয়া একটি কনসোর্টিয়ামের অংশ হতে পারে? দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদনে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই দৃশ্যপটে আসেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু স্বয়ং। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তারই হুমকিতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় প্রতিবেদনটি। তবে পত্রিকাটির প্রিন্ট ও ই-পেপার সংস্করণে-এর কপি থেকে যায়।
বিষয়টি ঢাকার সাংবাদিক মহলে বেশ আলোচিত হয়। জ্বালানি বিটে কাজ করেন, এমন একাধিক সাংবাদিকের মাধ্যমে এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে নেত্র নিউজ। আমরা তখন বোঝার চেষ্টা করি, নসরুল হামিদ বিপুর এমন জবরদস্তিমূলক আচরণ ও হস্তক্ষেপের কারণ কী? পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের পেছনে আসলে কে আছে? শুরু হয় নেত্র নিউজের অনুসন্ধান।
আমরা জানতে পারি যে, পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে নিবন্ধিত। প্রথমেই কোম্পানিটির নিবন্ধন সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করি আমরা। এরপর কাগজপত্রে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে যারা ছিলেন, তাদের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপিও আমরা পেয়ে যাই। পাশাপাশি, টার্মিনাল নির্মাণ সংক্রান্ত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কিছু অভ্যন্তরীণ সরকারি নথিপত্রও আমাদের হাতে আসে।
এসব নথিপত্র ও তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামে এই কোম্পানিটি নিয়ন্ত্রণ করেন স্বয়ং নসরুল হামিদ বিপুর আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা — তারা সবাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর নিজের লোক। প্রতিমন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্বাহীরাই পাওয়ারকোর হর্তাকর্তা।
এক সময় নসরুল হামিদ নিজেই হামিদ গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পারিবারিক এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে একাধিক ব্যবসা পরিচালনা করে। এর কয়েকটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও ছিলেন বিপু। পাশাপাশি, কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ শেয়ারের মালিক তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা।
সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানে দাখিলকৃত নথিপত্র অনুযায়ী, পাওয়ারকোর প্রধান শেয়ারধারী হলেন কামরুজ্জামান চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি। তার পরিচয় সংক্রান্ত নথিপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে নেত্র নিউজ নিশ্চিত হয় যে, কামরুজ্জামান চৌধুরী হলেন নসরুল হামিদ বিপুর আপন মামা। পরবর্তীতে তিনি নিজেও বিষয়টি আমাদেরকে নিশ্চিত করেন। কামরুজ্জামান চৌধুরী নিজেও দীর্ঘদিন ধরে হামিদ গ্রুপের সাথে জড়িত ছিলেন। তার ছেলে, ভাই ও ভাইয়ের ছেলেরা হামিদ গ্রুপের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছেন ও করছেন।
পাওয়ারকোর মালিকানা বিষয়ে কামরুজ্জামান চৌধুরীর সাথে আমাদের ভয়েস কলে আলাপ হয়। তার কথায় স্পষ্টই বোঝা যায় যে, তিনি মূলত তার আপন ভাগিনা, অর্থাৎ নসরুল হামিদ বিপুর পক্ষে শিখণ্ডী হিসেবে কাজ করছিলেন। পাওয়ারকো সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি অত ডিটেইলস জানি না। আমাকে নিয়া গেছে কাওরান বাজারের সামনে যে জেএসসি অফিস আছে, রেজিস্ট্রেশন, সেখানে। ওরা সব রেডি করে রাখছে, আমি শুধু সিগনেচার করে দিছি। এটুকুই। এখন কার নামে দিছে, আমি কিছু জানি না ঠিক।”
তবে তিনি স্বীকার করেন হামিদ পরিবারের সাথে তার আত্মীয়তার সূত্রেই তাকে পাওয়ারকোর সামনে রাখা হয়েছে। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ওরা তো আমার আত্মীয় তো। আপন মামা তো আমি। নিয়া বলছে যে এখানে এখানে সই করো। আমি সই করছি। আমি তেমন ভালো কইরা পড়িও নাই কী লেখা আছে।”
তবে তিনি দাবি করেন কোম্পানিটির সাথে তার আর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তার ভাষ্য, “আমি অত ডিটেইলস কোনো কিছুই জানি না। আসলে আমি কোনো কিছুই জানি না। আমাকে শুধু বলা হইছে যে ইউ হ্যাভ সাম শেয়ারস ইন দিস কোম্পানি — এখানে এখানে সই করো। আমি করছি। আবার এক সময় বলছে যে, না, তোমার শেয়ার আর নাই, এখানে এখানে সই করো। আমি কইরা দিছি। এই পর্যন্তই। এর আগে পরের সামনের পিছনে আমি আর ডিটেইলস কোনো কিছুই জানি না।”
তিনি আরও বলেন, “মুরাদ সাহেব” নামে এক ব্যক্তি যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে তাকে নিয়ে কোম্পানি গঠনের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন। কামরুজ্জামান চৌধুরী যে মুরাদ সাহেবের কথা বলছেন তার পুরো নাম মোহাম্মদ মুরাদ হাসান। সিঙ্গাপুরে দাখিলকৃত নথিপত্র অনুযায়ী পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের একজন বিকল্প পরিচালক হলেন মুরাদ হাসান। পাশাপাশি, তিনি কোম্পানিটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা বা সিওও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। নেত্র নিউজের হাতে আসা সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, পাওয়ারকোর সিওও হিসেবে তিনি বিপিসির সাথে সরাসরি মাতারবাড়ি এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্পের দরকষাকষিতে অংশ নিয়েছিলেন।
এই মুরাদ হাসানই আবার “ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট” নামে হামিদ গ্রুপের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও ছিলেন।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় নসরুল হামিদ নির্বাচনী হলফনামায় জানান, তিনি নিজেই ডেলকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সেসময় তিনি কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারেরও মালিক ছিলেন। বর্তমানে ডেলকোর মালিকানা তার ছেলে জারিফ হামিদ ও ছোটভাই এন্থেখাবুল হামিদের হাতে।
শুধু মুরাদ হাসানেই সীমাবদ্ধ নয় ডেলকো ও পাওয়ারকোর সম্পর্ক। অঘোষিত ও গোপন এই সম্পর্কের সূত্র খুঁজতে আমরা হাজির হই বারিধারার ৩২, প্রগতি সরণিতে। বাংলাদেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নথিপত্র অনুযায়ী, পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল এই ঠিকানাতেই প্রথম নিবন্ধিত হয়েছিলো।
নেত্র নিউজের একজন প্রতিবেদক বারিধারার এই ঠিকানায় গেলে দেখতে পান সেখানে কেইমরিচ, সুনন ও ইউরো নামে তিনটি অফিস ফার্নিচার ব্র্যান্ডের শো-রুম রয়েছে। বাংলাদেশে এই বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর পরিবেশক হলো ডেলকো। ডেলকোর ওয়েবসাইটেও তাদের শো-রুমের ঠিকানা: ৩২, প্রগতি সরণি, বারিধারা। আবার সুনন বাংলাদেশ বা sunon-bd.com ডোমেইনটির রেজিস্ট্রেশন রেকর্ড অনুযায়ী, এই ঠিকানাতেই এন্থেখাবুল হামিদের নামে নিবন্ধিত হয়েছে ডোমেইনটি। এভাবে আমরা নিশ্চিত হই যে, ডেলকোর শো-রুমের ঠিকানাতেই নিবন্ধিত হয়েছিলো পাওয়ারকো।
প্রতিমন্ত্রীর সাথে আরও নানা ভাবে সম্পর্ক রয়েছে পাওয়ারকোর।
বিপুর ছোট ভাই এন্থেখাবুল হামিদ নিজেও হামিদ গ্রুপের একাধিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই এন্থেখাবুল হামিদের সাথে পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাবিল খানের সংযোগ রয়েছে। এই ভারতীয় নাগরিক দুবাই-ভিত্তিক একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ও সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক একটি শিপিং লাইনের মধ্যপ্রাচ্য শাখা পরিচালনা করেন। আমরা দেখতে পাই, এন্থেখাবুল হামিদের ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলেন নাবিল খান। তবে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা প্রতিমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করার পরপরই এন্থেখাবের বন্ধুতালিকা থেকে বাদ পড়েন নাবিল খান।
পাওয়ারকোর সাথে জড়িত আরেক ব্যক্তি হলেন কোম্পানিটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক তারেক খলিল উল্লাহ, যিনি দীর্ঘদিন হামিদ গ্রুপে কর্মরত ছিলেন। তিনি এন্থেখাবুল হামিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এন্থেখাবুল হামিদ বাংলাদেশে বতসোয়ানার অবৈতনিক কনসাল জেনারেল। আর কনস্যুলেটের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তারেক খলিল উল্লাহ সেখানে দপ্তর কার্যক্রমের ব্যবস্থাপক ছিলেন।
নসরুল হামিদ বিপুর মামা কামরুজ্জামান চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী, মুরাদ হাসান তাকে কারওয়ানবাজারের আরজেএসসি অফিসে (যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর) নিয়ে গিয়েছিলেন।
কাগজপত্র ঘেঁটে আমরা দেখতে পাই হামিদ গ্রুপের আরও দুই জন কর্মকর্তা পাওয়ারকো গঠনের সময় আরজেএসসি অফিসে উপস্থিত ছিলেন। কোম্পানি হিসেবে পাওয়ারকোর নিবন্ধনের সময় এই দুইজনকে স্বাক্ষী হিসেবে রাখা হয়। জাহাঙ্গির আলম নামের একজন স্বাক্ষীর পরিচয়পত্র ও লিংকডইন প্রোফাইল দেখে আমরা নিশ্চিত হই যে, তিনি হামিদ গ্রুপের একজন সহকারি ব্যবস্থাপক। অপর স্বাক্ষী রুহুল আমিনের নিবন্ধিত মোবাইল নম্বর “ট্রুকলার” অ্যাপে “রুহুল হামিদ গ্রুপ” নামে সংরক্ষিত রয়েছে।
দুর্নীতি-বিরোধী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ওপেন কন্ট্রাক্টিং পার্টনারশিপের মুখপাত্র গিওর্গ নিউম্যান। আমাদের অনুসন্ধানের ফলাফল নিয়ে আমরা তার সাথে কথা বলি। তিনি বলছেন, আত্মীয়-স্বজনকে শিখণ্ডি হিসেবে সামনে রেখে কোম্পানি গঠন ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে এসব কোম্পানির ব্যবহার তারা আগেও দেখেছেন।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, পারিবারিক সংশ্লিষ্টতা গোপন রাখতে কীভাবে বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার একটি ক্লাসিক কেস (আদর্শ উদাহরণ) হলো এই ঘটনা।”
তিনি আরও বলেন, “পারিবারিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলাই হয় এ ধরণের পরস্পর-সংযুক্ত একাধিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এগুলোর মালিক কোনোটাতে হন চাচা বা মামা, কোনোটাতে আবার মেয়ে বা পুত্রবধূ। এর ফলে আপনি কখনই জানতে পারবেন না যে পারিবারিক বৈঠকে বা ঘরোয়া আয়োজনে কী ধরণের আলাপ হয়। এতে করে এ ধরণের ঘটনা অনুসন্ধান করা বা কোনো কিছু প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা আপনাদের প্রতিবেদনে যা দেখছি তা হলো, এখানে অসংখ্য রেড ফ্ল্যাগ (ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়) উঠে এসেছে, যা খুবই সন্দেহজনক।”
সরকারি নথিপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, মাতারবাড়িতে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য তিনটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পেয়েছিলো বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। মারুবেনি-ভিটল-পাওয়ারকো কনসোর্টিয়ামের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় জাপানের মিতসুই কর্পোরেশন ও দক্ষিণ কোরিয়ার এসকে গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম এবং জাপানের সুমিতোমো কর্পোরেশনের সাথে সম্পৃক্ত একটি কনসোর্টিয়াম।
বাংলাদেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থায়নও ক্রমেই কমে আসছে। এসব কারণে আগামী বছরগুলোতে দেশটিতে আমদানিকৃত প্রাকৃতিক ও খনিজ গ্যাসের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন এলপিজি প্রক্রিয়াজাতকরণে সক্ষম একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পেলে আর্থিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে মারুবেনি-ভিটল-পাওয়ারকো কনসোর্টিয়াম। আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের এলপিজি মার্কেটে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
এই কনসোর্টিয়ামেরই একটি কোম্পানি পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের সাথে অঘোষিত সম্পর্ক আছে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর। কনসোর্টিয়ামের সাথে তার সম্পর্কের তথ্য গোপন করে ২০১৫ সালের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘন করেছেন তিনি।
এই আইনের ধারা ২৪-এর উপধারা ১ অনুযায়ী পিপিপি প্রকল্পে বেসরকারি অংশীদার নির্বাচনের সময় কোনো ব্যক্তি দুর্নীতি, প্রতারণা, চক্রান্তমূলক বা জবরদস্তিমূলক কাজে লিপ্ত হলে, তিনি দুর্নীতি, অসদাচরণ বা উভয়ের জন্য দায়ী হবেন। একই আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী নসরুল হামিদ বিপু “চক্রান্তমূলক কার্যে” লিপ্ত হয়েছেন। আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অংশীদার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দরপত্র মূল্যায়নের সাথে জড়িত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রকল্পে জড়িত কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সংঘাত থাকলে, ওই ব্যক্তিকে নির্বাচন ও মুল্যায়ন প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
এই ধারার ব্যাখ্যা অনুযায়ী মাতারবাড়ি এলপিজি প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই ‘‘স্বার্থের সংঘাত” আছে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর, কারণ পাওয়ারকোর সাথে তার পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যবসায়িক ও আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
কিন্তু স্বার্থের সংঘাত থাকা সত্ত্বেও, নসরুল হামিদ বিপু আইনানুযায়ী মাতারবাড়ি এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেননি। বরং, তিনি বেসরকারি অংশীদার নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
তার মন্ত্রণালয়ের যে সভায় মারুবেনি-ভিটল-পাওয়ারকোসহ বিভিন্ন কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়, সেখানে সভাপতিত্ব করেছেন তিনি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মূল দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য এই প্রকল্পের একটি সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, যেখানে স্বাক্ষর করেছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে লেখা বিভিন্ন চিঠিতেও টার্মিনাল প্রকল্পের বেসরকারি অংশীদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিমন্ত্রীর খুঁটিনাটি নির্দেশনার উল্লেখ আছে। নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ সংক্রান্ত কাজে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেসব চিঠির আদানপ্রদান হয়েছে, তার সবগুলোর অনুলিপিই দেওয়া হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবকে।
অর্থাৎ, স্বার্থের সংঘাত থাকা সত্ত্বেও নিজেকে বেসরকারি অংশীদার নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে প্রত্যাহার না করে প্রতিমন্ত্রী আইনের ভাষায় “চক্রান্তমূলক কার্যে” লিপ্ত হয়েছেন। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
প্রশ্ন উঠছে মারুবেনি ও ভিটলকে নিয়েও, কারণ পাওয়ারকোর সাথে অংশীদারিত্বে আসার পরপরই নসরুল হামিদ বিপুর মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের কাজ পেয়েছে কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশের সরকার সরকার ইতিমধ্যেই এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানী করছে। কোনো দরপত্র ছাড়াই এলএনজি সরবরাহের কাজটি তিন দফায় পেয়েছিল ডাচ-সুইস জ্বালানি কোম্পানি ভিটল। আবার এই ভিটলের সাথেই যৌথভাবে মাতারবাড়ি এলপিজি টার্মিনালের ৩০% মালিকানা পাবে পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেট্রোবাংলার কাছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানী সরবরাহের এই তিনটি কাজ ভিটল পেয়েছে পাওয়ারকোর সাথে তাদের কনসোর্টিয়ামটি গঠিত হওয়ার পর।
কনসোর্টিয়াম গঠনের পর বিপুর মন্ত্রণালয় থেকে কাজ পেয়েছে আরেক সদস্য মারুবেনিও। ২০২১ সালের মে মাসে মারুবেনি ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইজিসিবি) সাথে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ইজিসিবিও নসরুল হামিদ বিপুর নিয়ন্ত্রণাধীন।
ভিটল ও মারুবেনি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিতর্কে জর্জরিত। ২০১২ ও ২০১৪ সালে নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সরকারি প্রকল্পের কাজ পেতে ঘুষ প্রদানের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে শতাধিক মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে বাধ্য হয় মারুবেনি। এরই সূত্র ধরে নয় মাসের জন্য তাদের অর্থায়নে হওয়া প্রকল্পে মারুবেনির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিল জাপানের বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা।
অন্যদিকে, মাত্র কয়েক মাস আগেই, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভিটলের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ব্রাজিল, ইকুয়েডর ও মেক্সিকোতে ঘুষ প্রদানের দায়ে মার্কিন বিচার বিভাগের সাথে শর্তসাপেক্ষে প্রসিকিউশন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার একটি চুক্তি করে — যার অংশ হিসেবে ১৬৪ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেয় ভিটল।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন জেমস শেলবার্ন হেনরি। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল জাস্টিস প্রোগ্রামের একজন ফেলো তিনি। ভিটল ও মারুবেনির রেকর্ড নিয়ে আমরা তার সাথে কথা বলি।
তিনি বলেন, “আপনারা পুরো ঘটনার তথ্যাদি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেদিকে না গিয়েও, এই দুই প্রতিষ্ঠানের [ভিটল ও মারুবেনি] যে অতীত ইতিহাস রয়েছে, তার ভিত্তিতে কিছুটা আঁচ করার সুযোগ রয়েছে। […] এই দুই প্রতিষ্ঠানই বড় মাপের বৈশ্বিক খেলোয়াড়। আর তারা বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি সংঘটনের ইন্ধনদাতা। অর্থাৎ, এ ধরণের অপচর্চার দীর্ঘ ইতিহাস তাদের রয়েছে। কাজেই, আপনাদের প্রতিবেদনে যে ধরণের কর্মকাণ্ডের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা যে অব্যাহত ছিল ও আছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য।”
নেত্র নিউজের এই প্রতিবদনে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে আমরা ভিটল ও মারুবেনির বক্তব্য জানতে চেয়েছিলাম।
ভিটলের একজন মুখপাত্র আন্দ্রিয়া স্লেফার আমাদের জানান, মাতারবাড়িতে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য একটি নন-বাইন্ডিং এমওইউ বা সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিষয়টি এখনও ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে। ভিটল বা অন্য কোন পক্ষ এখনও এই প্রকল্পটি নিয়ে কোন বাধ্যতামূলক অঙ্গীকার করেনি।
পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের সাথে ভিটলের ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিষয়ে মুখপাত্র আমাদের কোন প্রশ্নের জবাব দেননি।
মারুবেনি কর্পোরেশনের একজন মুখপাত্র কাওরি তেরাউচি নেত্র নিউজকে ইমেইলে জানান, “ঘুষ ও দুর্নীতির বিষয়ে [কোম্পানিটির] একটি কঠোর জিরো-টলারেন্স পলিসি রয়েছে।” তিনি বলেছেন, মাতারবাড়ি এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্পে কোন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে মারুবেনি অবগত নয়। যেসব বিস্তারিত তথ্যের ভিত্তিতে নেত্র নিউজের এই প্রতিবেদনে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে, সেসব তথ্য-প্রমাণ মারুবেনিকে সরবরাহ করার জন্য মুখপাত্র আমাদের অনুরোধ করেছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খান শুধুমাত্র এটুকুই জানান যে, প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু আলোচিত প্রতিবেদনটির ব্যাপারে পত্রিকার মালিককে ফোন করেছিলেন কিনা তা তাদের, অর্থাৎ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকদের, জানা নেই।
আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়ে মোহাম্মদ মুরাদ হাসান ও পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের বক্তব্য জানতে আমরা মুরাদ হাসানের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু তিনি কোন সাড়া দেননি।
নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে নসরুল হামিদ বিপুর বক্তব্যের জন্য আমরা তার সাথে যোগাযোগ করি। হোয়াটসএপের মাধমে আমাদের প্রশ্নগুলো তাকে পাঠানো হলে তিনি ওই প্রশ্নগুলো তার সরকারি ইমেইলে পাঠাতে বলেন। প্রশ্নগুলো দেখে প্রয়োজন মনে করলে তিনি উত্তর দেবেন বলে আমাদের জানান। আমরা তাকে প্রশ্নগুলো ইমেইল করি। তবে এখনও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়ে নসরুল হামিদ বিপুকে প্রথম হোয়াটসএপ বার্তাটি পাঠানো হয় ১০ই জুলাই। বার্তা পাঠানোর কয়েক ঘন্টা পরেই আওয়ামী লীগের দলীয় থিঙ্ক ট্যাংক সিআরআইয়ের একজন কর্মকর্তার ফেসবুক পেজ থেকে নেত্র নিউজের সম্পাদকদের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রচারণা শুরু হয়।
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকেও স্পন্সরড পোস্ট দিয়ে নেত্র নিউজের সম্পাদকদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হয়। অন্যদিকে, বিভিন্ন ভুয়া ও বেনামি পেজ থেকেও পোস্ট, ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে নেত্র নিউজের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলতে থাকে।●